কী হবে? চিন্তায় বাসুদেব ও সুমিত্রা। ছবি: উদিত সিংহ।
একই জায়গায় দু’বার বাজ পড়ে কি!
প্রবাদ যা-ই বলুক, বর্ধমানের গোপালপুরের ঢালি দম্পতির অভিজ্ঞতা, পড়ে। ৮ নভেম্বর রাতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঘোষণার পরে ৫০০, ১০০০ টাকার নোট অচল হয়ে গেল। সংসারে ‘জোড়া বাজ’ পড়ল বাসুদেব-সুমিত্রার।
কেরলে কাজে যাওয়া রাজমিস্ত্রি বাসুদেব তিন সপ্তাহ নোট-আকালের সঙ্গে যুঝে ক্ষান্ত দিয়েছেন। দশ বছরের পেশা ছে়ড়ে ফিরে এসেছেন বাড়িতে। দিনে গড়ে পাঁচ-সাতটা পেটিকোট সেলাই করে যেটুকু রোজগার করতেন বাসুদেবের স্ত্রী সুমিত্রা, তা-ও বন্ধ ৮ নভেম্বরের পর থেকে। সামনে মেয়ের বিয়ে। ঘরে উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়া ছেলে। এই অবস্থায় নোটের চোট সামালানোর উপায় ভাবতে-ভাবতেই দিন কাবার ঢালিদের। রাতও।
ঠিকাদার ধরে দশ বছর আগে কেরলে রাজমিস্ত্রির কাজ জোটান বছর সাতচল্লিশের বাসুদেব। থাকতেন এর্নাকুলাম জেলার আলুভা শহরের কম্বরিবাজার এলাকার ভাড়াবাড়িতে। দৈনিক আয় ছিল ছশো টাকা। বাড়িভাড়া আর খাওয়া খরচটুকু রেখে বাকি টাকা জমাতেন। তিন-চার মাস পরে বাড়ি ফেরার সময়ে বা পরিচিত কেউ বর্ধমানে ফিরলে তাঁকে দিয়ে টাকা পাঠাতেন। তা দিয়ে গোপালপুরের আধ-পাকা বাড়িতে স্ত্রী-মেয়ে-ছেলের খরচ অনেকটাই চলে যেত। যেটুকু কম পড়ত, ঠেকা দিতেন সুমিত্রা। মহাজনের কাছ থেকে টুকরো ছিট ও সুতো এনে বাড়িতে পেটিকোট তৈরি করতেন। মাস গেলে সাতশো থেকে হাজার টাকা হতো তাতে। মেয়ে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পরে, আগামী মাঘে তাঁর বিয়ে ঠিক করেন বাবা-মা। ধাক্কা লাগল ৮ নভেম্বর।
বাসুদেবের অভিজ্ঞতা, ৫০০ ও ১,০০০ টাকার নোট বাতিলের জেরে ৯ নভেম্বর থেকেই মুখ ভার ছিল ঠিকাদারদের। ‘‘হাতে নগদ না থাকলে ব্যবসা চালানো মুশকিল হবে’’, এমন বলা দিয়ে শুরু। পরে, ‘‘পুরনো নোটে মজুরি নে। ব্যাঙ্কে বদলে নিবি’’, আর একটু পরে, ‘‘পুরনো নোট না নিলে মজুরি নেই’’ আর শেষে, ‘‘কাজ দিতে পারব না, যা’’। ২৯ নভেম্বর বাড়ি ফেরার জন্য ট্রেন ধরেন বাসুদেব। ধার করে টিকিট কেটেছিলেন। তার আগের ১৫ দিনে কাজ পেয়েছেন মাত্র দু’দিন। তাতে ১০০ টাকার নোটে ১,২০০ টাকা হাতে ছিল। তাঁর কথায়, ‘‘যেখানে থাকতাম, সেখানে ওই টাকায় এক সপ্তাহ চলবে না। অগত্যা দশ বছরের কাজ ছাড়লাম।’’
একই সমস্যায় পড়েন সুমিত্রাও। মহাজন প্রথম দু’-এক দিন টাকা দিলেও, তার পর থেকে টাকা বাকি রাখা শুরু করেন। বকেয়া চাইতে গিয়ে সেখানেও বাতিল নোট নেওয়ার ঝুলোঝুলি। শেষ পর্যন্ত গত তিন সপ্তাহ ধরে সেলাই মেশিন বন্ধ। লক্ষ্মীর ভাঁড়, চালের কলসি, আলমারির কোণা—যেখানে যতটুকু জমিয়েছিলেন তা দিয়ে দিন কয়েক ঘর চালিয়েছেন সুমিত্রা। এলাকার ধান খেতে গিয়েছেন কাজ চাইতে। নগদের অভাবে সেখানে কাজ বাড়ন্ত বলে আপাতত সপ্তাহে এক-দু’দিন দেড়শো টাকা রোজে ধান ঝাড়ছেন পড়শিদের দুয়ারে-দুয়ারে ঘুরে।
কাটোয়া, কেতুগ্রাম, মঙ্গলকোট, ভাতারের বিভিন্ন গ্রাম থেকে ফি বছর কয়েক হাজার লোক ভিন্-রাজ্যে (বিশেষ করে কেরলে) রাজমিস্ত্রি বা জোগাড়ের কাজ করতে যান। তাঁদেরও অনেকের দশা ঢালি পরিবারের মতো। রাজমিস্ত্রি দেবব্রত সরকার, তপন মণ্ডলেরা বললেন, “গত এক মাসে নগদের অভাবে কেরলের ঠিকাদার, প্রোমোটার— কেউ টাকা দিতে পারছে না। তাই বাড়ি চলে আসতে বাধ্য হয়েছি।’’ অসংগঠিত শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠন সূত্রের দাবি, জেলা থেকে যাঁরা ভিন্-রাজ্যে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন, তাঁদের বেশির ভাগই ঘরে ফিরেছেন। ঘরে ফিরে দিনমজুরি করছেন তাঁদের একাংশ। নোট-আকালের বাজারে বাকিরা কর্মহীন।
সাধে কি বাসুদেব-সুমিত্রা আক্ষেপ করছেন, ‘‘একটা ঘোষণায় জোড়া বাজ পড়ল সংসারে। ভাবুন!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy