পঞ্চমীর বিকেলে শেষ মুহূর্তের কেনাকাটা এবং মণ্ডপ দেখতে গড়িয়াহাটে জনজোয়ার। ছবি: সুমন বল্লভ।
অকালবোধন, তবু দেবী আসেন সময় মেনেই। কিন্তু তাঁর ভক্তেরা সময়ের দাবি মানছেন কই! করোনা-কবলিত সময়ের দাবি, আত্মনিয়ন্ত্রণ। যথাসম্ভব আপন আশ্রয়ে নিজেকে রক্ষা করা, চতুষ্পার্শ্বের মানুষজনকে তাঁদের আস্তানায় রক্ষার ব্যবস্থা করা। কিন্তু কোথায় কী? রবিবার, পঞ্চমীতেই দেখা গেল, দেবীর বোধনের আগেই কলকাতার পুজোয় ভিড়ের বোধন যেন সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছে!
অতিমারির মধ্যে বেপরোয়া ভিড় দেখে উদ্যোক্তা-পুজোকর্তাদের একাংশও রীতিমতো আতঙ্কিত! দক্ষিণ কলকাতার শিবমন্দিরের অন্যতম পুজোকর্তা পার্থ ঘোষ বলছেন, “এই পরিস্থিতিতে পঞ্চমীর সন্ধ্যায় এমন ভিড় হবে ভাবিনি।” পুজোকর্তাদের অনেকে বলছেন, অনেকেরই দেখছি মাস্ক পরতে বড্ড অনীহা! বার বার বলা সত্ত্বেও কোনও লাভ হচ্ছে না। এই বিধিবিমুখ ভিড়ে লাগাম দেবে কে!
পঞ্জিকা মেনে মাতৃপুজো এ দিন শুরু না-হলেও উৎসব শুরু হয়ে গিয়েছে। উত্তর শহরতলিতে এক মন্ত্রীর পুজোয় উপচে পড়া ভিড়। তা নিয়ে সমাজমাধ্যমে হরেক কিসিমের টীকাটিপ্পনীও চলছে। রবিবার তার সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল শেষ বেলার পুজোর বাজার। সব মিলিয়ে শুধু কলকাতা নয়, বিভিন্ন জেলা শহরের পথেঘাটেও ঠাসাঠাসি ভিড়।
চতুর্থীর গভীর রাতেও কলকাতার নানা প্রান্তে ব্যাপক ভিড় বিভিন্ন মণ্ডপে। মাস্কহীন ভিড় দেখে দক্ষিণ কলকাতার এক সত্তরোর্ধ্ব পুজোকর্তা মণ্ডপ ছেড়ে বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েছিলেন। বললেন, “ওই ভিড় দেখে নিজেরই কেমন ভয় লাগছিল।” রবিবার বিকেলে হাতিবাগান এলাকার এক পুজো মণ্ডপের সামনে দুই দর্শককে মাস্ক পরতে বলায় তাঁরা রীতিমতো তেড়ে গেলেন দুই স্বেচ্ছাসেবকের দিকে। তবে পুজো কমিটির সদস্যেরা কড়া হাতেই মোকাবিলা করেছেন। মাস্ক না-থাকায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে ওই যুগলকে। পুজো কমিটির লোকেরা বলছেন, বিনামূল্যে মাস্ক দিতে চাইলেও প্রত্যাখ্যান করছেন অনেক দর্শক!
একই ছবি জেলায় জেলায়। উত্তর থেকে দক্ষিণবঙ্গ— ভিড়ের গুঁতোয় কোভিড বিধি না-মানার ছবি উঠে এল প্রায় সর্বত্রই। দেখেশুনে মনে হতে পারে, করোনা বলে কিছু নেই, ছিলও না যেন কোনও দিন! আমবাঙালির সচেতনতার বহর দেখে বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসক মহল শঙ্কিত। বিশেষ করে রাজ্যের দৈনিক করোনা সংক্রমণ যখন প্রায় রোজই সাতশো পার করছে।
কোচবিহারের ভবানীগঞ্জ বা শিলিগুড়ির শেঠ শ্রীলাল মার্কেট, মালদহের বাজারে সকাল থেকেই ক্রেতার ভিড়। পরে বড় বাজেটের এবং ঐতিহ্যবাহী পুজো মণ্ডপে ভিড় হয় শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ির মতো শহরে। বিভিন্ন জায়গায় কোভিডি বিধি না-মেনেই ভিড় জমানোর অভিযোগ ওঠে। তবে বিভিন্ন পুজো মণ্ডপ থেকে কোভিডি বিধি মেনে চলার আবেদন, সতর্কবার্তাও প্রচার করা হয়।
বর্ধমানের দোকান-বাজারে এ দিন আশপাশের গ্রামাঞ্চল থেকে বহু মানুষ পুজোর কেনাকাটা করতে এসেছিলেন। ভিড় উপচে পড়ে আসানসোল ও দুর্গাপুরের বিভিন্ন বাজারেও। মাস্ক ছাড়াই সেই হুড়োহুড়ি ভিড়ে পরস্পরের গায়ে হামলে পড়েছেন ক্রেতারা। পরে মণ্ডপেও ভিড়। বাঁকুড়া শহরের বিভিন্ন বাজার থেকে পুরুলিয়া শহরের কাপড়গলি, সর্বত্রই থিকথিকে ভিড়। সন্ধ্যার পরে বহরমপুরের প্রতিটি রাস্তার দখল নেয় পুজো দেখতে বেরোনো ভিড়। ভার্চুয়ালি এ দিন শহরের দু’টি পুজোর উদ্বোধন করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। স্ক্রিনে তা দেখতে এলাকার বাসিন্দারা কার্যত হামলে পড়লেও পুলিশ তা নিয়ন্ত্রণ করে। ঠাকুর দেখার ভিড়ও বাড়তে শুরু করেছে মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, দাসপুর, খড়্গপুরে। তবে সরকারি নির্দেশিকা মেনে উদ্যোক্তারা মণ্ডপের প্রবেশপথে ‘নো এন্ট্রি লেখা বোর্ড ঝুলিয়েছেন।
সব দেখেশুনে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক শুভ চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘পুজোর আগে ফের করোনা সংক্রমণের হার বেড়ে চলেছে। এখন বেপরোয়া মনোভাব আবার বিপদ ডেকে আনতে পারে।’’
পশ্চিম মেদিনীপুরের বানভাসি ঘাটালে অনেক মণ্ডপেই কাজ চলছে এখনও। পুজোর জৌলুস নেই পূর্ব মেদিনীপুরের বেশির ভাগ পুজোতেও। ভগবানপুর, পটাশপুর, পাঁশকুড়ার বিস্তীর্ণ বন্যাবিধ্বস্ত এলাকায় পুজো হচ্ছে নমো নমো করে। নদিয়াতেও পঞ্চমীর চেনা ভিড় দেখা যায়নি। বেশির ভাগ মণ্ডপই ছিল ফাঁকা।
কিন্তু এ দিন সন্ধ্যা থেকে উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁ, বসিরহাট, বারাসত মহকুমার বিভিন্ন এলাকায় মানুষ পুজো মণ্ডপে আসতে শুরু করেছেন। মণ্ডপগুলিতে ভিড় না-হলেও মানুষ দলে দলে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছেন। বেশির ভাগেরই মাস্কের বালাই নেই। জামাকাপড়ের দোকানে, রেস্তরাঁয় ভিড় উপচে পড়েছে। নেই পারস্পরিক দূরত্ব-বিধি। পুলিশি পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। তবে তুলনায় কম ভিড় হয়েছে হাওড়ায়। বাগনান, উলুবেড়িয়া, বাউড়িয়ার মণ্ডপগুলিতে তেমন ভিড় ছিল না। পুজোর উদ্বোধনেও কোভিড বিধি পালন করতে দেখা গিয়েছে।
অন্যান্য বছরের মতো এ বার শ্রীরামপুর, চুঁচুড়ার নামী পুজোর মণ্ডপে পঞ্চমী থেকে লাইন পড়েনি। তবে রাস্তাঘাটে, বিশেষত বাজার এলাকায় ভিড় উপচে পড়ে। দূরত্ব-বিধির নিষেধাজ্ঞা নেই। অনেকে মাস্কও পরেননি।
আজ, ষষ্ঠী। দেবীর বোধন। ভিড় উত্তরোত্তর বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অনেকেই বলছেন, গত বছরের কোভিড পরিস্থিতিতে ষষ্ঠী থেকেই অনেক সংযত হয়েছিলেন মানুষজন। এ বার কি তেমনটা হবে?
হলে বাঁচোয়া। কিন্তু না-হলে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy