ঠাকুরমশাইরা শিখছেন দুর্গাপুজোর নিয়মকানুন, আদবকায়দা। মন্ত্রোচ্চারণ থেকে ঘট স্থাপন শেখানোর পাশাপাশি পণ্ডিতরা বলে দিচ্ছেন শাস্ত্রসম্মত ডায়েটও। নিজস্ব চিত্র।
শোভাবাজার রাজবাড়ির দালানে শতরঞ্চি বিছিয়ে চলছে পুরোহিতদের পাঠশালা। আর সেখানে ঠাকুরমশাইরা শিখছেন দুর্গাপুজোর নিয়মকানুন, আদবকায়দা। সেই শিক্ষায় মন্ত্রোচ্চারণ থেকে ঘট স্থাপন শেখানোর পাশাপাশি পণ্ডিতরা বলে দিচ্ছেন শাস্ত্রসম্মত ডায়েটও। পুজোর ক’টা দিন ঠাকুরমশাইরা কী খাবেন, কী খাবেন না সবই রয়েছে পাঠশালার পাঠ্যক্রমে।
কলকাতায় বেশ কয়েক বছর ধরেই শারদীয়ার আগে আগে এমন পুরোহিত প্রশিক্ষণের আয়োজন করে ‘সর্বভারতীয় প্রাচ্যবিদ্যা অ্যাকাডেমি’। প্রধান শিক্ষক হন ওই সংস্থার অধ্যক্ষ জয়ন্ত কুশারী। তবে এটাই একমাত্র পরিচয় নয় ‘হেড স্যার’ জয়ন্তর। তিনি শোভাবাজার রাজবাড়ির সভাপণ্ডিত। এমনটাই জানালেন প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া ঠাকুরমশাইরা। শোভাবাজার রাজবাড়িতে দুর্গাপুজো করেন একসঙ্গে ১৬ জন পুরোহিত। তাঁদের উপরে থাকেন রাজবাড়ির সভাপণ্ডিত। এই পদে জয়ন্তের নিয়োগ হয়েছিল ১৯৭৮ সালে। ইন্টারভিউ নিতে এসেছিলেন নবদ্বীপ, ভাটপাড়া আর কাশীর পণ্ডিতেরা। সেই জয়ন্তই জানালেন, দুর্গাপুজোর উপবাস মানে কিন্তু না খেয়ে থাকা নয়। তিনি বলেন, ‘‘মনে রাখতে হবে ‘উপ’ শব্দের অর্থ সমীপে। অর্থাৎ, যাঁর আরাধনা করা হচ্ছে তাঁর সমীপে বাস করা। এর সঙ্গে খাওয়া, না-খাওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই। এগুলো ‘অর্ধ শিক্ষিত’রা বলেন।’’ একই সঙ্গে জয়ন্ত বলেন, ‘‘যাঁরা পুজো দিতে আসবেন বা পুষ্পাঞ্জলি দিতে আসবেন, তাঁদের দু’দণ্ড, মানে কমপক্ষে ৪৮ মিনিট দেবীর সামনে থাকতে হয়। সেই সময়ে কোনও পরনিন্দা, পরচর্চা করাও সমীচীন নয়।’’
পুরোহিতদের পুজোপদ্ধতি নিয়ে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি খাওয়া দাওয়ার নিয়মকানুন শেখানও জরুরি বলে দাবি করেন জয়ন্ত। জানান, এটা শাস্ত্রেই বা রয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘স্মৃতিশাস্ত্রের দুর্গোৎসব তত্বে আচরণবিধির মধ্যেই খাওয়াদাওয়ার প্রসঙ্গ রয়েছে। সেটা শুধু পুরোহিতদের জন্যই নয়, যাঁরা পুজো দেবেন তাঁদের জন্যও।’’ এর পরে জয়ন্ত খাওয়াদাওয়ার যে শাস্ত্রীয় নিয়মের কথা বললেন তার সঙ্গে সুস্থ থাকার জন্য পুষ্টিবিদদের পরামর্শের অনেক মিল। পেট ভরে নয়, বার বার খেতে হবে। নিরামিষ খাওয়া মানে বেশি করে শাক, সবজি খেতে হবে। প্রোটিন জাতীয় খাবার কম। তবে সাত্ত্বিক আহারে প্রাণীজ প্রোটিন একেবারেই নয়। যদিও হিন্দুশাস্ত্র মতে নাকি দুধ খাওয়া যায়। দুগ্ধজাত খাবারকেও নিষিদ্ধ প্রাণীজ প্রোটিন বলে ধরা হয় না। ভাত কম খেয়ে ছোলা, মটর, মুগ ডাল বেশি খেতে হবে। কেন এমন নিয়ম? জয়ন্ত বললেন, ‘‘পুরহিতদের মিতাহারি হতে হবে। অতিভোজনের পরে পুজোয় বসলে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। আরও একটা বিষয় হল, একেবারে না খেয়ে বসলে গ্যাস, অম্বলের সমস্যা হতে পারে। সেটাও ঠিক নয়। সে কারণেই শাস্ত্র মেনে খাওয়াদাওয়ার কথা বলা হচ্ছে প্রশিক্ষণে।’’
প্রশিক্ষণ নিতে আসা নৈহাটির পুরোহিত সুকুমার চক্রবর্তী ক’দিনের শিক্ষাতেই খুব খুশি। তিনি বলেন, ‘‘২৭ অগস্ট থেকে রোজ আসছি। ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলবে। প্রতি দিন এমন অনেক কিছু শিখছি যা পুজো করতে বসে কাজে লাগবে। এক দিকে, যেমন মন্ত্রের সঠিক উচ্চারণ শিখছি তেমনই বিভিন্ন ক্রিয়া সম্পর্কেও সত্যিকারের জ্ঞান হচ্ছে। কেমন করে সঙ্কল্প, কেমন করে নবপত্রিকার স্নান সে সব দেখে দেখে শিখেছি। এখন শাস্ত্রমতে, কারণ জেনে শিখছি।’’ একই রকম দাবি, যাদবপুর থেকে প্রশিক্ষণ শিবিরে আসা পুরোহিত তমালরঞ্জন সিংহের। তিনি বলেন, ‘‘আচমনের সময়ে হাতে কতটুকু জল নিতে হবে কিংবা ঘটস্থাপন ঠিকে কেমন ভাবে হবে সবই শিখছি। বিভিন্ন মুদ্রাও রয়েছে পুজোর। সেগুলো হাতে ধরিয়ে শেখানো হচ্ছে। হোম করা থেকে সন্ধিপুজোর হাতেকলমে শিক্ষাও মিলছে।’’
অন্য অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা সুশান্ত ভট্টাচার্য। মূলত দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা হলেও কর্মসূত্রে বেঙ্গালুরুতে থাকেন। করেন ‘ফিনান্সিয়াল মার্কেটিং’ সংক্রান্ত কাজ। সেই সঙ্গে উপবিত কাজে লাগিয়ে ছোটখাটো পুজোও করেন। বেশিটাই দক্ষিণ ভারতের শহরে গৃহপ্রবেশ। সেখানে দুর্গাপুজোর পুরোহিতের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। তাই প্রশিক্ষণ নিতে কলকাতায় এসেছেন। সুশান্ত বললেন, ‘‘এই বছরেও দুর্গাপুজো করার অনুরোধ করেছিল একটি বারোয়ারি। কিন্তু সাহস করতে পারিনি। আসলে এ হল মহাপূজা। ঠিকঠাক না শিখে করা যায় না। মনে হচ্ছে আগামী বছর থেকে বেঙ্গালুরুতে দুর্গাপুজোও করতে পারব।’’ প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। একেবারে শেষে ‘থিওরি’ আর ‘প্র্যাক্টিকাল’-এর আলাদা আলাদা পরীক্ষা হবে। শেষে মেডেল ও সার্টিফিকেটের ব্যবস্থাও রয়েছে।
প্রতি দিন দুপুর ২টো থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ক্লাস। এই প্রশিক্ষণ শিবিরে আসতে সকলকে এক হাজার টাকা করে দিতে হয়েছে। তার সঙ্গে খাওয়াদাওয়া, যাতায়াতের খরচও রয়েছে। বেঙ্গালুরুর সুশান্ত না হয় নতুন করে পুজো শিখতে এসেছেন, কিন্তু যাঁরা আগেই এই পেশায় রয়েছেন তাঁরা এসেছেন কিসের তাগিদে? শুধুই শুদ্ধ ভাবে পুজোর নিয়ম শেখা? মনের কথা বলেই ফেললেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুরোহিত। তাঁর কথায়, ‘‘পুজোর শেষ মন্ত্র হচ্ছে ‘ওঁ কাঞ্চন মূল্যায় নমঃ’। ওটা বলেই দক্ষিণা নিতে হয়। এই প্রশিক্ষণের পরে লক্ষ্য দক্ষিণাটা বাড়ানো।’’ সহজ করে বোঝালেন নৈহাটির পুরোহিত সুকুমার। তিনি বললেন, ‘‘যদি মন্ত্রোচ্চারণ ভাল হয়, তবে বেশি দক্ষিণা পাওয়া যায়। পুজো কমিটি যা দেয় তা তো দেয়ই। কিন্তু যাঁরা পুষ্পাঞ্জলি দিতে আসেন তাঁদের তৃপ্তি হলে দক্ষিণার পরিমাণটা একটু হলেও বাড়ে। সবার একটু একটু দিয়েই তো অনেকটা হয় বলুন?’’
তবে কি এই প্রশিক্ষণ শিবিরে পুরোহিতদের দক্ষিণা বাড়ানোর মন্ত্রও শেখানো হয়? প্রধান শিক্ষক জয়ন্ত বলেন, ‘‘সমাজে পুরোহিতরা দিন দিন ‘কমিক ফিগার’ হয়ে যাচ্ছেন। সকলে মজা করে। তাঁদের উপরে নির্ভর করলেও শ্রদ্ধা নেই। তার কারণ, অনেকেরই দক্ষতা কম। আমি সেটাই বাড়াতে চাই। সেটা বাড়লেই মানুষের শ্রদ্ধা ও নির্ভরতা বাড়বে। আর তাতে আয় তো বাড়বেই।’’ শূলপাণি, রঘুনন্দন বর্ণিত দুর্গাপুজোর তত্ত্ব শিখিয়েই তাই থামতে চান না জয়ন্ত। পরিকল্পনা করেছেন, পুরোহিতদের রোজগার বাড়াতে আগামী দিনে বিবাহ বা শ্রাদ্ধের প্রশিক্ষণও দেবেন। ওতেই তো বেশি আয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy