জাপানী দাস
দিন তিনেক আগের ঘটনা। মায়ের ওষুধ আনতে বেরিয়েছিলেন রাজারহাটের মণিখোলার বাসিন্দা জাপানী দাস। রাস্তায় এক মহিলা প্রায় কাঁদতে কাঁদতে তাঁকে বললেন, গোটা পরিবার দু’দিন ধরে জল-মুড়ি খেয়ে রয়েছে। রেশন কার্ড নেই। রোজগার নেই। সঞ্চয় শেষ।
শুনেই নিজের দলের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন জাপানী। ব্যবস্থা হল চার কেজি চাল এবং এক কেজি ডালের। রাজারহাটের মণিখোলার বাসিন্দা ওই দুর্গত পরিবারটির একমাত্র রোজগেরে কৃষ্ণ নায়েক লোহার কারখানার অস্থায়ী শ্রমিক। কিন্তু লকডাউন শুরু হতেই মালিক জানিয়ে দিয়েছেন, মাইনে দিতে পারবেন না। দুই মেয়ে স্নাতক স্তরের ছাত্রী। বাড়ি গিয়ে পড়িয়ে নিজেদের খরচ তুলতেন তাঁরা। এখন পড়ানোও বন্ধ। আপৎকালীন পরিস্থিতিতে ওই পরিবারের জন্য যাতে রেশনের ব্যবস্থা হয়, সে জন্য স্থানীয় কাউন্সিলর এবং ক্লাবগুলির সঙ্গে কথা শুরু করেছে জাপানীদের সংস্থা।
অসুস্থ মা, অসুস্থ স্বামী আর এক ছেলেকে নিয়ে বছর একান্নর ‘জাপানীদি’-র সংসার। কিন্তু এর বাইরেও বড় সংসার আছে তাঁর। মানসিক স্বাস্থ্য ও বিশেষ শিশুদের নিয়ে কাজ করা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন জাপানী। রাজারহাট এলাকায় তাঁদের দলে রয়েছেন সাত জন মহিলা। করোনা-সংক্রমণের জেরে তালাবন্দি দেশেও যাঁদের ছুটি নেই।
আরও পড়ুন: মেক্সিকোয় আটকে সল্টলেকের প্রবীণ দম্পতি
সেই দলেরই এক সদস্যা, দশদ্রোণের কেকা মজুমদারের ফোন এল— ‘‘গোপাল ধর, চুমকি মণ্ডলের ওষুধ ফুরিয়েছে। কী ভাবে আনাব জাপানীদি?’’ দুই মানসিক রোগীর টানা ওষুধ বন্ধ হলে যে এত দিনের চিকিৎসার পুরোটাই পণ্ড হবে, জাপানী জানেন। এ দিকে, তাঁদের গাড়িও নেই যে পাভলভ হাসপাতাল থেকে ওষুধ আনা যাবে। শেষে উত্তর দমদম পুর এলাকায় তাঁদের শাখার এক আধিকারিকের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন জাপানী। সমাধান মিলল। জানা গেল, লকডাউনের মধ্যে ওষুধ আনা-নেওয়ার জন্য ওই শাখা সম্প্রতি অ্যাম্বুল্যান্স পেয়েছে। তাতে করেই হোয়্যাটসঅ্যাপে পাঠানো প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে পাভলভ থেকে ওষুধ আনানো হল। রোগীদের হাতে সেই ওষুধ পৌঁছে দিলেন কেকা, মনিকা, কবিতা, প্রভাতীরা।
এলাকার ঘরে-ঘরে গিয়ে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সমীক্ষা, কাউন্সেলিং, খেলার মাধ্যমে বিশেষ শিশুদের প্রশিক্ষণ— এ সবেই কেটে যায় সপ্তাহের ছ'দিন। একঘেয়ে লাগে না? ছোট থেকেই ঘরের অসুস্থতা সামলানোয় অভ্যস্ত জাপানীর উত্তর, “কখনও না। বরাবর অসুস্থতা দেখেই বেড়ে উঠেছি।” মা যুথিকা সরকার ২০০৭ সালে সেরিব্রাল অ্যাটাকের পর থেকে দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী ছিলেন। পাশাপাশি, মানসিক চিকিৎসাও চলে তাঁর।
আরও পড়ুন: কিছু ছাড় মিললেও, ৩ মে পর্যন্ত ঘরেই বন্দি গোটা দেশ
বাবা নিরঞ্জন সরকার পণ্যবাহী জাহাজে কাজ করতেন। দীর্ঘ অসুস্থতার পরে ২০০৪ সালে মারা যান। খুব ছোটবেলায় কঠিন অসুখে ভুগে ভাই সন্দীপের কথা বন্ধ হয়ে যায়। বছর তিরিশ আগে বাগমারির বাসিন্দা অরুণ দাসের সঙ্গে জাপানীর বিয়ে হয়। রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসে কাবু স্বামী ও ছেলে অর্ণবকে নিয়ে ২০০৭ সালে অসুস্থ মা ও ভাইয়ের দেখভাল করতে রাজারহাটে চলে আসেন জাপানী। ভাইকে হারান ঠিক পরের বছরেই।
স্বামীর আয় ছিল না। অভুক্ত থাকার যন্ত্রণা বোঝেন জাপানী। তাই কেউ এমন আছেন শুনলেই নিজেদের রুটিন কাজের গণ্ডি পেরিয়ে বাহিনীর অন্য মেয়েদের সঙ্গে আলোচনা সেরে নেমে পড়ছেন। তাঁর কথায়, “এই সময়ে কত মানুষের ভাঁড়ারে সামান্য চালও নেই। এই কষ্ট যদি মেটাতে না-পারি, তা হলে জীবন দিয়ে কতটা বুঝলাম, সেই প্রশ্ন জীবনভর খুঁচিয়ে যাবে।”
স্বেচ্ছাসবী সংস্থাটিতে যোগ দিয়েছিলেন ১২ বছর আগে। তার আগে আট মাসের প্রশিক্ষণ। কাজের শুরুতে হাতে ৫০০ টাকা আসত। টাকার অভাবে উচ্চ মাধ্যমিকের পরে ছেলেকে আর পড়াতে পারেননি। মাঝেমধ্যেই কষ্ট দেয় এই না-পারাটা। এখন বদলেছে পরিস্থিতি। সংস্থার তরফেই এখন তাঁদের আট হাজার টাকা ভাতা দেওয়া হয়। স্টুডিয়ো থেকে ছবি ল্যাবে ধুয়ে স্বামী মাসান্তে হাতে পান তিন হাজার টাকা। ছেলে ছোটখাটো কাজ করেন। অর্থাৎ সংসারের বড় ভরসা জাপানীই।
শূন্য থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর এই অদম্য লড়াই নিঃসন্দেহে উৎসাহিত করে পরিচিতদের। জাপানী কিন্তু মনে করেন না, তিনি বিশেষ কিছু করছেন। “টাকাটাই সব নয়। কাজটা করে খুব তৃপ্তি হয়,’’ একগাল হেসে বললেন লড়াকু।
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy