শেষ কয়েক দিনে রাজ্যে দৈনিক করোনা সংক্রমণের সংখ্যা নেমেছে ১০০-ঘরে। গত শনিবার ও সোমবার করোনাতে কলকাতায় এক জনেরও মৃত্যু হয়নি।
আপাতদৃষ্টিতে রাজ্যে করোনার প্রভাব কম। যদিও চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, এখনই ওই অচেনা শত্রুকে দুর্বল ভাবার কোনও কারণ নেই। তাঁরা বলছেন, ‘‘অসতর্ক মুহূর্তেই শত্রু বেশি আক্রমণ করে। তাই এখনও করোনার বিষয়ে সতর্কতা মেনে চলতেই হবে।’’
যদিও শহর থেকে জেলায় সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশের মধ্যে ঢিলেঢালা ভাব এসেছে বলে অভিযোগ। সত্যিই কি তাঁরা সতর্কতা মেনে চলছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বিস্তর। অধিকাংশ জায়গাতেই দেখা যাচ্ছে, মুখে মাস্ক নেই, থাকলেও তা থুতনিতে ঝুলছে। লোকাল ট্রেন থেকে মেট্রো —সমস্ত গণ-পরিবহণেই এখন ঠাসাঠাসি করে যাত্রীরা যাতায়াত করছেন। অভিযোগ, আসন্ন নির্বাচনের আগে রাজনীতির ময়দানে কোনও সভা-সমাবেশ কিংবা মিছিল—কোথাও মানা হচ্ছে না দূরত্ব বিধি।
কিন্তু তা সত্ত্বেও সংক্রমণের হার কম কেন? ক্লিনিক্যাল ফার্মোকোলজির বিশেষজ্ঞ শান্তনু ত্রিপাঠী জানান, প্রতিকুল পরিস্থিতিতে ব্যাক্টেরিয়া কিংবা ভাইরাসের মত জীবানুগুলোর অস্তিত্ব বিপন্ন হলে প্রাকৃতিক নিয়মেই তারা নিজেদের মধ্যে কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসে। আর সেই পরিবর্তন তাদের সংক্রমণ ক্ষমতা অথবা রোগের তীব্রতা কমিয়ে দিতে পারে। তখন রোগের উপসর্গ বোঝা যায় না। শান্তনুবাবু বলেন, ‘‘উপসর্গ না থাকলে আরটিপিসিআর টেস্ট করানো হয় না, তার ফলে রোগ ধরাও পড়ে না। সুতরাং, আরটিপিসিআর পজিটিভ রিপোর্ট কম হচ্ছে মানেই রোগের সংক্রমণ কম হচ্ছে ধরে নেওয়ার কারণ নেই। এখনও করোনা-বিধিগুলি মেনে চলতেই হবে। পাশাপাশি সকলকেই প্রতিষেধকও নিতে হবে।’’
উপসর্গহীনদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় কত জন সংক্রমিত হচ্ছেন, তা বোঝা যাচ্ছে না — জানাচ্ছেন আরজিকর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান চিকিৎসক জ্যোর্তিময় পালও। তাঁর কথায়, ‘‘কিছুটা হার্ড ইমিউনিটি হয়েছে বলেও সংক্রমণ ছড়াচ্ছে কম। কিন্তু এখনও গণ টিকাকরণ শুরু হয়নি। তাই প্রতিষেধকের কৃতিত্বেই সংক্রমণের হার কমছে সেটাও পুরোপুরি বলা যাচ্ছে না। যতক্ষণ পর্যন্ত না সকলের প্রতিষেধকের দুটি ডোজ় নেওয়া সম্পূর্ণ হচ্ছে ততক্ষন অতিমারি পর্ব কেটে গিয়েছে, সেটা বলার জায়গায় আমরা নেই।’’
‘হার্ড ইমিউনিটি’ তৈরির বিষয়ে এখনই সুনির্দিষ্ট ভাবে কিছু বলা সম্ভব নয় বলেই মত রাজ্যের কোভিড কেয়ার নেটওয়ার্কের উপদেষ্টা চিকিৎসক অভিজিৎ চৌধুরীর। তিনি জানাচ্ছেন, কেরল ও মহারাষ্ট্র ছাড়া সারা দেশেই সংক্রমণের হার কমেছে। বিগত দিনে কয়েকটি উৎসব পালন হওয়ার পরেও, রাজ্যে সংক্রমিতের সংখ্যা বাড়েনি। বরং কমের দিকে। কিন্তু তাতে এখনই উচ্ছ্বাসের কোনও জায়গা নেই বলেও মত তাঁর। তিনি বলেন, ‘‘উৎসব পালন হলেও, মানুষ দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন। আর সামগ্রিক ভাবে করোনার চিকিৎসার পদ্ধতির উন্নয়নও মৃত্যুর সংখ্যা কমার কারণ। তবে সতকর্তা এখনও দরকার।’’
রাজ্যে গত ৫ ফেব্রুয়ারি আক্রান্ত হয়েছেন ১৯৪ জন, মৃত ২ জন। ৬ ফেব্রুয়ারি আক্রান্ত ১৯৭ জন, ওই দিন দক্ষিণ ২৪ পরগণায় এক জনের মৃত্যু হলেও, শহরে সেই সংখ্যা ছিল শূন্য। আবার ৭ ফেব্রুয়ারি আক্রান্ত ১৯৩ জন, মৃত ছিল ৫ জন। ৮ ফেব্রুয়ারি আক্রান্ত ১১৯ জন, উত্তর ২৪ পরগণা ও পশ্চিম বর্ধমানে দুই জনের মৃত্যু হলেও, শহরে সেই সংখ্যা ছিল শূন্য। রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অনির্বাণ দলুইয়ের কথায়, ‘‘আইসিএমআর একটি স্টাডি করে দেখেছিল, দেশে প্রায় ২৮ কোটি মানুষের মধ্যে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হয়েছে। আসলে একটা সময় ব্যপক হারে সংক্রমণ ছড়ানোর পরে ভাইরাসও তার নিজ শক্তি হারাতে শুরু করে। কিন্তু আইসিএমআর-ও স্পষ্ট বলেছে, এখনই বিষয়টিতে উচ্ছসিত না হয়ে সতর্কতা মেনে চলতে হবে।’’
চিকিৎসকদের পরামর্শ, ‘২০২১-ও মুখ ঢাকা থাক মাস্কেই।’