Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

ঢেউয়ের মার, মাছের কামড়েও ছাড়েননি মুঠি

সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে কেঁপে উঠছিলেন কৃষ্ণবর্ণ, পেটানো চেহারার কানু।

বাংলাদেশ উপকূলরক্ষী বাহিনীর হাতে নামখানার রবীন্দ্রনাথ দাসকে তুলে দিচ্ছেন উদ্ধারকারী জাহাজের কর্তৃপক্ষ। শুক্রবার চট্টগ্রামে। নিজস্ব চিত্র

বাংলাদেশ উপকূলরক্ষী বাহিনীর হাতে নামখানার রবীন্দ্রনাথ দাসকে তুলে দিচ্ছেন উদ্ধারকারী জাহাজের কর্তৃপক্ষ। শুক্রবার চট্টগ্রামে। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০১৯ ০৩:৫২
Share: Save:

উল্টে যাওয়া ট্রলারের একটি বাঁশই চার চারটে দিন ধরে ছিল মাঝি রবীন্দ্রনাথের জিয়নকাঠি।

ঝোড়ো সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের তুলনায় সে বাঁশ নেহাতই খড়কুটো। সেই খড়কুটো ধরেই নিজেকে ভাসিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করে গিয়েছেন নামখানা থেকে ‘এফ বি নয়ন’ ট্রলারে সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া রবীন্দ্রনাথ দাস ওরফে কানু। একটানা বৃষ্টি যেন আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। সাগরের নোনা জল খাওয়ার অযোগ্য, গলা শুকোলে তাই হাঁ করে বৃষ্টির জল খেয়েছেন। পিঠে, হাতে, ঘাড়ের খাঁজে নিরন্তর কামড়ে গিয়েছে ছোট ছোট মাছের ঝাঁক। তার পরেও বাঁশ থেকে মুঠি ছাড়েননি একটি বারের জন্য। চোখ বুজতেই ভেসে উঠেছে বৃদ্ধ বাবা-মা, স্ত্রী আর ছোট ছোট ছেলেমেয়ে দুটোর মুখ।

সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে কেঁপে উঠছিলেন কৃষ্ণবর্ণ, পেটানো চেহারার কানু। নয়ন ট্রলারের মাঝি। শুক্রবার আবহাওয়া কিছুটা শোধরানোয় তাঁকে নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়তে পেরেছে কেএসআরএম-এর পণ্যবাহী জাহাজ এম ভি জাওয়াদ। বুধবার চট্টগ্রামের কুতুবদিয়ার কাছে কানুকে উথালপাতাল জলে ভাসতে দেখে উদ্ধার করেন এই জাহাজের নাবিকেরা। ক্লান্তিতে নামখানার এই মৎস্যজীবী তখন প্রায় অচেতন। তার পরে চিকিৎসা ও খাবারে অনেকটাই চাঙ্গা হন কানু। এ দিন বিকেলে তাঁকে বাংলাদেশের কোস্ট গার্ডের কাছে হস্তান্তরের আগে পতেঙ্গার মেরিন অ্যাকাডেমির জেটিতে হাজির করা হয়। সেখানেই তিনি বর্ণনা দেন ফুঁসে ওঠা সাগরের সঙ্গে তাঁর হার না-মানা লড়াইয়ের কাহিনি। গোটা শরীরে ঢেউয়ের চাবুকের ক্ষত। মুখের চামড়ায় দগদগে ঝলসানি। বললেন, ‘‘বেঁচে আছি, এটাই অবাক ব্যাপার!’’ ছলছলে চোখে তিনি ধন্যবাদ জানালেন জাহাজের নাবিকদের। এ দিন দুপুরেই ভিডিয়ো কলে কথা বলেছেন বাড়ির সবার সঙ্গে। কথা যে খুব একটা বলতে পেরেছেন, তা নয়। শুনেছেন বেশি। ছোট্ট মেয়ে অনন্যা আর ছেলে রুদ্রনীল যখন ক্যামেরার সামনে এসেছে, কানুর মুখে হাসি। তাদের দেখিয়ে নাবিকদের বলেছেন, ‘‘এরা আমার ছেলেমেয়ে!’’

তবে লড়াইয়ের কথা বলতে গেলে এখনও আতঙ্ক কানুর চোখেমুখে। বলছিলেন, ‘‘কত দিন যে ভেসেছিলাম হিসেব ছিল না। একটার পর একটা দিন গিয়েছে, রাত এসেছে। আবার দিনের আলো ফুটেছে!’’

কানু জানিয়েছেন, বাংলাদেশ জলসীমার কাছাকাছি আসতেই বিরাট একটা ঢেউয়ের মারে ছিটকে ওঠে ‘নয়ন’। একেবারে উল্টে পড়ে। সবাই তখন জলে। ভেসে থাকা একটা লম্বা বাঁশ ধরেন সবাই মিলে। সবার গায়ে লাইফ জ্যাকেট, শুধু তাঁরই জোটেনি। তার পরে ভাসতে থাকেন সবাই। সাগর যেন সবাইকে ডোবানোরই পণ করেছিল। ঢেউয়ের ঝাপটায় বাঁশ থেকে মুঠি খুলে যাচ্ছিল এক এক জন সঙ্গীর। কোন দিকে তাঁরা ভেসে গিয়েছেন জানেন না কানু। কিছুতেই মুঠি ছাড়েননি তিনি আর ‘ভাইপো’ নামে আর এক সঙ্গী। বুধবার দুপুর ১২টা নাগাদ তাঁকে দেখতে পায় জাওয়াদ জাহাজের নাবিকেরা। তার ঘণ্টা তিনেক আগে অচেতন হয়ে মুঠি ছেড়ে গিয়েছে ভাইপোর। চোখের সামনে তলিয়ে গিয়েছেন তিনি। এ বার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন কানু, ‘‘আর কয়েকটা ঘণ্টা যদি সে পারত!’’

শুক্রবার বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের হাতে কানুকে তুলে দেন জাহাজের মালিক কেএসআরএম গ্রুপের সিইও মেহরুল করিম। স্বাস্থ্য পরীক্ষার পরে তাঁকে পতেঙ্গা থানায় হস্তান্তর করা হয়। ভারতীয় হাই কমিশন থেকে জানানো হয়েছে, নামখানার কানুকে দ্রুত দেশে ফেরানোর তোড়জোড় চলছে।

অন্য বিষয়গুলি:

Namkhana Fisherman Chittagong Bay of Bengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE