এই সেই গাছবাড়ি। (ইনসেটে) অভিজিৎ চৌধুরী ওরফে পাপলি। — নিজস্ব চিত্র
এটাও এক ‘গেছোদাদা’র বৃত্তান্ত!
ইনিও গাছেই ঘর বেঁধেছেন। দিন-রাত নেই, চারাগাছের খোঁজে ইতিউতি চষে বেড়ান। সকাল-দুপুর-সন্ধেয় খোঁজ করতে গেলে কখনও শোনা যায়, তিনি চারাগাছ আনতে বারবিশা গিয়েছেন। কখনও সারের খোঁজে শিলিগুড়ি ছুটেছেন। কাকভোরে খোঁজ করলেও জানা যায়, জল দেওয়ার পাম্প খারাপ হওয়ায় মিস্ত্রি আনতে ছুটেছেন আলিপুরদুয়ার। অক্ষরে অক্ষরে ‘হযবরল’ মিলিয়ে বলতে হয়— ‘কিছুতেই দেখা হবার যো নেই।’
কিন্তু অষ্টপ্রহর এমন হন্যে হয়ে ছোটার সুবাদেই ন্যাড়া হয়ে যাওয়া বিশাল জমি জুড়ে শয়ে-শয়ে চারাগাছ বুনেছেন ‘গেছোদাদা’। ঢাউস ‘গাছবাড়ি’ বানিয়ে ভাড়া দিয়েছেন। তা থেকে যা আয় হচ্ছে, তা দিয়ে ফের চারা কিনে বুনে ফেলছেন। শুধু তা-ই নয়, কেউ বেড়াতে গেলে শর্ত দিচ্ছেন, তাঁকেও একটা চারাগাছ লাগাতেই হবে। সেই চারা যিনি লাগাচ্ছেন, তাঁর নাম-ধাম, তারিখ লিখে রাখছেন একটা মস্ত বড় রেজিস্টারে। গাছ বড় হলে নাম ঝুলিয়ে দেবেন সেই গাছে।
এমন পাগলামো দেখেই হয়তো শিলিগুড়ির অভিজিৎ চৌধুরী ওরফে পাপলিকে এখন আদর করে ওই ‘গেছোদাদা’ নামেই ডাকছেন দক্ষিণ মেন্দাবাড়ি গ্রামের বাসিন্দারা!
জায়গাটা আলিপুরদুয়ার জেলায়। চিলাপাতা অরণ্যের গা ঘেঁষা দক্ষিণ মেন্দাবাড়ি গ্রামে বুড়ি বাসরা নদীর ধারে অনাদরে পড়েছিল বরাইক জমিদারদের প্রায় ১০০ বিঘা জায়গা। কয়েক বছর আগে জায়গাটা দেখে পছন্দ হয়ে যায় শিলিগুড়ির প্রতিষ্ঠিত তরুণ ব্যবসায়ী পাপলির। বছর তিনেক আগে বরাইক জমিদারবাড়ির উত্তরাধিকারীদের কাছ থেকে পর্যায়ক্রমে জমিটা কিনে ফেলেন। সেই থেকে গাছ পোঁতা শুরু তাঁর। গ্রামবাসীরা তো বটেই, বন দফতরের অফিসার-কর্মীরাও তাঁর ঝোঁক দেখে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।
মাত্র ৩ বছরের মধ্যেই বসানো হয়ে গিয়েছে ১০ হাজার গাছ। আর পুরনো যে বড় গাছগুলো ছিল, সেগুলোর ডালে বানানো হয়েছে দু’টো গাছ-বাড়ি! মেন্দাবাড়ির পঞ্চায়েতের নেতা-কর্তারা রাতারাতি জায়গাটা আগের মতো সবুজ হচ্ছে দেখে উৎসাহী হয়ে নিয়মিত খোঁজখবর করছেন।
পাপলির হাতে গড়া এই অভিনব পর্যটন কেন্দ্রের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছে মাস তিনেক আগে। বন বিভাগ থেকে শুরু করে পঞ্চায়েতের নেতা-কর্তারা এসেছিলেন। আরও গাছ লাগাতে উৎসাহ দিয়েছেন সকলেই। এখন এখানে নদীর ধার ঘেঁষে সারি সারি পেয়ারা গাছ। কোথাও কুলের ঝোপ। অন্তত ৪ হাজার শুধুই ফলের গাছ। এলাকার বাসিন্দা বিজয় বরাইক বললেন, ‘‘সবাইকে একটা করে গাছ লাগাতে হবে। এ নেশার মজাই আলাদা। ভাবুন তো, বেড়াতে এসে গাছ লাগিয়ে চলে গেলেন।
বহু বছর পরে পরিবারের কেউ গিয়ে যদি দেখতে পান, সেই গাছটায় তাঁর পূর্বপূরুষের নাম লেখা, তা হলে কেমন লাগবে!’’
পর্যটন-বনসৃজনের এমন মেলবন্ধন দেখে রোমাঞ্চিত অনেকেই। এক বনকর্তা যেমন রাজস্থানের পিপলান্ত্রি গ্রামের কথা তুললেন। সেখানে বছর ছয়েক আগে এক পঞ্চায়েত কর্তা তাঁর মেয়ের মৃত্যুর পরে নিয়ম চালু করেছিলেন, কারও কন্যাসন্তান জন্মালে ১১১টি করে চারাগাছ বুনতে হবে। সেই গ্রাম এখন সবুজে সবুজ। রাজ্যের নতুন উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষ, কালচিনির বিধায়ক উইলসন চম্প্রমারিও বুড়ি বাসরার ধারে এই বনসৃজনের কথা শুনেছেন। চম্প্রমারি তো মাঝেমধ্যেই এখানে আসেন। রবীন্দ্রনাথবাবু বলেন, ‘‘পাহাড় ও সমতলের বন-লাগোয়া এলাকায়
গড়ে ওঠা সব রিসর্টে যদি এমন একটা গাছ লাগানোর নিয়ম চালু করা যায়, তা হলে ১০ বছরে এলাকার ছবিটা আরও ঘন সবুজ হয়ে যাবে।’’
আর সেটাই স্বপ্ন শিলিগুড়ি কমার্স কলেজের প্রাক্তনী পাপলির। তাঁর কথায়, ‘‘জমিটা নেওয়ার পরে বলেছিলাম, জায়গাটা সবুজ করে দেব। সেই চেষ্টা করতে গিয়ে গাছ বোনাটা কেমন নেশার মতো হয়ে গিয়েছে।’’ পেশায় কাঠুরে (কাঠের ব্যবসা করেন বলে অনেক সময় মজা করে নিজের এই পরিচয় দেন) নেশায় গাছ লাগান। ‘‘এটাই তো জীবনের মজা,’’ হাসতে থাকেন ‘গেছোদাদা’!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy