Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Cyclone Amphan

জামাটা পাঁজরের ঘামে সেঁটে, মাথায় খাবারের বস্তা, যূথিকাকে ভুলতে পারছি না

আমপান ডাঙার নৌকো তছনছ করেছে। সাইক্লোন সেন্টার বহু মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে। কিন্তু নোনাজল ঢুকেছে এক ফসলা চাষের জমিতে। এর পর কী হবে, কেউ জানে না। তারই সরেজমিন প্রতিবেদন। আজ প্রথম পর্ব। আমপান ডাঙার নৌকো তছনছ করেছে। সাইক্লোন সেন্টার বহু মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে। কিন্তু নোনাজল ঢুকেছে এক ফসলা চাষের জমিতে। এর পর কী হবে, কেউ জানে না। তারই সরেজমিন প্রতিবেদন। আজ প্রথম পর্ব। 

আমপানের দু’দিন পর, উত্তর ২৪ পরগনার যোগেশগঞ্জের গ্রামে।

আমপানের দু’দিন পর, উত্তর ২৪ পরগনার যোগেশগঞ্জের গ্রামে।

স্যমন্তক ঘোষ
সুন্দরবন  শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০২০ ১৮:৩২
Share: Save:

(১)

পরিতোষের সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল ২০ মে বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ। গোসাবার মাথার ওপর দিয়ে তখন ঝড় বইছে ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটার বেগে। দিল্লিতে বসে থাকা সাংবাদিককে আমপানের (প্রকৃত উচ্চারণ ‘উম পুন’) লাইভ শোনাতে শোনাতেই কনফারেন্স কলে ধরা হয়েছিল জি প্লটের অশোককে। সেখানে তখন ঝড়ের চোখ। বাঁধ টপকে জল ঢুকল। আমরা লাইভ শুনছি। ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে সাইক্লোন সেন্টারে মানুষের হাহাকার শুনতে পাচ্ছি। অশোক দাঁড়িয়ে নিজের বাড়ির কাছে, শেল্টারে। চাল উড়ল। জলের ঝাপটে ভেসে গেল মাটির ঘর। টেলিফোনে জি প্লটের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হল। তার পর পরিতোষও। এর পর অন্তত কয়েক লক্ষ বার ফোন করেছি পরিতোষকে। পাওয়া যায়নি। কেবলই মনে হচ্ছিল, সকালে কি তবে ভুল বলেছিল?

পরিতোষের বাবা ভাগচাষি ছিলেন। বাবাকে লুকিয়ে মা পূর্ববঙ্গের ‘ভিখিরি’দের কচুর লতি, মাচার কুমড়ো দিতেন। পরিতোষ পড়াশোনা করেছে তুষার কাঞ্জিলালের রাঙাবেলিয়ায়। ডাকাতের সাক্ষাৎকার জোগাড় করে দেবে, এই শর্তে আলাপ হয়েছিল বছর কয়েক আগে। সাংবাদিকের বোটে নিয়ে এসেছিল মতিন মণ্ডলকে। সেই থেকে যোগাযোগ। ম্যানগ্রোভ, এনজিও-কিসসা, সুন্দরবন উন্নয়নে লাল পার্টির দাপট, আয়লা বাঁধে পয়সার বাটোয়ারা, তৃণমূল-বিজেপি, হিন্দু-মুসলিম— সব প্রশ্নেরই হাতে গরম জবাব এবং গসিপ ওর কাছে থাকে। ফলে আড্ডা জমে ভাল।

২০ মে আমপানের সকালে পরিতোষ বলেছিল, গোসাবায় অন্তত আরেকটা আয়লা হবে না। মেঘ আছে। বৃষ্টির দাপট বাড়ছে। কিন্তু পাখি ডাকছে। এটাই সংকেত। যা হবে, সাগরের মুখের কাছে। ঘোড়ামারা, রাক্ষসখালি, পাথর (পাথরপ্রতিমা), বকখালি চোট খাবে। ও দিকে হিঙ্গলগঞ্জ-সন্দেশখালি ঝাপটা খেতে পারে। কিন্তু গোসাবা বেঁচে যাবে। বেঁচেই যদি যাবে, তবে দেড় সপ্তাহ হতে চলল, ফোনে পাচ্ছি না কেন?

নদী বাঁধ এ ভাবেই ভেঙেছিল গোসাবার দ্বীপে।

দিল্লি-কলকাতা ফ্লাইট চালু হল ২৮ মে। টিকিট কাটলাম ২৯-এর। সেও এক অভিজ্ঞতা। শেষবেলায় ফ্লাইট ক্যান্সেল। পয়সা ফেরত হবে না। জমা থাকবে ভার্চুয়াল ওয়ালেটে। অথচ সেই টাকা খরচ করে একই এয়ারলাইনের পরের ফ্লাইটের টিকিট কাটা অসম্ভব। চার দিন আগে কোনও ফ্লাইট নেই। অগত্যা নতুন করে টিকিট কাটা নতুন এয়ারলাইনে। সঙ্গে সরকারি অ্যাপ ডাউনলোড বাধ্যতামূলক। তিনগুণ বেশি দামে এয়ারপোর্ট ক্যাব বুকিং। বিমানবন্দরের বাইরে লোক দেখানো অ্যাপ পরীক্ষা এবং থার্মাল স্ক্রিনিং। পুরোটাই প্যানডেমোনিয়াম। আর কোভিডকালীন ফ্লাইটযাত্রা তো নভশ্চরের মতো। মাস্ক, ফেসশিল্ড, পিপিই কিট... বিমানসেবক এবং সেবিকাদের চেহারা এক কথায় বম্ব স্কোয়াডের মতো।

আরও পড়ুন: ছুড়ে দেওয়া ত্রাণ ধরতে নদীর ধার ঘেঁষে মরিয়া দৌড়

তারই মধ্যে আলাপ হল সহযাত্রী রতন সর্দারের সঙ্গে। দিল্লির অদূরে একটি কারখানায় কাজ করেন। লকডাউনে কাজ গিয়েছে। আমপানে ঘর। হিঙ্গলগঞ্জের বাসিন্দা এই প্রথম বিমানে চড়লেন। সম্ভবত এই শেষ। রানাঘাট আর কিষাণগঞ্জের বন্ধুরা বাস ভাড়া করে বাড়ি ফিরেছেন। রতন বউয়ের গয়না বিক্রি করে ফ্লাইটে। হিসেব করে দেখালেন বন্ধুদের থেকে হরে দরে তাঁর খরচ সামান্য কম হয়েছে। সঙ্গে এও বললেন, শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনে টিকিট পাওয়া আর জঙ্গলে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে মামার হাতে পড়েও বেঁচে যাওয়া একই রকম। সুন্দরবনের মানুষ বাঘের নাম নেন না। কেউ ‘মামা’ বলেন, কেউ ‘মামু’। আর পরিবারের কেউ চলে গেলে আরেকটু সম্মান দেখিয়ে ‘বড়বাবু’। রতনের পরিবার আপাতত শেল্টার ক্যাম্পে। রতন ফিরে বাঁধ মেরামতিতে হাত লাগাবেন। ১০০ দিনের কাজের চার পয়সা যদি ঢোকে।

ন্যাজাটে ডুবে থাকা গ্রাম।

৩০ মে, শনিবার, সকাল ৬টা— গন্তব্য ধামাখালি। সায়েন্স সিটি থেকে বাঁদিক নিতেই কোভিড যন্ত্রণা থেকে মুক্তি। মাস্ক, সামাজিক দূরত্ব, চিকিৎসকদের নিত্য দিনের সতর্কবাণী, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা এবং তা ঘিরে আন্তর্জাতিক রাজনীতি— গোটা পৃথিবী যে এ সব নিয়ে উত্তেজিত, এই পৃথিবীতে তার কোনও প্রভাব-টোভাব নেই। মাস্কের চিহ্ন বহন করছে একমাত্র পুলিশ, তবে গলায়। বাকি জীবন গয়ংগচ্ছ। জলের কই ডাঙায় পিছলে যাচ্ছে। আঁকশিতে ঝুলছে মাংস। রাস্তার ডান ধারের গাছগুলোর অবস্থা বিরাট কোহলির চুলের মতো। খুব কসরতে একদিকে টেনে আঁচড়ানো। বাঁ হাতের গাছগুলোর তেমন বিকার ঘটেনি। ঘটকপুকুর মোড়ে একমাত্র ঝড়ের চিহ্ন চারতলা বাড়িটা। বোধ হয় হোটেল। ম্যারিয়টের মতোই সব কাচ ভাঙা। দাঙ্গার পর দিল্লিতেও এমন বাড়ি দেখেছি। তবে এ রাস্তায় গাছ যা উল্টেছে, তার কয়েক গুণ বেশি উল্টেছে কলকাতায়।

৩০ মে, শনিবার, সকাল ৯টা

ধামাখালির দু’ঘাট আগে দেখা হল দুয়ারির জঙ্গলের মহারাজের সঙ্গে। রামকৃষ্ণ মিশনের ব্রহ্মচারী। আয়লার পরে চলে এসেছেন সুন্দরবনে। বানিয়েছেন ছোট্ট একটা আশ্রম। ফোনে বার চারেক কথা হয়েছিল ভদ্রলোকের সঙ্গে। ভাইরাল বাক্যটা উনিই দিয়েছিলেন— লকডাউনে কাজ গিয়েছে, আমফানে ঘর।

তছনছের ছবি। হিঙ্গলগঞ্জে।

আয়লার পর সুন্দরবন দেখেছি। অন্তত সন্দেশখালির এই অঞ্চলে পুরনো স্মৃতি ফিরে আসছে না। নদীর দু’ধারে মানুষের সেই হাহাকার নেই। একেকটা চর মৃণাল সেনের খণ্ডহরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। খালের মুখে মীন ধরার জাল পেতেছেন হাঁটু অবধি কাপড় তোলা জেলে বউরা। বোট আর ক্যামেরাবাবু দেখলেই অনর্গল গালি দিচ্ছেন। মহারাজের শাগরেদ বিশ বছরের পীযূষ গলা চড়িয়ে পরিস্থিতি বর্ণনা করছে। তার চেয়েও উঁচু গলায় পাল্টা খেউড় করছেন সারেং।

আয়লা সুন্দরবনের মানুষকে চারটে জিনিস দিয়েছে— এনজিও আর সরকারের ডোলের লোভ, আয়লা বাঁধ, সাইক্লোন সেন্টার আর অবিশ্বাস। মীন ধরা জেলেনিও জেনে গিয়েছেন, এনজিও ত্রাণের পয়সা মারে। সরকার রেশনের চাল বিক্রি করে। অসময়ে সমুদ্রে নৌকো না ভাসালে লাভের মাছ ওঠে না।

মহারাজের শাগরেদ, দুয়ারির জঙ্গল চরের বাসিন্দা পীযূষ বোঝানোর চেষ্টা করছে, করোনা একটা রূপকথা। জল জঙ্গলের এই দেশে প্রসব বেদনা হলে নৌকো ভাড়া করতে ঘণ্টা পেরিয়ে যায়। হাসপাতালে যখন পৌঁছন সেই মহিলা, ততক্ষণে তিনি মা হয়ে গিয়েছেন। কোয়ার্ক না থাকলে কত লোক এমনিই মরে যেত! ঝড় হলে কিছু বউ বিধবা হয়। এটাই নিয়ম। বাংলাদেশে ঘুরে যায় বহু নৌকোর মুখ। যাঁরা ফেরেন, ঝড়ের মাছ নিয়ে ফেরেন। উল্টো স্রোতের মাছ দামে ভারী হয়। করোনা ডাঙায় নৌকো তুলে দিয়েছে। আমপান ডাঙার নৌকো তছনছ করেছে। সাইক্লোন সেন্টার বহু মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে, কিন্তু নোনাজল ঢুকেছে এক ফসলা চাষের জমিতে। এর পর কী হবে, কেউ জানে না।

নতুন করে ঘর বাঁধা আবার। চকপাটলির দক্ষিণ মহিষপুকুর গ্রাম।

কেন আয়লা বাঁধ কাজ করল না? পীযূষের উত্তর বাঁধে। সারেং দেখিয়ে দেয় বাঁধ। তিন কিলোমিটার আয়লার বাঁধ ভাঙেনি। পাশেই এক কিলোমিটার পুরনো মাটির বাঁধ। সিপিএম-আরএসপি দ্বন্দ্বে ওইখানে সিমেন্ট পড়েনি। নো ম্যান্স ল্যান্ড হয়ে থেকে গিয়েছিল। বুলবুলের পর গ্রামের লোক মাটি দিয়ে রিং বাঁধ দিয়েছিল তার সামনে। আমপানের নোনা জল ওখান দিয়েই ঢুকেছে। ভেসে গিয়েছে গ্রাম। ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। কিন্তু দৃশ্যত আয়লা বাঁধ সুন্দরবনকে ট্রাম্পের চোখে মোদীর গুজরাত করে রেখেছে। যত দৈন্য, সবটাই আড়ালে। আয়লার মতো খুল্লামখুল্লা নয়। দুয়ারির জঙ্গল থেকে পুঁইজালি— জলপথে গোটা রাস্তাটাই সিপিএম-আরএসপি-তৃণমূলের বাঁধ ডিসপিউট দেখতে দেখতে কেটে গেল। আর এনজিও-দের এক্সপেরিমেন্ট। কোথাও চাটাইয়ের বাঁধ। কোথাও ভার্টিবার গ্রাস। কোথাও মাটি, কোথাও কংক্রিট, কোথাও ম্যানগ্রোভ জঙ্গল।

ত্রাণের নৌকো যেখানেই ভিড়ছে। গালাগালের বন্যা। অবিশ্বাসের খিস্তি। নবারুণ ভট্টাচার্যের গদ্যের মতো।

৩০মে, শনিবার, বিকেল ৪টে

সূর্য ডুবছে রায়মঙ্গলে। পরিতোষ ফোন করল।

(২)

জগন্নাথের সঙ্গে আলাপ বুলবুলের পর। মেডিক্যাল ক্যাম্পের সূত্রে।

ফ্রেজারগঞ্জে সমুদ্র বরাবর জেলে গ্রামে ওর বাড়ি। বাড়ির মহিলারা মূলত শুঁটকি তৈরি করেন। ছেলেরা ট্রলার নিয়ে দূর সমুদ্রে যান।

আমফানের আগেই ফোন করেছিল জগন্নাথ। লকডাউনে কারও কোনও কাজ নেই। ট্রলার ডাঙায় পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। মেরামতির টাকা পর্যন্ত নেই। যদি কিছু করা যায়। তারই মধ্যে আমপান। ঝড়ের দু'দিনের মধ্যেই ফোন করেছিল জগন্নাথ। জানিয়েছিল, সব ধসে গিয়েছে। বেঁচে থাকার ন্যূনতম প্রয়োজনটুকু পর্যন্ত হারিয়েছেন মানুষ।

৩০ মে, শনিবার, রাত ৯টা

সন্ধ্যায় পুঁইজালি থেকে ফিরেছি। পরদিন ভোরে ফ্রেজারগঞ্জ যাত্রা। শরীরে ক্লান্তি ভালই। তারই মধ্যে ফোন এল ডাক্তারবাবুর। জগন্নাথ যে ত্রাণের লিস্ট পাঠিয়েছে, তাতে কোনও মুসলিম নাম আছে? খুঁজে দেখলাম। মাত্র একটি নাম। অথচ ওই গ্রামেই এর আগে যখন হেলথ ক্যাম্প হয়েছে, সেখানে অন্তত ১০ জন মুসলিম এসেছিলেন। পুরনো খাতা দেখে জানা গেল। ডাক্তারবাবু প্রশ্নটি করেছিলেন কারণ, স্থানীয় এক প্রশাসনিক কর্তা তাঁর চেনা। ফ্রেজারগঞ্জ যাওয়া হবে শুনে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। ওখানে ত্রাণ লুঠ হচ্ছে। এবং বিষয়টি সাম্প্রদায়িক চেহারা নিতে শুরু করেছে। একান্তই যদি যেতে হয়, সঙ্গে পুলিশ প্রোটেকশন নিতে হবে। বিডিও এবং স্থানীয় থানার সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ করতে হবে। বেমক্কা দাঙ্গায় ফেঁসে গেলে মুশকিল।

রূপমারি গ্রাম পঞ্চায়েতের কুমিরমারি গ্রাম। কোথাও কোথাও এক মানুষ পর্যন্ত জলে ডুবে গিয়েছিল।

৩০মে, শনিবার, রাত সাড়ে ৯টা

জগন্নাথকে ফোন করা হল। মুসলিম নাম নেই কেন? জগন্নাথের বক্তব্য, পশ্চিম অমরাবতীতে সামান্য কিছু মুসলিম পরিবার থাকলেও তাদের অবস্থা বাকিদের মতো নয়। ছেলেরা আরবে কাজ করে। মাস গেলে টাকা পাঠায়। যাঁর অবস্থা খারাপ, তাঁর নাম দেওয়া হয়েছে। নাগরিক মন জগন্নাথের কথায় ভিজল না। দ্রুত মুসলিম পরিবারের নাম পাঠাতে বলা হল। একই সঙ্গে ফোন করা গেল স্থানীয় সোর্সকে। দিন কয়েক আগে গণ্ডগোল যে একটা হয়েছিল, স্বীকার করল সোর্স। এও বলল, মানুষের অবস্থা এতটাই খারাপ যে, ত্রাণ লুঠ হচ্ছে। তবে বিষয়টিতে সাম্প্রদায়িক রং চড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে। এবং তার জন্য যুযুধান দুই রাজনৈতিক দলই দায়ী। দুই পক্ষই চাইছে, এলাকায় ত্রাস তৈরি করে সমস্ত ত্রাণ নিজেদের হাতে নিতে এবং নিজেদের মতো করে বিলি করতে। ফলে ‘সাম্প্রদায়িক’ না বলে বিষয়টিকে ‘রাজনৈতিক’ বলাই ভাল।

৩১ মে, রবিবার, সকাল ৮টা

নামখানার বিডিও-কে ফোন করলাম। তাঁর অফিস ঘুরেই আমাদের ফ্রেজারগঞ্জ যাওয়ার কথা। ত্রাণের চিঠি জমা দিতে হবে। ফোনে বিডিও সাহেব স্বীকার করলেন, ত্রাণ নিয়ে লুঠপাট চলছে। আশ্বাস দিলেন স্থানীয় থানাকে তিনি আমাদের কথা জানিয়ে রাখছেন। একই সঙ্গে বললেন, তাঁর অফিসে যাওয়ার কোনও প্রয়োজনই নেই। একটা হোয়াটসঅ্যাপ করে দিলেই হবে।

জল পেরিয়ে ত্রাণের অপেক্ষায়।

৩১ মে, রবিবার, সকাল ১০টা

টেরাব্যাঁকা রাস্তার শেষে আচমকাই যেন একটা উন্নত ব্রিজ। দোয়ানিয়া হাতানিয়া প্রায় ২৫ বছর আগে পার হয়েছিলাম ভেলার চেয়ে সামান্য বড় সাইজের নৌকোয়। দ্বিতীয়বার বার্জে। এই প্রথম ব্রিজে চড়া। এক কথায়— যত বড় নদী নয়, তত বড় সেতু। সেতু পার করতেই ভয়াবহতা নজরে আসতে শুরু করল। আশপাশের বাড়িগুলোয় নতুন করে চাল দেওয়া হচ্ছে। একের পর এক ইলেকট্রিক পোস্ট স্প্রিংয়ের মতো পাকিয়ে রাস্তা জুড়ে শুয়ে। বিদ্যুতের তার যত্রতত্র ছড়িয়ে।

৩১ মে, বেলা সাড়ে ১০টা

কোস্টাল থানার বড়বাবু পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, কোনও সমস্যা হলে তাঁর কিছু করার নেই। জেনে নিলেন, কোনও রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে কি না। এবং একই সঙ্গে সতর্ক করলেন, গণ্ডগোল হচ্ছে। পাল্টা প্রশ্ন ছিল, ‘সাম্প্রদায়িক?’ জবাব এড়ালেন দারোগা।

৩১ মে, বেলা সাড়ে ১১টা

রাতেই আরও বেশ কিছু মুসলিম নাম পাঠিয়েছিল জগন্নাথ। সাম্প্রদায়িক গণ্ডগোলের বিষয়টি যে একেবারেই রাজনৈতিক, পশ্চিম অমরাবতীতে ঢোকার কিছু ক্ষণের মধ্যেই তা টের পাওয়া গেল। জগন্নাথ ভুল বলেনি। পূর্ব এবং পশ্চিম অমরাবতী মিলিয়ে ৬০টি মতো মুসলিম পরিবার। তার অধিকাংশই তুলনায় বর্ধিষ্ণু। যাঁদের অবস্থা তত ভাল নয়, তাঁরা এসেছিলেন। তাঁদের কাছে অন্যদের কথা জানতে চাওয়ায় খুব স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, “আমরা গরিব মানুষ। আগে আমাদের দিন। তারপর বড়লোকদের কথা ভাববেন।” হ্যাঁ, অমরাবতীতে ত্রাণ লুঠের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। জগন্নাথরা কুপন বানিয়ে রাখা সত্ত্বেও আশপাশের বহু গ্রাম থেকে লোক এসেছিলেন সামান্য চাল-ডাল পাওয়ার আশায়। তাঁরা তর্ক করেছেন, ঝামেলাও করেছেন। কিন্তু জিনিসে হাত দেননি। গাড়ির পিছন পিছন ছুটেছেন কেবল, যদি সামান্য কিছু পাওয়া যায়!

হাসনাবাদের কাছে খাঁপুকুর।

শনিবারের সুন্দরবনের সঙ্গে অনেকটা তফাত দক্ষিণ ২৪ পরগনার এই অঞ্চলের। আয়লার পরে যেমন সুন্দরবনের কঙ্কাল বেরিয়ে পড়েছিল, আমপানের পরে ফ্রেজারগঞ্জ, সাগর, পাথরপ্রতিমার কঙ্কাল তেমনই বেরিয়ে পড়েছে। মানুষের দুর্দশা ভয়াবহ চেহারা নিয়েছে। ঠিকই বলেছিল গোসাবার পরিতোষ। সমুদ্রের ধার ঘেঁষে গাছের পাতাগুলো হলুদ হয়ে গিয়েছে। ভারি অদ্ভুত! জগন্নাথ বলছিল, ঝড়ের কয়েক মিনিট আগে চারিদিক হলুদ হয়ে গিয়েছিল মিনিট কয়েকের জন্য। তার পর তীব্র বৃষ্টি শুরু হয়। ওদের মতে ‘অ্যাসিড বৃষ্টি’। বৃষ্টি থামে। কিছুক্ষণের গুমোট। তার পর রাক্ষসের মতো ঝড় ঢোকে স্থলভাগে। গলা ধরে ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো একের পর এক গাছ ফেলতে থাকে। বিদ্যুতের খুঁটি। বাড়ির চাল। ঠেলা গাড়ি। ডাঙায় তুলে রাখা নৌকো।

ভয়াবহ সেই দৃশ্যের বর্ণনা শুনেছি কেবল। সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে যে অবর্ণনীয় দৃশ্যটির কথা এখনও ভুলতে পারছি না, তার প্রধান চরিত্র যূথিকা। সাত বছরের মেয়েটির মা পঙ্গু। বাবা মাছ ধরতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছেন বহু দিন হল। ত্রাণ নিতে এসেছিল। এক বস্তা খাবার মাথায় করে নিয়ে যাওয়ার সময় সিন্থেটিক গোলাপি জামাটা ঘামে সেঁটে যাচ্ছিল পাঁজরের সঙ্গে। যূথিকাকে কিছুতেই ভুলতে পারছি না।

(ছবি: সিজার মণ্ডল, বিশ্বজিৎ হাজরা, শ্যামল গায়েন)

অন্য বিষয়গুলি:

Cyclone Amphan Sundarbans Cyclone Shelter Hingalganj
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy