এমনই বিকল নলকূপের মতো হাল মাঝগেড়িয়ার। ছবি: অভিজিৎ সিংহ।
ভাদ্রের মেঘ ছাওয়া গ্রাম।
খড়-খাপরার চাল, চুন আর কাঠ কয়লা দিয়ে আলপনা আঁকা লাল মাটির দেওয়াল, নিকোনো উঠোন ঘিরে ছোট ছোট বাড়ি— দক্ষিণ বাঁকুড়ার প্রান্তিক গ্রাম ধোজুড়ি।
বিয়াল্লিশটি আদিবাসী পরিবারের সেই গ্রামে সাকুল্যে তিনটি নলকূপ। বাঁকুড়া তার গ্রীষ্মের ঝাঁপি খুলতেই, যার দু’টি বিকল হয়ে গিয়েছে। বর্ষায় গভীর খানাখন্দ নিয়ে পুরনো চেহারায় ফিরতেও সময় নেয়নি রাস্তাঘাট। বছর কয়েক আগে বিদ্যুৎ এলেও ধোজুড়ির দাবি, একশো ওয়াটের ডুমো আলো, ‘মোমবাতির পারা (মতো) ধিকি ধিকি জ্বলে!’
রাজ্যে ‘পরিবর্তন’ ইস্তক সাড়ে চার বছর ঠারেঠোরে এটাই ধোজুড়ির চেহারা। যে আন্দোলন থেকে সরাসরিই ডাক দেওয়া হয়েছিল পালাবদলের, থিতিয়ে গিয়েছে সেই লালগড় আন্দোলনও। সরকারের প্রতিশ্রুতি মেলায় আন্দোলনের আঁচে গনগনে যে মুখগুলি ২০১১ সালের পরে শাসক দলের ছায়ায় আশ্রয় খুঁজেছিল চার বছর পরে জঙ্গলমহলের গ্রাম-জীবনের অপরিবর্তনীয় চেহারা দেখে তাঁদের মধ্যেও নতুন করে ক্ষোভ জমতে শুরু করেছে—তৃণমূলের আদিবাসী নেতাদের মুখেই এখন সে কথা অহরহ শোনা যাচ্ছে। জঙ্গলমহলের আদিবাসী সংগঠনগুলির মুখেও সে কথাই ফিরছে। এই আবহে নবান্নে এসেছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট— আদিবাসী ক্ষোভের সুযোগ কাজে নিয়ে পাহাড়-টিলায় ফিরছে মাওবাদীরা। ধোজুড়ি তেমনই এক বসত।
মেঘ-ছায়া সেই গ্রামীণ বসতের চূর্ণ রাস্তা ভেঙে বিমলা সর্দারের বাড়ির খোঁজ করতেই যেন বোবা হয়ে গেল গ্রাম। ভিন্ গ্রাম থেকে জল নিয়ে ফিরছিলেন এক মধ্যবয়স্কা, বিমলার বাড়ির খোঁজ করতে পাল্টা প্রশ্ন করছেন, ‘‘কেন, সে ঠিকানায় কাজ কি!’’ বাঁশের মাচায় দুপুরের খাস গল্পে ডুবে থাকা সদ্য যুবারাও এ-ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করে জানাচ্ছে, ও নামে কাউকে চেনেনই না তাঁরা।
অথচ প্রশাসনরে খাতায় ধোজুড়ির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রয়েছে বিমলা সর্দারের নাম। লালগড় আন্দোলনের প্রাথমিক পর্বে একাধিক ঘটনায় উঠে এসেছিল সদ্য কিশোরী ওই মাওবাদী স্ক্যোয়াড সদস্যের নাম। ২০০৬ সালে বেলপাহাড়ির উলুখডোবা থেকে তাঁকে গ্রেফতার করে পুলিশ। জঙ্গলের কিনারে একটি ডোবায় দলের অন্যদের সঙ্গে স্নান করতে নেমেছিলেন বিমলা। গ্রেফতার করা হয় সেই সময়েই। তবে, পুনর্বাসনের পরে পুলিশের ডেরায় তাঁর সুরক্ষিত জীবনে আন্দোলনের সেই আঁচ হয়তো নিভে গিয়েছে। কিন্তু ধোজুড়ি এখনও তাঁকে আড়াল করে রেখেছে। তাঁর ঠিকানা বলতে এখনও অস্বস্তি বোধ করেন তাঁরা। গ্রামের লক্ষ্মণ সর্দার বলছেন, ‘‘মাওবাদীদের সঙ্গে বিমলার আর য়োগাযোগ রয়েছে কিনা জানি না, কিন্তু ধোজুড়ি এখনও তাঁকে বনপার্টির নেত্রী বলেই জানে। গ্রামের লোকজনের সহানুভূতিও রয়েছে ওঁর প্রতি।’’ তৃণমূলের এক আদিবাসী নেতার কথায়, ‘‘পুলিশের অত্যাচার এড়াতে আদিবাসীদের অনেকেই আমাদের দলে (তৃণমূলে) যোগ দিলেও মাওবাদীদের প্রতি তাঁদের যে কিছুটা দুর্বলতা রয়ে গিয়েছে তা বলা বাহুল্য। ওঁদের কাছে বিমলা এখনও মাওবাদী স্ক্যোয়াড সদস্য।’’ সেই হারানো সহানুভূতির হাত ধরেই কি বনপার্টির পা পড়ছে জঙ্গলমহলে? প্রশ্নটা ঘুরছে গ্রামের আনাচকানাচে।
ধোজুড়ির অধিকাংশ বাড়ির দেওয়ালে আজও ঝুলছে মাটির হাঁড়ি। বছর কয়েক আগেও যে হাঁড়ির বাসিন্দা ছিল পুষ্যি-টিয়ার ঝাঁক। উঠোনে অচেনা মুখের পা পড়লেই যাদের তীক্ষ্ণ বার্তা ছুটে যেত বাড়ির ভিতরে— ‘বাং চিনাত হড়’, সাঁওতালি ভাষায় যা তর্জমা করলে দাঁড়ায় ‘অচেনা লোক’।
বাড়ির লোকজনের কাছে টিয়ার সেই অনুনাসিক সতর্ক-বার্তাই যথেষ্ট ছিল। সাত বছর আগে, লালগড় আন্দোলনের সময়ে মাওবাদী মুক্তাঞ্চলের অন্যতম আঁতুরঘর ধোজুড়ি, শুধু যৌথ বাহিনীর ভারী বুটের শব্দে নয়, অচেনা মুখের পুলিশি চরের আনাগোনা টের পেয়ে যেত টিয়ার ওই ডাকে। গ্রামের এক প্রৌঢ় বলছেন, ‘‘গ্রামের মেয়েরাই টিয়াগুলোকে বুলি (ভাষা) শিখিয়ে ছিল। বাড়ির আশপাশে অচেনা লোক দেখলেই ওরা চেঁচামেচি জুড়ে দিত—অচেনা লোক!’’ যা শুনে বাড়ির পুরুষেরা হারিয়ে যেতেন গ্রামের লাগোয়া বাবুই ঘাসের জঙ্গলে।
গ্রামের লক্ষ্মণ সর্দার বলছেন, ‘‘যৌথবাহিনীর গ্রাম-দখলের পরে টিয়াগুলো উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।’’ ধীরে ধীরে থিতিয়েও এসেছিল আন্দোলন। দেওয়ালে ঝোলানো টিয়ার বাসায় এখন গোলা পায়রার শান্তি কল্যাণ ঠাঁইনাড়া। গ্রামবাসীদের অনেকেরই প্রশ্ন— ‘যুদ্ধবিরতি’ কত দিন?
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy