Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Dam

বালির গাড়ির দাপটে ক্ষতি বাঁধ, চরের

প্রশাসনের নজরদারি সত্ত্বেও অবৈধ বালি ঘাটের ব্যবসা চলছে। ক্ষতি পরিবেশেরকোথাও লোক নামিয়ে, কোথাও যন্ত্র দিয়ে অজয়-দামোদরে বালি তোলা চলছেই বলে অভিযোগ জেলায়।

জামালপুরে জুন মাসে এ ভাবেই চলছিল বালি তোলা। নিজস্ব চিত্র

জামালপুরে জুন মাসে এ ভাবেই চলছিল বালি তোলা। নিজস্ব চিত্র

সৌমেন দত্ত
বর্ধমান শেষ আপডেট: ২২ জুলাই ২০২০ ০৫:১০
Share: Save:

ভোর থেকে নৌকা নিয়ে ভাসছেন জনা সাত। তিন-চার জন নদীর কোলে বালতি হাতে ডুব দিচ্ছেন। বালতি ভর্তি বালি তুলে, তা বস্তায় ভরছেন নৌকায় থাকা বাকিরা। পূর্ব বর্ধমানের জামালপুরে সন্ধ্যা পর্যন্ত দামোদর নদে বালি তুলে এনে পাড়ে নির্দিষ্ট জায়গায় রাখার ফাঁকে তাঁদের এক জন বলেন, ‘‘খুবই পরিশ্রমের কাজ। সপ্তাহে দু’তিন দিনের বেশি করা যায় না। তবে এ কাজ করলে দৈনিক হাজার টাকা পাই। মাঠেঘাটে সারা সপ্তাহ দিনমজুরি করলেও এই রোজগার হবে না।’’

কোথাও লোক নামিয়ে, কোথাও যন্ত্র দিয়ে অজয়-দামোদরে বালি তোলা চলছেই বলে অভিযোগ জেলায়। বাঁধ থেকে অনেকটা চর পেরিয়ে নাগাল মেলে নদীর। চরের বালি কেটে ছড়ানো হয়েছে মোরাম, ইটের টুকরো। তার উপর দিয়ে নিরন্তর দৌড়চ্ছে বালি বোঝাই ট্রাক, ট্রাক্টর। ফলে, প্রাচীন বাঁধে ধরছে ফাটল, দফারফা হচ্ছে নদীর চরের, ভাঙছে গ্রামের রাস্তা— জেলার নানা প্রান্তে উঠছে একই অভিযোগ। বছরভরের এই ‘দৌরাত্ম্য’ অন্য বার বর্ষায় অন্তত বন্ধ থাকে। কিন্তু করোনার ধাক্কায় এ বার বর্ষাতেও বালি তোলা ছাড় পাওয়ায় বেড়েছে ভাঙনের সমস্যা, দাবি দামোদর ও অজয় নদের পাড়ের বাসিন্দাদের।

প্রতি বছর জুনের মাঝামাঝি থেকে বালি তোলা বন্ধ করে দেয় প্রশাসন। প্রায় পুজোর আগে পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা থাকে। কিন্তু এ বার মার্চে ‘লকডাউন’ শুরু হওয়ায় মাস তিনেক বালি তোলা বন্ধ ছিল। পূর্ব বর্ধমান জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, তার ফলে ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষে যেখানে বালি বাবদ প্রায় ৫৬ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছিল, ২০১৯-২০ বর্ষে তার চেয়ে প্রায় দশ কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে। এই ঘাটতি মেটাতে বর্ষা নেমে যাওয়ার পরেও ১৫ জুলাই পর্যন্ত বালি তোলায় ছাড় দেওয়া হয়েছিল। সেই সুযোগ নিয়ে অবৈধ কারবার চলেছে। জেলা প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, ‘‘বালি সংক্রান্ত নানা অভিযোগ এসেছে ঠিকই। কিন্তু রাজস্বের দিকটাও তো দেখতে হবে।’’

প্রশাসন জানায়, জেলায় ১৬৬টি বৈধ বালি খাদান রয়েছে। কিন্তু তার সঙ্গে অনেক অবৈধ খাদানও চলছে বলে অভিযোগ। জামালপুরে দামোদর থেকে কেতুগ্রামে অজয়ের তীরবর্তী নানা গ্রামের বাসিন্দাদের অভিযোগ, বর্ষায় জল বাড়তেই নৌকায় করে বালি তোলা শুরু হয়েছে। রাতে ট্রাক, ট্রাক্টরে বোঝাই করে পাচার হচ্ছে। কেতুগ্রামের বাকলসা, মঙ্গলকোটের কোঁয়ারপুরের বাসিন্দা সুচিত্রা দে, সুমিতা সর্দারদের অভিযোগ, ‘‘বর্ষায় বালি তোলায় পাড়ের কাছে মাটি আলগা হয়ে যাচ্ছে। ভাঙন বাড়ছে।’’ বারবার এলাকাবাসীর বিক্ষোভের মুখেও কাজ ছাড়তে নারাজ বালি তোলায় নিযুক্ত শ্রমিকেরা। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েক জন শ্রমিকের দাবি, যাঁরা খাদানে বালি তোলেন, তাঁদের দিনে আয় শ’পাঁচেক টাকা। যাঁরা নৌকায় বালি তোলেন, তাঁদের দৈনিক আয় হাজার টাকা। দু’-তিনশো টাকা মজুরিতে মাঠেঘাটে কাজ করার চেয়ে সপ্তাহ শেষে এই কাজে পকেট বেশি ভরে, দাবি তাঁদের।

জামালপুর, খণ্ডঘোষ থেকে গলসি, কাঁকসা— দামোদরে বহু পুরনো নানা বাঁধ রয়েছে। বাসিন্দাদের অভিযোগ, নিয়মিত বালির গাড়ি চলায় সেগুলি বসে যাচ্ছে। ধসে পড়ছে মাটি। ৩১ ডিসেম্বর গলসির শিকারপুরে বাঁধের উপর দিয়ে যাওয়া বালির ট্রাক উল্টে এক পরিবারের পাঁচ জন মারা যান। তখন বাঁধে বালির গাড়ি যাতায়াতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল সেচ দফতর। কিন্তু খাদান ফের চালু হতেই বাঁধ ধরে অবাধে বালির গাড়ি ছুটছে। সম্প্রতি জামালপুরের কোঁড়া গ্রামে এর প্রতিবাদে বিক্ষোভও দেখান কিছু গ্রামবাসী। তার পরে সেচ দফতর বাঁধে বালির গাড়ি চলা আটকাতে ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দা সুশীল দাস, মন্টু বিশ্বাসদের প্রশ্ন, ‘‘নিয়ম তো হয়েছে। কিন্তু তা মানা হচ্ছে কি না, সে নজরদারি কোথায়?’’

অনেক জায়গায় আবার বাঁধ থেকে নদীতে পৌঁছতে দু’আড়াই কিলোমিটার বালির চরে মোরাম, ইট, পাথর ফেলে রাস্তাও তৈরি করা হয়েছে। তার উপর দিয়ে ছুটছে ট্রাক, ট্রাক্টর, ম্যাটাডর। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান তথা নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র জানান, মোরাম বা পাথর দিয়ে নদীর বুকে রাস্তা বানানো একেবারে কাম্য নয়। বিশ্বভারতীর অধ্যাপক তথা নদী বিশেষজ্ঞ মলয় মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘এ ভাবে রাস্তা তৈরি করা নদীকে মেরে ফেলার সমান।’’ বর্ধমানের বাসিন্দা, ভূতত্ত্ববিদ বিকাশচন্দ্র রায়ের আক্ষেপ, ‘‘গত কয়েক দশকে বালি তোলার নামে দামোদরের উপরে নির্যাতন করা হয়েছে।’’

বালির গাড়ি চলাচলে বাঁধ ও চরের ‘দফা রফা’ হচ্ছে, মানছেন সেচ দফতরের কর্তারাও। দফতরের দামোদর ক্যানাল ডিভিশনের এগজ়িকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার ভাস্করসূর্য মণ্ডলের আশঙ্কা, ‘‘বর্ষার সময়ে চরে এ রকম রাস্তা থাকলে নদীর গতিপথ বদলে যেতে পারে।’’ বালি বোঝাই গাড়ির দাপটে গলসি, জামালপুরে নতুন রাস্তা ভেঙে যাওয়ার অভিযোগে বিক্ষোভ-অবরোধ করেছেন বাসিন্দারা। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েতে গর্ত। জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের প্রকল্প আধিকারিক স্বপনকুমার মল্লিকের অভিযোগ, ‘‘ওভারলোডিংয়ের জন্য রাস্তা খারাপ হচ্ছে।’’

যদিও জেলাশাসক (পূর্ব বর্ধমান) বিজয় ভারতীর বক্তব্য, ‘‘ওভারলোডিং ধরার জন্য নিয়মিত তল্লাশি চলছে। প্রতি দিন কয়েক লক্ষ টাকা করে জরিমানাও আদায় করা হচ্ছে।’’ জেলার পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায়েরও দাবি, সরকার অনুমোদিত বালি খাদান ছাড়া অন্য কোনও খাদান চালাতে দেওয়া হবে না, কড়া নির্দেশ দেওয়া আছে। ভুক্তভোগী বাসিন্দাদের অবশ্য দাবি, নির্দেশ আছে খাতায়-কলমেই।

অন্য বিষয়গুলি:

Dam River Bed Sand Truck Illegal Mine
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy