লকডাউনের নানাবিধ ছাড়ের পরেও অসুবিধা থাকছেই জনসাধারণের।—ছবি পিটিআই।
ঠায় আড়াই ঘণ্টা বাসের জন্য দাঁড়িয়ে বিশ্বজিৎ দত্ত। থাকেন বেলঘরিয়ায়। হেঁটে ডানলপ পর্যন্ত এসে অপেক্ষা করছেন সরকারি বাসের জন্য। যাবেন গিরিশ পার্ক। এর আগে দুটো বাস চলে গিয়েছে। কিন্তু ২০ জনের বেশি যাত্রী তোলা যাবে না বলে ওই বাসে জায়গা হয়নি তাঁর। বিরক্ত মুখে তাঁর প্রশ্ন, ‘‘এ ভাবে লকডাউনে ছাড় দিয়ে লাভ কী?’’
বিশ্বজিৎবাবু গিরিশ পার্কের একটি ছোট্ট বেসরকারি কুরিয়ার সংস্থায় চাকরি করেন। অফিস গিয়ে তাঁকেই তালা খুলতে হবে। কাজটা তাঁর নয়। কিন্তু অফিস খোলা-বন্ধ থেকে চা দেওয়ার দায়িত্ব যাঁর, তিনি থাকেন বারুইপুরে। সেখান থেকে বাসও চলছে না। ট্রেনও নেই। ফলে, অফিস খোলা-বন্ধ থেকে সবটাই করতে হচ্ছে বিশ্বজিৎবাবুকে। তাঁর কথায়, ‘‘অফিসের সামনে চায়ের দোকানটা পর্যন্ত বন্ধ। সরকার তো ঘোষণা করেছে চা-সিগারেটের দোকান খোলা রাখা যাবে। কিন্তু দোকান খুললেই পুলিশ এসে দোকান বন্ধ করে দিয়ে যায়। পুলিশের দাবি, কনটেনমেন্ট জোন।’’
বিশ্বজিৎবাবুর অফিসের পাশেই রয়েছে একটি ফুলের দোকান। সরকারি নির্দেশে একক দোকান খোলায় ছাড় আছে। কিন্তু দোকান খুলতে গেলেও লাগবে স্থানীয় থানার অনুমতি। তা-ও যদি মেলে, তার পরও দোকান খোলার বিশেষ ইচ্ছে নেই মালিকের। তাঁর দাবি, ‘‘রাস্তায় লোকজন নেই। দোকান খোলা রেখেই বা লাভ কী। খদ্দের তো থাকবে না। অযথা কারেন্ট পুড়িয়ে লাভ কী?’’
তাই তৃতীয় দফা পেরিয়ে চতুর্থ দফার লকডাউনে অনেক কিছু ছাড় ঘোষণার পরেও লকডাউনের ঘোর থেকে বেরতে পারেনি মানুষ। প্রতি দিনের জীবনে লকডাউনের প্রভাব আগের মতোই লম্বা ছায়া ফেলেছে।
আরও পড়ুন: ভিন্রাজ্যের নার্সরা ফিরে যাওয়ায় সঙ্কট, নয়া নিয়োগের বার্তা মুখ্যমন্ত্রীর
নিজের অভিজ্ঞতার কথাই বলেন ছোট মুদির দোকানদার পরেশ সাহা। উল্টোডাঙায় ছোট দোকান। লকডাউনের প্রথম দু’এক দিন ছাড়া তাঁর দোকান খোলা। কিন্তু তাতে কী? তাঁর কথায়, ‘‘প্রথম দফায় তো মালপত্রই পাচ্ছিলাম না। তার পর বাজার থেকে মালপত্র আনতে গিয়ে গাড়ি ভাড়া দিতে হল দেড় গুণ। পাইকারি বাজারে মালপত্র কিনতে গিয়েও অনেক সমস্যা। মাল বওয়ার লোক পাওয়া যায় না। যাঁরা আছেন তাঁরাও অনেক বেশি টাকা চাইছেন। ফলে আমাকেও অনেক বেশি দামে জিনিসপত্র বেচতে হচ্ছে।”
হিন্দুস্থান লিভারের এক হোলসেলারের দাবি, ‘‘মালপত্র যাঁরা দোকানে দোকানে নিয়ে যান, সেই কর্মচারীরাই তো আসতে পারছেন না। তা হলে কী ভাবে দোকানে মালপত্র দেব?”
আরও পড়ুন: ২১ মে থেকে খুলবে সব বড় দোকান, কারখানা খুলবে এক দিন অন্তর, ঘোষণা মমতার
বিশ্বজিৎবাবুর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন অমল বসু। তাঁর কথায়, ‘‘বাড়িতে থাকলে সে ভাবে কোনও সমস্যা নেই। কারণ মোটামুটি যা যা দরকার তা সবই পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি, প্লাম্বার থেকে ইলেকট্রিসিয়ানদেরও ডাকলে পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু বাড়ি থেকে বেরনো তো বন্ধ। ফলে রোজগারও বন্ধ।’’
স্বরূপ মজুমদার, পেশায় ছোট ব্যবসায়ী। তাঁর কথায়, ‘‘জিনিসপত্র পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু কিনতে গেলে তো পয়সা লাগে। যত ক্ষণ না ব্যাবসার কাজ শুরু হচ্ছে তত ক্ষণ সব কিছু পেয়েও তো লাভ নেই। আর ব্যবসার কাজ শুরু করতে গেলে বেরোতে হবে।”
অনেকটা একই অভিজ্ঞতা সল্টলেক সেক্টর ফাইভের এক খাবার সরবরাহকারী অ্যাপ সংস্থার ডেলিভারি বয় সনাতন রায়ের। তিনি বলেন, ‘‘রোজ বাইকের তেল পুড়িয়ে আসছি। কিন্তু অর্ডার কোথায়! প্রায় গোটা সেক্টর ফাইভ তো বন্ধ। লোকজন বাড়ি থেকে কাজ করছে। যাঁরা আসছেন, তাঁরাও খুব একটা বাইরের খাবার খাচ্ছেন না।” ফলে লকডাউনের ছাড়ের লাভ তাঁর কাছে পর্যন্ত পৌঁছচ্ছে না।
আরও পড়ুন: ফের বিতর্কে মেডিক্যাল, দেহ পড়ে আড়াই ঘণ্টা
সরকার ছাড় দিয়েছে ছোট খাবারের দোকান খোলার। কিন্তু তার পরেও সল্টলেক সেক্টর ফাইভ হোক বা ডেকার্স লেন, ছোট খাবারের দোকান বন্ধই। অফিস পাড়া বা শিয়ালদহের হোটেলও বন্ধ। শিয়ালদহে ভাতের হোটেল চালান শিবপ্রসাদ রায়। দোকানেই রয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘দোকান খুলে লাভ! খাবে কে? তা ছাড়া রান্নার ঠাকুর থেকে শুরু করে পরিচারক এবং অন্য কর্মচারীরা তো বাড়িতে।”
সোমবার মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন কন্টেনমেন্ট এলাকার বাইরে বড় দোকানও সব খুলবে। কিন্তু সেই দোকান খুলে লাভ কী? প্রশ্ন ব্যাবসায়ীদের। সোমবারই সোদপুরের দু’টি বড় জামাকাপড়ের দোকান খুলেছে। শহরের বিভিন্ন প্রান্তে খুলেছে কয়েকটি বড় ব্র্যান্ডের জামাকাপড়ের দোকান। কাঁকুড়গাছিতে সে রকমই একটি শোরুমের ম্যানেজার বলেন, ‘‘অধিকাংশ কর্মচারী আসতে পারছেন না। ক্রেতাও নেই। দোকান খোলাই সার।”
বাড়ির বাইরে নয়, সমস্যা বাড়ির মধ্যেও। লকডাউনের প্রথম দফায় অনেক আবাসনই পরিচারিকাদের ঢোকা বন্ধ করে দিয়েছিল। অনেক বাড়িতেও পরিচারিকা বা রান্নার কাজ যাঁরা করেন তাঁদের আসতে বারণ করা হয়েছিল। এখন করোনা-ভীতি কাটিয়ে তাঁদের আসতে দেওয়া হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে পরিচারিকারা যেতে পারলেও, অধিকাংশ জায়গাতেই পরিচারিকারা পৌঁছতে পারছেন না। যাঁরা দূর থেকে আসেন তাঁদের ক্ষেত্রে সমস্যা পরিবহণ। আবার অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে পরিচারিকারা যে এলাকায় থাকেন সেই জায়গা কন্টেনমেন্ট জোন। ফলে তাঁরা বেরোতে পারছেন না।
কোনও মতে দু’ঘণ্টা অফিসে কাটিয়েই ফেরার বাসের জন্য অপেক্ষা শুরু করেন বিশ্বজিৎবাবু। তিনি বলেন, ‘‘পরিবহণ যতক্ষণ না স্বাভাবিক হবে, তত দিন দোকানপাট খোলা রেখেও থমকে থাকবে মানুষের জীবন।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy