করোনা পরিস্থিতিতে গোটা দেশ যখন বিপর্যস্ত, সেই সময়ে পাঁচ বছর ধরে ঝুলে থাকা নারদ মামলায় হঠাৎ রাজ্যের চার নেতা-মন্ত্রীকে সিবিআইয়ের গ্রেফতার করার ঘটনায় কেন্দ্রীয় সরকারকে একযোগে তুলোধোনা করল সব বিরোধী দল। তৃণমূলের অভিযোগ, সদ্য বিধানসভা নির্বাচনে পর্যুদস্ত হয়ে বিজেপি এখন কেন্দ্রীয় সংস্থাকে কাজে লাগিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে রাজ্যে অশান্তির নীল নকশা তৈরি করছে বিজেপি এবং কেন্দ্রীয় সরকার। ভোটে পরাজিত হলেও বিরোধী বাম এবং কংগ্রেস এই প্রশ্নে কার্যত তৃণমূলেরই পাশে দাঁড়িয়েছে। করোনা মোকাবিলায় ‘অপদার্থতা’ আড়াল করতে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘রাজনৈতিক ভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ পদক্ষেপের তীব্র প্রতিবাদ করেছে দু’দলই।
এমতাবস্থায় কার্যত একঘরে হয়ে পড়েছে বিজেপি। সিবিআইয়ের পদক্ষেপের সঙ্গে দলের দূরত্ব তৈরির চেষ্টাই করছে তারা। রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ মুখ খোলেননি। একই অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও কেন তাঁদের গ্রেফতার করা হল না— এই প্রশ্ন উঠেছে যে দুই বিজেপি নেতার বিরুদ্ধে, সেই বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এবং বিধায়ক মুকুল রায়ও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকেছেন। রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য অবশ্য দাবি করেছেন, ‘‘যখনই সিবিআই তদন্ত গতি পেয়েছে, বলা হয়েছে প্রতিহিংসা। আবার যখনই তদন্ত শ্লথ হয়েছে, বলা হয়েছে মোদী-দিদির সেটিং! কংগ্রেস ও বামপন্থীরা ধারাবাহিক ভাবে এই কথা বলে গিয়েছেন। আমরা বলেছি, কোনও কেন্দ্রীয় সংস্থাকে ব্যবহার করে বিজেপির জমি শক্ত করার প্রয়োজন আমাদের ছিল না, এখনও নেই। তদন্ত তার নিজের নিয়মে, নিজের মতো চলবে।’’
কোভিড পরিস্থিতি থেকে নজর ঘোরানোর জন্য সিবিআইয়ের হঠাৎ সক্রিয়তা, এই অভিযোগ মোকাবিলা করতে গিয়ে বিজেপির কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয় করোনা বিধি ভেঙে ‘বিশৃঙ্খলা’র দিকে পাল্টা আঙুল তুলেছেন। টুইটে কৈলাসের অভিযোগ, ‘‘আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য যিনি শপথ নিয়েছেন, সেই মুখ্যমন্ত্রীই গিয়ে তদন্তকারী সংস্থাকে হুমকি দিচ্ছেন!’’ শমীকেরও সংযোজন, ‘‘তৃণমূলের যে সব নেতা নিজাম প্যালেসে পৌঁছেছিলেন, তাঁদের উচিত ছিল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা। কোভিড পরিস্থিতির মধ্যে যে ভাবে বিক্ষোভ চলেছে, ভাল কথা নয়।’’
বিজেপি নেতাদের এ সব দাবিই উড়িয়ে দিয়েছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। দলের সাংসদ সুখেন্দুশেখর রায়ের মতে, ‘‘মানুষের রায় সহ্য করতে না পেরে এ রাজ্যের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করেছে বিজেপি ও কেন্দ্রীয় সরকার। জবাব রাজ্যের মানুষই দেবেন।’’
কেন্দ্রকে তোপ দেগে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র এ দিন বিবৃতিতে বলেছেন, ‘করোনা মহামারিতে যখন সারা দেশের মানুষের জীবন, জীবিকা অভূতপূর্ব বিপর্যয়ের সম্মুখীন, তখনই সরকারের সীমাহীন অপদার্থতা চাপা দিতে এবং মানুষের নজর অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্যই এই সময়টা বেছে নেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দেশ ও রাজ্যব্যাপী করোনার ভয়ঙ্কর আক্রমণের সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্থা সিবিআইয়ের এই পদক্ষেপের তীব্র প্রতিবাদ করছি’।
একই সুরে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর বক্তব্য, ‘‘রাজ্য জুড়ে করোনা আবহে মানুষের মধ্যে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছে। অক্সিজেন নেই, চিকিৎসা নেই, ভেন্টিলেটর নেই, ভ্যাকসিন নেই। যখন মানুষকে সেবা করার প্রয়োজন, একে অপরকে দেখভালের প্রয়োজন, সেই সময় এ ধরনের গ্রেফতার অনেক প্রশ্ন তুলছে। কারণ, কাউকে ধরা হবে কাউকে ছাড়া হবে, এটা তো হতে পারে না। করোনা আবহে এই গ্রেফতার কি আদৌ দরকার ছিল! দু’দিন আগে বা পরে কি করা যেত না!’ অধীরবাবুর আরও মন্তব্য, মুর্শিদাবাদ বা মালদহে তাঁরাও ‘প্রতিহিংসা’র শিকার হয়েছেন কিন্তু তা সত্ত্বেও এই ‘প্রতিহিংসা’র প্রতিবাদ দরকার। সিপিআই (এম-এল) লিবারেশন আরও এক ধাপ এগিয়ে আজ, মঙ্গলবার রাজ্যে ‘প্রতিবাদ দিবসের’ ডাক দিয়েছে। দলের সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের দাবি, ‘‘বাংলার গণরায়কে অগ্রাহ্য করে কেন্দ্রের যড়যন্ত্রমূলক পদক্ষেপ বন্ধ হোক, করোনা বিপর্যস্ত বাংলায় প্রতিশোধের রাজনীতি বন্ধ হোক, বিরোধী নেতার ভূমিকা পালনকারী রাজ্যপাল ফিরে যান।’’ বাম শরিক সিপিআই, ফরওয়ার্ড ব্লক, আরএসপি বা ফ্রন্টের বাইরের এসইউসি, পিডিএস-ও কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে। কেন্দ্রের পদক্ষেপের সমালোচনা করেছেন শিবসেনা সাংসদ প্রিয়ঙ্কা চতুর্বেদীও।
নারদ-কাণ্ডে আদালতে জনস্বার্থের আবেদন করেছিলেন কংগ্রেস নেতা অমিতাভ চক্রবর্তী। তিনি এ দিন বলেছেন, ‘‘রাজ্য সরকার যদি ঠিক মতো তদন্ত করত, ঠিক সময়ে এফআইআর করত, তা হলে সিবিআই তদন্তের দরকারই পড়ত না। আশা করছি, অন্য যাঁদের নাম এফআইআর-এ আছে, তাঁদের বিরুদ্ধেও সিবিআই চার্জশিট দেবে।’’ সঠিক তদন্ত হলে দুই বিজেপি নেতা এবং চার তৃণমূল সাংসদের বিরুদ্ধেও একই পদক্ষেপ হওয়া উচিত বলে মনে করছেন সিপিএমের আইনজীবী-সাংসদ বিকাশ ভট্টাচার্য। পাশাপাশিই সূর্যবাবু-সহ বাম নেতৃত্বের একাংশ মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘দুর্নীতির সঙ্গে আপস করে, দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে নিয়ে বিজেপির মতো ভয়ঙ্কর শক্তির মোকাবিলা করা যাবে না, এই শিক্ষা তৃণমূলেরও গ্রহণ করা উচিত’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy