ছবি পিটিআই।
আভূমি প্রণামটুকু সেরেই বাবার থেকে দূরে সরে দাঁড়ালেন ছেলে। সবিনয় বললেন, ‘‘কোলাকুলিটা এ বার বন্ধই থাক! তুমি বাড়িবন্দি, আমি তো মাঝেমধ্যে বেরোই! না-হয় আসছে বছর...!’’
‘নিউ নর্ম্যাল’ এ বিজয়ার রীতি মনেমনে সয়ে নিয়েছেন অনেকেই। তবে বাধ সাধছে অন্য জায়গায়! নবমীর সকাল কিংবা নবমী নিশির রাত ১২টায় ‘শুভ বিজয়া’ সম্ভাষণের হোয়াটসঅ্যাপ-সংস্কৃতি এল কোথা থেকে? সোশ্যাল মিডিয়ার বচ্ছরকার রসিকতার মেজাজটুকু তাই অটুট দশমীর সকালেও। ‘এত তাড়া কিসের! ঠাকুরকে জলে পড়তে দিন অন্তত...!’
নানা বদলের পুজোতেও ভাসানের আগে ‘শুভ বিজয়া’ সম্ভাষণটা অনেকেই মানতে পারেন না। শুভেচ্ছার চাপে কেউ কেউ পাল্টা ঠাট্টারও রাস্তা নিয়েছেন। প্রবীণ পুরোহিত শম্ভুনাথ স্মৃতিতীর্থ হাসছেন, ‘‘সবটাই অনুভব আর ঔচিত্যবোধ। ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ বলার কায়দায় কেউ যদি নবমীর রাত ১২টায় ‘শুভ বিজয়া’ বলেন তখন একটু বিষম লাগে কিন্তু!’’ কিন্তু ‘শুভ বিজয়া’, প্রণাম, কোলাকুলি সবই তো লোকাচার। কেউ বাড়ির ঠাকুর ভাসানের পরে ছেলেরা গঙ্গা থেকে ফেরা অবধি দালানে শান্তিজলের অপেক্ষা করেন! তার আগে বিজয়া হবে না! কোনও বাড়িতে পাড়ার পুজোর ভাসানের পরে আগে আমপাতায় ‘শ্রীদুর্গা সহায়’ লেখা হবে। কেউ আবার দশমী পড়লেই কোলাকুলিময়! নবদ্বীপের পুরোহিত সুশান্ত ভট্টাচার্য আবার বলছেন, ‘‘দশমীর পুজোর শেষপর্বে অপরাজিতা পুজোর রীতি। হাতে অপরাজিতা ধারণ করে জীবনযুদ্ধে বিজয় লাভের সঙ্কল্প নরনারীর। তার আগে কিসের বিজয়া!’’
আরও পড়ুন: উৎসবের কারণে পশ্চিমবঙ্গে সংক্রমিতের সংখ্যা বেড়েছে: কেন্দ্র
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, আজকের ‘গ্লোবাল বাঙালির’ পক্ষে কি এত ঝকমারি মেনে চলা পোষায়?
বাংলার শারদোৎসব শুরুর আগের শনি-রবিতেই বিলেত-আমেরিকার অনেক পুজো ‘বিজয়া-সম্মিলনী’ সেরে ফেলেছে। সেখানে অফিসের নির্ঘণ্টই আসল। তবে নবমীতে
সাহেবি রীতিতে সম্ভাষণ সেরে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হবে! প্রাক্তন আইএএস-কর্তা তথা ধর্মসংস্কৃতি বিষয়ক প্রাবন্ধিক জহর সরকারের মতে, ‘‘সব লোকাচারই অবস্থার ফেরে যুগে যুগে পাল্টায়। ইউরোপের উত্তরে অনেক দেশে বছরের কিছু সময়, সূর্য অস্তই যায় না! সেখানে রমজানের সময়ে ইফতার, সেহরির সময় বুঝতেও সমস্যা। কেউ কেউ মক্কার সঙ্গে ঘড়ি মিলিয়ে নেন।’’ আগে হয়তো গ্রামের পুজোর ভাসানের পরে বিজয়া সারা হতো। এখন আর সবার জন্য নির্দিষ্ট পুজো কই! তাই দশমী পড়ার আগেই কারও অগ্রিম বুকিংয়ের বন্দোবস্ত। যেমন, একদা ইলাহাবাদ বা জামতাড়ায় জ্ঞাতিগুষ্টিকে বিজয়ায় চিঠি পাঠাতে অনেকেই ষষ্ঠী বা সপ্তমীতেই পোস্টকার্ড ফেলতেন। তা ছাড়া, কোলাকুলি, প্রণামের রীতিও কি চিরকালীন? শারদোৎসবে দশমীতে বিজয়া-পর্ব থাকলেও বাসন্তী পুজোর নবরাত্রি শেষে কিন্তু বিজয়া হয় না। জহরবাবু বা বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরে দর্শনের শিক্ষক শামিম আহমেদ মনে করাচ্ছেন, কোলাকুলি সেমিটিক সংস্কৃতি থেকে আহৃত। এ দেশে সম্ভবত ইদের আলিঙ্গনেই তার প্রেরণা মিশে।
আরও পড়ুন: ভিড়ের দায় কার, ঠেলাঠেলি পুজো শেষেও
বিসর্জনের প্রাক্কালে শোকসন্তপ্ত মথুরবাবুকে রামকৃষ্ণ বুঝিয়েছিলেন, দেবীকে বিসর্জন তো নিজের হৃদয়ে দেবে! বিশ্ব থেকে চিত্তপটে দেবীত্ব উদ্বোধনের সেই মনটা কি শুভেচ্ছা-হিড়িকে চাপা পড়ল? জটিল সময়ে সে প্রশ্নটুকু থেকেই যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy