বুধবার শ্রমিক অসন্তোষের জেরে সাসপেনশন অফ ওয়ার্কের নোটিস ঝুলল শ্যামনগরের ওয়েভারলি জুটমিলে। শ্রমিকদের দু’পক্ষের মারামারির জেরে ঘটনাস্থলে আসে পুলিশ।
গত তিন দিনে চারটি চটকলে তালা ঝুলেছে।
শ্রমিক অসন্তোষের জেরে বুধবার শ্যামনগরের আতপুরে ওয়েভারলি জুটমিলেও ‘সাসপেনশন অব ওয়ার্ক’-এর নোটিস পড়ল।
মঙ্গলবারই শ্যামনগরের অকল্যান্ড চটকলে কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সে দিনই মজুরি নিয়ে গোলমালের জেরে বজবজের নিউ সেন্ট্রাল জুটমিলেও কাজ বন্ধ হয়েছিল। রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুর আশ্বাস, শ্রমিকদের মজুরি মিটিয়ে আজ, বৃহস্পতিবার থেকে সেখানে ফের কাজ শুরু হবে।
প্রভিডেন্ড ফান্ড নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই উত্তর ২৪ পরগনার ওয়েভারলি জুটমিলে সমস্যা চলছিল। পিএফ কমিশনের আধিকারিকদের সঙ্গে বেশ কয়েক দফা আলোচনাতেও কোনও লাভ হয়নি। তার জেরে এ দিন সকাল থেকে কাজ বন্ধ করে দেন শ্রমিকদের একাংশ।
শ্রমিকদের অভিযোগ, গত ২৭ বছর ধরে ওই চটকলের শ্রমিকদের প্রায় ৪০ কোটি টাকা পিএফ বকেয়া রয়েছে। তার উপরে দিনে আট ঘণ্টা কাজের পরে বাড়তি ছ’ঘণ্টা করে কাজ করানো হচ্ছিল, যা তাঁরা পেরে উঠছিলেন না। ওই চটকলের আইএনটিইউসি অনুমোদিত ইউনিয়নের সম্পাদক কামেশ্বর রাওয়ের অভিযোগ, “পিএফ দফতরের আধিকারিকদের সঙ্গে আলোচনার পরে আমরা কয়েক জন চটকল কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করি, মিলের ওভারটাইম বন্ধ করে সাত দিন যাতে চটকল চালু রাখা যায়। এর পরেই উত্তেজিত হয়ে ওঠেন চটকল কর্তাদের কয়েক জন। আমাদের তাড়িয়ে দেন তাঁরা।”
আহত দুই শ্রমিক।
চটকল কর্তৃপক্ষের তরফে দাবি করা হয়েছে, এ দিন বেলা ১১টা নাগাদ বকেয়া পিএফ নিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শ্রমিকদের একাংশ গণ্ডগোল করলে আলোচনা ভেস্তে যায়।এর চটকলে ঢুকতে গেলে শ্রমিকদের একাংশ তাঁদের বাধা দেন বলে জগদ্দল থানায় অভিযোগ করেছেন কামেশ্বরবাবু। তাঁর দাবি, ওই শ্রমিকেরা আইএনটিটিইউসি ও সিটু অনুমোদিত শ্রমিক সংগঠনের সমর্থক। ধর্মেন্দ্র গিরি, সন্তোষ প্রসাদ, সুরেন্দ্র সিংহ নামে তিন শ্রমিক মার খান। জগদ্দল থানার পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়। ঘটনাস্থলে গিয়ে ভাটপাড়ার বিধায়ক অর্জুন সিংহ বলেন, “স্বার্থান্বেষী কিছু নেতা চটকল মালিকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে শ্রমিকদের স্বার্থবিরোধী কাজ করছেন। অবিলম্বে চটকলটি যাতে চালু করা যায়, তা দেখছি।” সিটু নেতা রঞ্জিত কুণ্ডুরও বক্তব্য, “আমাদের কেউ গণ্ডগোলে জড়ায়নি।”
কিন্তু এই ধরনের গণ্ডগোল কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। রাজ্যে বর্তমানে যে ৫৪টি বেসরকারি চটকল রয়েছে, তার মধ্যে পাঁচটি আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বাকি ৪৯টির মধ্যে ৩২টিতেই টানা সমস্যা চলছে। সম্পত্তির তুলনায় দায় বেশি, এমন চটকলের সংখ্যা অন্তত ১৭। বহু ক্ষেত্রেই মূল মালিকদের হাত থেকে লিজে চটকলের কর্তৃত্ব হস্তান্তর করা হয়েছে। সেই নয়া ইজারাদারেরা আধুনিকীকরণের কোনও চেষ্টা করেননি। ছাঁটাইয়ের ভয়ে শ্রমিক সংগঠনগুলিও পুরনো ব্যবস্থাই আঁকড়ে থাকতে চেয়েছে। এর ফলে বাজারের চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হচ্ছে অধিকাংশ চটকল। আবার রাজনৈতিক চাপে উৎপাদন চালিয়ে যেতে গিয়ে বাজার নেই এমন জিনিস বিপুল পরিমাণে তৈরি হয়ে ডাঁই হচ্ছে। ক্ষতি সামাল দিতে শ্রমিকদের কম মজুরিতে কাজ করানোর ভূরি-ভূরি অভিযোগ রয়েছে। পিএফ-গ্র্যাচুইটিও মেটানো হচ্ছে না। মার্চ থেকে মে-জুন পর্যন্ত মূলত ভিন্ রাজ্যের শ্রমিকেরা দেশে ফিরে গিয়ে চাষবাস করেন। সেই ঘাটতি সামাল দিতে অন্য শ্রমিকদের টানা ওভারটাইম করানো হচ্ছে, যা ওই গরমে চটকলের বদ্ধ পরিবেশে প্রায় অসহ্য। ফলে বেশির ভাগ চটকলই প্রায় ক্ষোভের বারুদের উপরে দাঁড়িয়ে আছে। রুগ্ণ কলকারখানা নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করে চলা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নাগরিক মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক নব দত্তের মতে, “আধুনিকীকরণ যদি না হয় এবং শ্রমিকদের পাওনা মেটানোর ব্যাপারে সরকার যদি হস্তক্ষেপ না করে, আরও অনেক চটকলই বন্ধ হয়ে যাবে।”
শ্রমিক অসন্তোষ এবং সমস্যা মোকাবিলায় যাতে শ্রম উপদেষ্টা পর্ষদ অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে বৈঠকে বসে, সে ব্যাপারে মধ্যস্থতা করতে এ দিনই রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনকে অনুরোধ করেন প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি তথা আইএনটিইউসি-র রাজ্য সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য। পরে তিনি বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী যাতে অবিলম্বে ত্রিপাক্ষিক বৈঠক ডাকেন, রাজ্যপালকে পদক্ষেপ করতে অনুরোধ করেছি।” বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুর কটাক্ষ, “হিন্দমোটর, ডাকব্যাক বন্ধ হয়েছে। এখন একের পর এক চটকল বন্ধ হচ্ছে! সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে।”
শ্রমমন্ত্রী বলেন, “গত দু’দিনে নর্থব্রুক, হনুমান ও অকল্যান্ড চটকল বন্ধ হয়েছে। নিউ সেন্ট্রাল চটকলে মজুরি দেওয়া নিয়ে গোলমাল হচ্ছিল। সিদ্ধান্ত হয়েছে, বুধবার রাতের মধ্যেই মজুরি মেটানো হবে। বৃহস্পতিবার থেকে ওখানে উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা। অকল্যান্ড চটকলের মালিক পক্ষকে বৈঠকে ডাকা হয়েছে।” মন্ত্রী আরও জানান, গত এপ্রিল থেকে চটকলগুলিতে কাজের বরাত পেতে সমস্যা হচ্ছিল। এখন অল্প অল্প করে কাজের বরাত পাচ্ছে চটকলগুলি। বন্ধ চটকলগুলি যাতে তাড়াতাড়ি খুলে যায়
রাজ্য সরকার তার ব্যবস্থা করছে বলেও তাঁর দাবি।
—নিজস্ব চিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy