ভাগচাষিদের একটা বড় অংশ ওই সব প্রকল্পের সুবিধার বাইরে থাকেন। ফাইল ছবি
এত প্রকল্প থাকতেও মহাজন বা মাইক্রো-ফিনান্স গ্রুপের ঋণের ‘ফাঁদ’ থেকে বেরোতে পারছেন না কেন চাষিরা? প্রশাসনের দাবি, সরকারি প্রকল্পের সুবিধা পেতে গেলে চাষের জমির বৈধ পরচা, ভোটার কার্ড, আধার কার্ড ও নিজের নামে ‘আপডেট’ করা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে। ভাগচাষিকে সে সুবিধা পেতে হলে, পরচায় তাঁর নামের উল্লেখ থাকতে হবে। সেখানে কী চুক্তিতে ভাগ চাষ হচ্ছে, তার উল্লেখও থাকতে হবে।
কিন্তু ‘কৃষকবন্ধু প্রকল্প’ শুরুর প্রথম দিকে বা তারও আগে, রেকর্ড-ভুক্ত ভাগচাষি থাকলেও, বর্তমানে জমির মালিকদের একটা বড় অংশ ভাগচাষিদের বৈধ নথিপত্র দেন না বলে অভিযোগ। চাষ হয় মৌখিক চুক্তিতে। সে জন্য ভাগচাষিদের একটা বড় অংশ ওই সব প্রকল্পের সুবিধার বাইরে থাকেন। জমি-মালিকদের একাংশও আবার ঠিকঠাক পরচা না থাকায় প্রকল্পের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ রাজ্যের বেশির ভাগ জমি পৈতৃক সূত্রে পাওয়া। পরচায় নাম পরিবর্তনে ‘ঝক্কি হবে’ ভেবে অনেকে আগ্রহী হন না। শরিকি সমস্যাতেও অনেকের জমির নথি ঠিক করানো নেই। কৃষি দফতরের দাবি, আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি কৃষক এ ব্যাপারে সচেতন হয়েছেন। তবে পূর্ব বর্ধমানের কালনা এবং রায়নায় সম্প্রতি অপমৃত তিন চাষি—মানিক শেখ, জয়দেব ঘোষ এবং গণেশনারায়ণ ঘোষের পরিজনদের দাবি, নথিপত্রজনিত সমস্যা থাকায় ওই তিন জন সরকারি প্রকল্পের সুবিধা নেননি। শস্যবিমাও করাননি।
‘কিসান ক্রেডিট কার্ড’ থাকলে ব্যাঙ্ক বা সমবায় থেকে সহজে কম সুদে ঋণ পাওয়ার কথা। ১ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে, সম্পত্তি বন্ধক রাখতে হয় না। কিন্তু ‘কিসান ক্রেডিট কার্ড’ পেতেও নিজের নামে জমির পরচা থাকা বাধ্যতামূলক।
মৌখিক চুক্তি করা ভাগচাষিরাও সমবায় থেকে ‘জয়েন্ট লায়াবিলিটি গ্রুপ’ হিসাবে ঋণ পেতে পারেন। ব্লকের তিন সদস্যের কমিটি তাঁকে ‘চাষি’ হিসাবে লিখে দিলে তবেই তা সম্ভব। সে জন্য চাষিকে সমবায়ের সদস্য হতে হয়। কিন্তু বর্তমানে অধিকাংশ সমবায়ের বোর্ড না থাকায়, সদস্য পদ দেওয়া বন্ধ। অভিযোগ, সমবায়ের কোনও আধিকারিক বা কর্মী ঝুঁকি নিয়ে ‘জয়েন্ট লায়াবিলিটি গ্রুপ’ তৈরি করতে চান না। সমবায়ের আধিকারিকদের দাবি, ওই ‘গ্রুপ’ তৈরি করে ঋণ দেওয়া বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। সে ক্ষেত্রে ঋণ অনাদায়ী থাকার সম্ভাবনা বাড়ে। আবার ব্লকের তিন সদস্যের কমিটিও ন্যূনতম নথি ছাড়া, ‘চাষি’ বলে স্বীকৃতি দিতে চায় না।
চাষির সঙ্গে জমি-মালিকের লিখিত চুক্তি না থাকার প্রধানত দু’টো কারণ মিলেছে। প্রথমত, পর পর তিন বছর কোনও ব্যক্তি একই জমিতে ঠিকা চাষ করার প্রমাণ দেখাতে পারলে, তিনি ওই জমি বর্গা করার জন্য আবেদন করতে পারেন। তাই ‘লেখাপড়া’ করে ঠিকা দিতে চান না জমি-মালিক। দ্বিতীয়ত, জমির মালিক স্বল্প সুদে ‘কিসান ক্রেডিট কার্ড’-এ ঋণ নিয়ে সে টাকা স্থায়ী আমানত বাবদ জমা করলেও মেয়াদ শেষে সুদ মিটিয়ে লাভবান হবেন। আবার ওই জমি মৌখিক চুক্তিতে চাষ করতে দিয়েও ভাড়া বাবদ চাষির কাছ থেকে মোটা টাকা তিনি পাচ্ছেন। ‘কিসান ক্রেডিট কার্ড’-এ বার্ষিক চার শতাংশ সুদে টাকা নিয়ে ঠিকা চাষিদের মধ্যে বার্ষিক ৬০ শতাংশ হারে তা খাটানোর কথা শোনা যায় অনেক চাষির মুখে। প্রশাসনের এক কর্তার মন্তব্য, ‘‘মৌখিক চুক্তির চাষিরা সংগঠিত নন। তাঁদের নিয়ে এ সব সমস্যার সমাধানে রাজনৈতিক আন্দোলনও চোখে পড়েনি।’’
এ ছাড়া, শস্যবিমা করানো থাকলে, চাষে প্রাকৃতিক কারণে ক্ষতি হলে, সে বাবদ টাকা জমির মালিকের ঘরেই ঢোকে, আসল চাষির কপালে কিছুই জোটে না বলে দীর্ঘদিনের অভিযোগ। সে সমস্যা মেটাতে রাজ্য সরকার নতুন নিয়ম করেছে, জন প্রতিনিধির কাছ থেকে চাষির শংসাপত্র পেলে, শস্যবিমা করানো যাবে। কিন্তু সে সংক্রান্ত প্রচারেও ‘ফাঁক’ রয়েছে বলে অভিযোগ।
রাজ্যের মুখ্য কৃষি উপদেষ্টা তথা তৃণমূল বিধায়ক প্রদীপ মজুমদারের অবশ্য দাবি, “রাজ্যে ২০ লক্ষ ভাগচাষি ‘কৃষকবন্ধু’ প্রকল্পের আওতায় রয়েছেন। চাষ করলেই শস্যবিমা করানোর সুযোগ রয়েছে। কিসান ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়ার সুযোগ আছে। তার পরেও কেউ কেউ লোভের বশবর্তী হয়ে অন্য সংস্থা থেকে ঋণ নিচ্ছেন।’’
কৃষকসভার দাবি, সরকারি নিয়মের বাধাতেই বাধ্য হয়ে চাষিদের ‘মাইক্রো-ফিনান্স’ সংস্থা বা মহাজনের থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে চাষ করতে হচ্ছে। এ নিয়ে রাজ্যে ৩৩৬টি সভা করে কৃষকদের ‘মাইক্রো-ফিনান্স গ্রুপ’-এর ঋণের ‘ফাঁদ’ সম্পর্কে তারা সচেতন করেছে বলে দাবি সংগঠনের। সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক অমল হালদার বলেন, “সমবায়গুলি নিষ্ক্রিয়। সে সুযোগে ‘মাইক্রো-ফিনান্স’ সংস্থাগুলি ও মহাজনেরা গ্রামে-গঞ্জে জাল বিছিয়েছে। প্রান্তিক চাষিদের পালানোর পথ নেই।’’ তৃণমূলের কিসান-খেতমজুর সংগঠনের রাজ্য সভাপতি পূর্ণেন্দু বসু বলেন, “মাইক্রো-ফিনান্স থেকে নেওয়া ঋণের সমস্যা সম্পর্কে চাষিদের সচেতন করার জন্য সাংগঠনিক ভাবে প্রতিটি জেলাকে বলব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy