চার দিকে নদী, সমুদ্র ঘিরে রেখেছে ঘোড়ামারা দ্বীপকে।
কত বার ঘর বদলেছেন? প্রশ্ন শুনে কর গুনতে বসেন ঘোড়ামারা দ্বীপের মানুষ। কেউ বলেন, ‘‘বার চারেক তো বটেই।’’ কেউ আবার মাথা চুলকে উত্তর দেন, ‘‘পাঁচ বারের কম তো নয়ই।’’
নদী-সমুদ্রে ঘেরা দক্ষিণ ২৪ পরগনার ঘোড়ামারা দ্বীপের মানুষের কাছে বার বার সংসার পাতা যেন অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। এক-এক বার ঝড়-বৃষ্টির দাপট আসে। আর তলিয়ে যায় জমি-জিরেত। তল্পিতল্পা গুটিয়ে ক্রমশ পিছু হটতে থাকেন মানুষ। এখন দুর্যোগের কথা শুনলে ত্রাণশিবিরেও যেতে মন সরে না অনেকের। বলেন, ‘‘ফিরে এসে দেখব, আরও হয়তো কয়েক বিঘা জমি খেয়ে নিয়েছে জল!’’
আমপানের ভ্রূকুটি অবশ্য ফের ত্রাণশিবিরে যেতে বাধ্য করছে তাঁদের। সোম ও মঙ্গল দু’দিন ধরে প্রায় ৭০০ বাসিন্দাকে শিবিরে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে পুলিশ-প্রশাসন। আরও অনেককে ধাপে ধাপে সরানো হচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তিত ঘোড়ামারা পঞ্চায়েতের প্রধান সঞ্জীব সাগর। বিডিও সুদীপ্ত মণ্ডল বললেন, ‘‘বাসিন্দাদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে।’’
আরও পড়ুন: ত্রাণ শিবিরে শিবিরে মাস্ক, স্যানিটাইজ়ারও
আরও পড়ুন: লালারস পরীক্ষা হচ্ছে সব শ্রমিকের
চার দিকে নদী, সমুদ্র ঘিরে রেখেছে ঘোড়ামারা দ্বীপকে। পূর্ব দিকে বটতলা, পশ্চিম দিকে হুগলি, উত্তর দিকে মুড়িগঙ্গা নদী। আর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। বাগপাড়া, মন্দিরতলা, রায়পাড়া, চুনপুলি ও হাটখোলা— পাঁচটি এলাকা নিয়ে ঘোড়ামারা পঞ্চায়েত। আয়লার পরে ২০১১ সালে জনসংখ্যা ছিল ৬ হাজার। বর্তমানে সেটা প্রায় ৪ হাজার। জীবন বাঁচাতে অনেকেই এখন আর থাকতে চান না এই দ্বীপভূমিতে। প্রতিবারই বড়সড় ঝড়-ঝঞ্ঝা এলে চিন্তা, তলিয়ে যাবে না তো গোটা দ্বীপ! মানুষের জীবিকা বলতে এখানে মিন ধরা, পান ও ধান চাষ। বটতলা নদীর ভাঙনে তলিয়ে গিয়েছে হাজার হাজার বিঘা ধানের জমি, পুকুর, খালবিল। ভূমিহীন হয়েছেন বহু মানুষ। জলের দিক আঙুল দেখিয়ে এখনও ছেলেমেয়েদের গল্প করেন বড়রা, ‘‘ওইখানে ছিল আমাদের বাড়িঘর, পুকুর, চাষের জমি। আর ওইখানটাতে ধানের গোলা...।’’
দ্বীপের নাম ঘোড়ামারা
• ব্রিটিশ আমলে কাকদ্বীপ থেকে এক সাহেব সরকারি কাজে নৌকোয় তাঁর ঘোড়াকে নিয়ে দ্বীপে পৌঁছন। রাতে তাঁবুর বাইরে থেকে সেই ঘোড়া তুলে নিয়ে যায় বাঘে। জনশ্রুতি, সেই থেকে দ্বীপের নাম, ঘোড়ামারা।
• ২০০৬ সালে জনসংখ্যা ছিল হাজার ছ’য়েক। বর্তমানে ৪ হাজারে এসে ঠেকেছে।
• মানুষের প্রধান জীবিকা মিন ধরা, পান ও ধান চাষ। কিন্তু বিঘের পর বিঘে জমি তলিয়ে যাওয়ায় ভূমিহীন হয়েছেন অনেকেই।
গ্রামের প্রবীণরা জানালেন, প্রায় একশো বছর আগে ১০-১২ হাজার বিঘা জুড়ে চর পড়ে। পূর্ব মেদিনীপুর, সাগর এলাকা থেকে অনেকে ওই চরের জমিতে বসবাস শুরু করেন। ঘোড়ামারা দ্বীপের দক্ষিণে কয়েকশো বিঘা এলাকা জুড়ে ছিল লোহাচড়া, খাসিমারা দ্বীপ। জনবসতি ছিল সেখানেও। কিন্তু নদী ও সমুদ্রের ভাঙনে কবেই তলিয়ে গিয়েছে সে দু’টি। ঘোড়ামারার ভাগ্যেও কি তা-ই অপেক্ষা করে আছে, ভাবেন এখানকার মানুষজন। খুব যে ভুল ভাবেন, তা-ও নয়। কারণ, ১০ হাজার একরের দ্বীপভূমি এখন ভাঙতে ভাঙতে হাজার চারেক বিঘায় এসে ঠেকেছে।
নদী-সমুদ্রের ভাঙন বছরভর লেগে আছে। তার উপরে আয়লা, বুলবুল, ফণীর মতো বিপর্যয়ের সময়ে জলোচ্ছ্বাসে বার বার তছনছ হয়েছে বাঁধ। আমপান কোন বিপর্যয় নিয়ে আসে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় দ্বীপবাসী। এ দিন ত্রাণশিবিরে যাওয়ার পথে ট্রলারে ওঠার আগে এক বৃদ্ধ চোখ মুছতে মুছতে বলে গেলেন, ‘‘বাড়ির পোষা গরু-ছাগলগুলোকে রেখে যেতে হচ্ছে। জানি না, ওদের ফিরে এসে আর দেখতে পাব কিনা!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy