—ফাইল চিত্র
দু’দিন ধরে মায়ের মুখটা মাড় না-গালা হাঁড়ির মতো গনগনে। থেকে থেকেই গবগব করে ফোটা আধসেদ্ধ চালের মতো ছিটকে আসছে গঞ্জনা। দু’টুকরো এলোমেলো কথা নিয়ে কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করলে রাকিবুলকে শুনতে হচ্ছে, ‘বড় অইসস, জ়া ভাল বুজ় কর!’ সাত সকালে মুড়ির উপর গুড় ছড়ানো বাটিটা তার দিকে এমন করে ঠেলে দিচ্ছে যেন সকালে খিদে পাওয়াটা তার ঘোর অন্যায়।
দাদা আর ভাবির চোখের ভাষা পড়লেও তার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠছে, এ বাড়িতে তার অবস্থানটা একটা ঘন বোঝার মতো হয়ে উঠেছে এই ক’দিনে। পাড়াতুতো চাচা-খালা তো বটেই এমনকি মহল্লায় নতুন শাদির পরে বে-গাঁ থেকে আসা শহিদুল্লার নতুন বৌটাও সে দিন তাকে বেআব্রু জিজ্ঞেস করে বসে, ‘ই বার তো আরব যাইবার সময় অইল ভাইজ়ানের, জ়াবা কবে!’ ঘরে-বাইরে এমন বিজন ব্যবহারের দুপুরে তার কাছে চুপি চুপি এসে ছোট বোনটা মাঝে মাঝে শুধু প্রশ্ন করে, ‘ভাই, তোরে ফের চলি যেতে অইব না!’’
ইদের ছুটিতে তেরো দিনের জন্য দেশে ফিরে একটু প্রলম্বিত হয়ে গিয়েছে তার গ্রাম-যাপন। জলজ হাওয়ায় সাঁ-সাঁ সাইকেল চালিয়ে, পাড়ার বটতলায় পা ছড়িয়ে আড্ডা দিয়ে, সন্ধের মাচায় আরব দুনিয়ার গল্প ফিরি করে এ বার বুঝি তার ফেরার পালা।
শুধু রাকিবুল বোঝে, এ ক’দিনে মন তার আঠার মতো লেগে গিয়েছে রামডোবার গাছ-পুকুর ধুলো রাস্তায়।
দিন কয়েক আগে রাতের খাওয়া দাওয়ার পাট চুকলে পুকুর পাড়ে হাত ধোওয়ার সময়ে রাকিবুল এক বার সন্তর্পণে দাদার কানে তুলেছিল কথাটা, ‘ভাই বুঝলা, যাইতে আর মন চায় না!’ উত্তরটা ফেরেনি। তবে, সেই অন্ধকার রাতেই রাকিবুল টের পেয়েছিল, তার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে আছে বড় ভাই।
কথাটা মায়ের কানে পৌঁছেছিল পরের দিন। আটার পুরু পরোটা, রাকিবুলের সামনে ধরে প্রথম সকালেই একটু নরম গলায় হালিমা জানতে চেয়েছিলেন, ‘ভাইজানরে কি কইস, সৌদি জ়াওয়ার মন নাই আর!’ রাকিবুল অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকাতেই হালিমা প্রথম প্রহরেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ‘কাজ-কাম না করে গাঁয়ে পড়ি থাইকল্যে সলবে, সংসারের একটা দায় নাই বুঝি! অনেক দিন অইল, এ বার বিলাল’রে টিকিটের ব্যবুস্থা করতি বল।’
বিলালের হাত ধরেই দেড় বছর আগে মরুদেশে উড়ে গিয়েছিল রাকিবুল। এলাকায় তার ইশারাতেই কেউ উড়ে গিয়েছে বাহরিন, কেউ বা ওমান। একা সে নয়, আশপাশের গাঁ-গঞ্জ থেকে রোহন, মনিরুল, নুরুল সাত-সাতটা গাঁ-গঞ্জের ছেলেপুলে মিলে ভেসে পড়েছিল সৌদি আরব। তার পর পাসপোর্ট গচ্ছা রেখে মোটর মেকানিকের কাজ ভুলে এখন সে পাকাপাকি মরু-ছাগলের পালক!
তার জানালাহীন ঘরের সামনে হুহু মরুভূমি। আড়াই কিলোমিটার ধ্বস্ত পরিক্রমণের পরে খেজুর আর বাবলাকাঁটার জঙ্গলে ঘেরা যে চারণ ভূমি, আড়াইশো ছাগলের পিছু হেঁটে সেখানেই বাকি দিনটা কাটে
রাকিবুলের। একটা আধ ভেজা জলা। খানিক ছড়িয়ে থাকা ছায়া, আর উত্তুঙ্গ হাওয়া। আকাশ ফুঁড়ে নেমে রোদ্দুর থেকে নিজেকে আড়াল করতে ওই ছায়াটুকুর পিছু হাঁটে রাকিবুল। দু’মুঠো ভাত আর ৭ দিন অন্তর নামিয়ে যাওয়া ইসুজু ট্রাক বোঝাই আনাজ থেকে যেটুকু বাঁচিয়ে রাখতে পারে, তা দিয়েই মশলাহীন ঝোল— তার দিনযাপন।
রাতের আকাশে নক্ষত্র গোনে রাকিবুল। কখনও উল্কা পতনের মতো ভুউস করে ভেসে ওঠে রামডোবার ধানি মাঠের কোল ঘেঁষা জলা-বক-উলুখাগড়ার কাদামাটি ভাঙা রাস্তাটা। রোদ পোড়া বালির গন্ধটুকু ছেঁকে সেই সব কল্পরাতে মায়ের কাছে পৌঁছে যায় রাকিবুল...‘কত দিন পরে এলি বাবা, আয় দেহি শরীলটা এক্কারে হুকাইয়া গ্যাসে যে...খাও নাই কিস্যু নাহি!’
মা-হারা রাতের সেই কল্পনাটা সে দিন সকালে মুড়ির বাটির উপরে যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ে— ‘কি ঠিক করল্যা, জ়াবা কবে!’ মায়ের কথাটা যেন মরু-হাওয়ার মতো পাঁজরে ধাক্কা দেয়! প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল বের করে রাকিবুল, অভিমানি আঙুলে খুঁজে বেড়ায় বিলালের নম্বর।
দিন সাতেক পরে, বিমানের রিয়ার হুইল ভূখন্ডের শেষ ধুলো ছুঁয়ে ভেসে পড়তে রাকিবুল বিড় বিড় করে, ‘তুমার কাসে আর ফিরুম না মা, পাক্কা....’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy