শেষ বেলায় হঠাৎ সক্রিয় সুশান্তরঞ্জন!
তবে এমন একটা সময়ে, যখন আর ভুল সংশোধনের বিশেষ অবকাশ নেই। কিন্তু প্রিসাইডিং অফিসার এবং পর্যবেক্ষক যে তাঁকে ভুল পথে চালিত করার চেষ্টা করেছেন, সেটা তিনি শেষ বেলায় রেকর্ড করিয়ে রাখলেন। আর সেই সব রাজ্য সরকারি অফিসারের সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। দেড় হাজারের কাছাকাছি।
বৃহস্পতিবার রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায় ঝুলি খুলতেই বেরিয়ে পড়ল বেড়াল। কী বললেন তিনি?
অসহযোগিতা
সুশান্তরঞ্জন বৃহস্পতিবার বলেন, কলকাতা পুরসভার ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পরে ১ হাজার ৪১৫ জন প্রিসাইডিং অফিসার কমিশনকে এসএমএস করে কত শতাংশ ভোট পড়েছে তা জানাননি। সে জন্য মোট কত ভোট পড়েছে, তা নিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশনারেরই কোনও পরিষ্কার ধারণা ছিল না। শনিবার রাতে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার জানিয়েছিলেন ভোট পড়েছে ৬২.৪ শতাংশ। ৪৮ ঘণ্টা পরে সব
প্রিসাইডিং অফিসারের রিপোর্ট পাওয়ার পরে ভোটদানের হিসেব বেড়ে হয় ৬৮.৬৯ শতাংশ।
কমিশন সূত্রের খবর, কলকাতা পুরসভা নির্বাচনে নিযুক্ত ছিলেন ৪ হাজার ৭০৪ জন প্রিসাইডিং অফিসার। অর্থাৎ ৩০% প্রিসাইডিং অফিসার কমিশনের সঙ্গে পুরোপুরি সহযোগিতা করেননি।
দাওয়াই
ভোট গ্রহণ পর্ব মিটে যাওয়ার পরে যে ১ হাজার ৪১৫ জন প্রিসাইডিং অফিসার কমিশনকে ভোট দানের হিসেব এসএমএস করে জানাননি, তাঁদের কৈফিয়ৎ তলব করেছেন সুশান্তরঞ্জন। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তাঁদের জবাব দিতে হবে। কলকাতা পুরসভা নির্বাচনের ভারপ্রাপ্ত অফিসার দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসককে ওই প্রিসাইডিং অফিসরাদের কাছে তাঁর নির্দেশ পৌঁছে দিতে বলেছেন সুশান্তরঞ্জন।
রিপোর্টে ভিন্ন
সুশান্তরঞ্জন বলেন, দু’জন প্রিসাইডিং অফিসার তাঁকে ফোনে বুথ দখলের রিপোর্ট দিয়েও শেষ পর্যন্ত তাঁদের ডায়েরিতে তা লেখেননি। দু’জন পর্যবেক্ষকও তাঁকে কয়েকটি বুথে গোলমালের কথা টেলিফোনে জানিয়েছিলেন। কিন্তু পরে তাঁরা কেউই ওই সব ঘটনা নিয়ে সবিস্তার কোনও রিপোর্ট তাঁকে দেননি।
ওই চার অফিসারের মৌখিক রিপোর্ট এবং অন্যদের রিপোর্টের ভিত্তিতেই শনিবার ‘আদর্শ পরিবেশে’ ভোট হয়নি বলে মন্তব্য করেছিলেন সুশান্তরঞ্জন। দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসকের রিপোর্ট পাওয়ার পরে তিনি দেখেন, ওই দুই প্রিসাইডিং অফিসার তাঁদের ডায়েরিতে ভোট ব্যাহত হওয়ার প্রসঙ্গই তোলেননি। এর জন্য লোক সমক্ষে তাঁকে হেনস্থা হতে হয়েছে বলে ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছেন সুশান্তরঞ্জন। রাজ্যপালকেও বুধবার তিনি সে কথা জানিয়ে এসেছেন।
দাওয়াই
যে দু’জন প্রিসাইডিং অফিসার ফোনে বুথ দখলের অভিযোগ জানালেও ডায়েরিতে উল্লেখ করেননি, তাঁদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন সুশান্তরঞ্জন। ৬৫ ওয়ার্ডের ২৬ নম্বর বুথ এবং ১৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের ৩২ নম্বর বুথের দায়িত্বে ছিলেন ওই দুই প্রিসাইডিং অফিসার।
যে দুই জন পর্যবেক্ষক ফোনে গণ্ডগোলের কথা জানিয়েও রিপোর্টে তার সবিস্তার উল্লেখ করেননি, তাঁদেরও কারণ দর্শানোর চিঠি পাঠিয়েছেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার। সেই চিঠিতে বলা হয়েছে, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তাঁদের জানাতে হবে ওই সব বুথে ঠিক ক’টায়, কী ধরনের গণ্ডগোল হয়েছিল, সেখানে পর্যবেক্ষক কখন পৌঁছেছিলেন, তিনি কী ব্যবস্থা নিয়ে ছিলেন এবং কত ক্ষণ গণ্ডগোল চলেছিল। ওই দু’ জনের মধ্যে এক জন ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্বে ছিলেন। ওই ওয়ার্ডের সিপিএম প্রার্থী সিপিএমের রূপা বাগচী।
ওয়েবক্যাম
রাজ্য নির্বাচন কমিশনার জানিয়েছেন, একটি বুথে ওয়েবক্যাম ভেঙে দেওয়া হয়েছে এবং চারটি বুথে তার মুখ ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে নির্বাচনের দিন নিজের অফিসে বসে তিনি দেখেছেন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট প্রিসাইডিং অফিসারেরা তাঁদের ডায়েরিতে লিখেছেন, ওই সব ক্যামেরা কাজ করেনি। কলকাতা পুরসভা নির্বাচনের ভারপ্রাপ্ত অফিসার দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসক তাঁর রিপোর্টে প্রিসাইডিং অফিসারদের সেই তথ্যই তুলে ধরেছেন।
দাওয়াই
ওই সব ওয়েবক্যামের ক্ষেত্রে কী ঘটেছিল, তা নিয়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসককে ফের নতুন করে রিপোর্ট দিতে বলেছেন সুশান্তরঞ্জন। যে সংস্থা ওই সব ক্যামেরা সরবরাহ করেছিল, তাদের কাছ থেকেও পৃথক রিপোর্ট তলব করেছেন তিনি। দুটি রিপোর্ট মিলিয়ে দেখে পরবর্তী ব্যবস্থা ঠিক করবেন নির্বাচন কমিশনার।
৩২ নম্বরে রহস্য
সিপিএম প্রার্থী রূপা বাগচী কমিশনকে অভিযোগ করেছেন, ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের ২৫ নম্বর পার্টে মোট পুরুষ ভোটার ৩৬৭ জন হলেও ১৮ এপ্রিল ৩৮৪ জন পুরুষ ভোট দিয়ে গিয়েছেন।
দাওয়াই
এ ব্যাপারেও দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসককে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলেছেন নির্বাচন কমিশনার। তিনি বলেন, পুরনো রিপোর্টের সঙ্গে নতুন রিপোর্টের ফারাক থাকলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বেশি ভোট
সুশান্তরঞ্জন এ দিন বলেন, কলকাতায় বেশ কিছু বুথে ৯১ থেকে ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত ভোট পড়েছে। কলকাতায় এত বেশি ভোট পড়ার বিষয়টি অস্বাভাবিক বলে মনে হয়েছে তাঁর। এই সংক্রান্ত পুরো তালিকা কমিশন তৈরি করেছে।
দাওয়াই
তবে বিষয়টি নিয়ে খতিয়ে দেখার জন্য এখনই কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। তবে কোনও রাজনৈতিক দল অভিযোগ করলে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে তা ঠিক করবে কমিশন।
একেবারে শেষ মুহূর্তে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার এই ফোঁস করাটা স্রেফ আনুষ্ঠানিক এবং ‘নতুন নাটক’ বলে মন্তব্য করেছে বিরোধীদের অনেকেই। বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেন, ‘‘রিপোর্ট তলব, কারণ দর্শানোর নোটিশ— এ সব তো আগেই করা উচিত ছিল। কারণ, ভোটের দিনেই তিনি রিগিং-সন্ত্রাসের কথা বলেছিলেন। এখন চাপে পড়ে তা করছেন। নবান্নের চাপে কালই হয়তো ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যাবেন!’’
সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম বলেন, ‘‘ভোটের দিন কী হয়েছে তা সবাই দেখেছে। এত দিন পরে নির্বাচন কমিশন যেটা করছে সেটা নিজেদের মুখ রক্ষার জন্য। একটা অন্যায় ঢাকতে ফের অন্যায় করছে। রাজ্য নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা বলে কিছু নেই।’’
প্রদেশ কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়া মনে করেন, পুর নির্বাচন নিয়ে প্রহসন চলছে। তিনি বলেন, ‘‘এখন কমিশনার জেলাশসকের কাছে নতুন করে রিপোর্ট তলব করে, শো-কজ করে অর্ধ-সাহসিকতা দেখাচ্ছেন। কিন্তু যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে।’’
দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসক শান্তনু বসু জানিয়েছেন, নির্বাচন কমিশনার যে সব বিষয়ে রিপোর্ট চেয়েছেন, তা আবার দেওয়া হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy