হাল ফেরেনি গ্রামের রাস্তার। ছবি: রমাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়।
এবড়োখেবড়ো রাস্তার মাঝে বড়-বড় গর্ত। দাঁত বের করে হাসছে আধলা ইটের সারি। চার চাকার গাড়ি দূরের কথা, মোটরবাইক নিয়ে যেতে গেলেও হোঁচট খেতে হয় বেশ কয়েক বার।
রাস্তায় পিচ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি মিলেছে বারবার। গত পঞ্চায়েত ভোটের আগে তৃণমূল নেতারা গ্রামে এসে বলেছিলেন, পরের বার এই রাস্তা দিয়েই চার চাকা নিয়ে গ্রামে ঢুকবেন। রাস্তা পাকা হয়নি। তার পর থেকে সেই তৃণমূল নেতারাও আর গ্রামে আসেননি। এসেছে শুধু তাঁদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি।
হাওড়ার আমতা ১ ব্লকের কান্দুয়া দক্ষিণপাড়া গ্রামটি কিন্তু পুরোদস্তুর তৃণমূল অধ্যুষিত। কাঁচা মাটির দেওয়ালে সবুজ রঙে লেখা ‘কান্দুয়ার মাটি, তৃণমূলের ঘাঁঁটি’। গাছের ডালে, বাড়ির ছাদে পতপত করে উড়ছে জোড়াফুলের পতাকা। গ্রামের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সিপিএমের কোনও পোস্টার নেই, দেওয়াল লেখা নেই। একটা লাল শালু পর্যন্ত নেই। গাছের ডালে, ক্লাবের ছাদে সর্বত্র শুধু ঘাসফুল আঁকা পতাকা।
কান্দুয়া আর পাঁচটা গ্রামের মতো যে সে গ্রাম নয়। ১৯৯১ সালে বিধানসভা ভোটের ফল বেরিয়েছিল ১৭ জুন। আমতা কেন্দ্রে (এখন উদয়নারায়ণপুর) জিতেছিল সিপিএম। পরের দিন সকালে কংগ্রেস সমর্থকে ভরা দক্ষিণপাড়া ঘিরে ফেলেছিল কয়েকশো সশস্ত্র দুষ্কৃতী। শুরু হয়েছিল বাড়ি-বাড়ি ঢুকে হামলা। হাত কেটে নেওয়া হয়েছিল ঘণ্টেশ্বর বাগ, কেশব ধারা, রাসু ধারা, চম্পা পাত্রদের। খুন করা হয়েছিল কংগ্রেসের পঞ্চায়েতের সদস্য গোপাল পাত্রকে। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল অনেক বাড়ি, ধানের মরাই। অভিযোগ ছিল ক্ষমতার মধ্যগগনে থাকা সিপিএমের দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে।
তখনও অবশ্য তৃণমূলের জন্ম হয়নি। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন যুব কংগ্রেস নেত্রী। ঘটনার পরে তিনি এবং সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়-সহ অনেকেই গ্রামে গিয়েছিলেন। তৃণমূল সূত্রের দাবি, মমতা তাঁর বই বিক্রির রয়্যালটি থেকে আহতদের ২০ হাজার টাকা করে দিয়েছিলেন। পুড়ে যাওয়া বাড়িগুলিও ফের তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৯৮ সালে তৃণমূল তৈরি হলে গ্রামের অনেকেই সে দলে যোগ দেন। সিপিএমের অত্যাচারের প্রমাণ দিতে পরে দলের বহু সভায় রাসু, কেশব, ঘণ্টেশ্বরদের মঞ্চে তোলা হয়েছে। প্রতি বছর ১৮ জুন পালন করা হয় ‘কান্দুয়া দিবস’। কিন্তু ২২ বছর পরেও বিচার মেলেনি। হাওড়া আদালতে মাঝেমধ্যেই সাক্ষী ও অভিযুক্তদের ডাক পড়ে। তবে আদালতের শুনানি আজও শেষ হয়নি।
আইন আইনের পথে চলেছে, রাজনীতি নিজের পথে। ইতিমধ্যে রাসু, কেশবদের অবস্থা আরও সঙ্গীণ হয়েছে। দরিদ্র পরিবারের রোজগেরে সদস্যদের হাত চলে গেলে যা হয়। এখন কেউ দিনমজুর লাগিয়ে নিজের জমিতে চাষ করান। কেউ চালান ছোট মুদির দোকান। তারমধ্যেই গ্রামের বাসিন্দারা ছেলেমেয়েদের বহু কষ্টে লেখাপড়া শেখাচ্ছেন।
স্থানীয় ক্লাবের মাঠে দাঁড়িয়ে কেশব ধারার অভিযোগ, “বার কয়েক কালীঘাটে গিয়েছিলাম। কিন্তু দিদির দেখা পাইনি। এলাকার নেতাদের বললে বলে দিদি নাকি এখন খুব ব্যস্ত। আমরা তো সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়েই নিজেদের হাত হারিয়েছি। গ্রামেরই একজন শহিদ হয়েছেন। তারপরেও আমরা দলে পাত্তা পাই না।” বাড়ির দাওয়ায় বসে গজরাচ্ছিলেন রাসু ধারা, “এক সময়ে এলাকায় যারা সিপিএমের হয়ে আমাদের চমকাত, তাঁদেরই কয়েক জন এখন আমাদের দলে নাম লিখিয়ে নেতা হয়ে গিয়েছে। কিছু প্রয়োজন হলে এখন তাঁদের কাছে যেতে হয়!” একই সঙ্গে আতঙ্ক ঝরে পড়ে তাঁর গলায়, “পাশের গ্রামের কিছু সিপিএম নেতা আমাদের দেখে বলে, এখনও তো কিছু হল না। আমরা ক্ষমতায় এলে গ্রামে থাকতে পারবি?”
মুদির দোকানে খদ্দের সামলাতে সামলাতে ঘণ্টেশ্বর হাসেন, “বিচার পাওয়া দূরের কথা। এত দিনে একটা রাস্তা অবধি পাইনি আমরা। তবু আমরা দিদিকে বিশ্বাস করি। দোকানে প্রার্থীর পোস্টার লাগিয়েছি। দোকানের পাশে তৃণমূলের পতাকা টাঙিয়েছি। কিন্তু যদি আমাদের গ্রামের কথাটাও দল ভাবত।”
উদয়নারায়ণপুরের তৃণমূল বিধায়ক সমীর পাঁজার অবশ্য আশ্বাস, “কান্দুয়াকে আমরা ভুলিনি। রাস্তার সমস্যার কথা জানি। সব ঠিক থাকলে ভোটের পরেই রাস্তার কাজ শুরু হওয়ার কথা।”
বিশ্বাসে মিলায় বস্তু... এই ভরসায় আজও টিকে রয়েছে হাওড়ার গ্রাম কান্দুয়া।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy