Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Migrant Labourer

‘২৯ দিন টানা হাঁটা, পায়ের যন্ত্রণায় ঘুম আসত না রাতে’

ময়ূরহাট-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্যের স্বামী। টানা ২৯ দিন ধরে হেঁটে বাড়ি ফিরেছেন তিনি।

ছবি: এপি।

ছবি: এপি।

সুস্মিত হালদার
কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০২০ ০২:৪১
Share: Save:

মাথার উপরে যেন আগুনের গোলার মতো জ্বলছে সূর্যটা।

সঙ্গে অসহ্য গরম। খিদে-তেষ্টায় শুকিয়ে আসছে গলা। একটু জল পাওয়া যাবে? মনে হচ্ছে এইবার প্রাণটা বেরিয়ে যাবে। টলে যাচ্ছে মাথা, বেসামাল পা। তা হলে কি আর ঘরে ফেরা হবে না? রাস্তাতেই সব শেষ হয়ে যাবে? দেখা হবে না বাড়ির মানুষগুলোর সঙ্গে?

প্রশ্নগুলো মাথায় ধাক্কা মারতেই গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ান বছর পঞ্চাশের মানুষটি। না, মনকে কোনও ভাবেই দুর্বল হতে দেওয়া যাবে না। আবার হাঁটতে শুরু করেন। সূর্য মাথায় নিয়ে আবার শুরু হয় পথচলা। সঙ্গে, পাশে, সামনে শ’য়ে-শ’য়ে মানুষ। বৃদ্ধ থকে শিশু— সকলে হেঁটে চলেছে। সেই ভিড়ে যেমন আছেন প্রসূতি মহিলা, আছেন কচি পায়ের শিশুও। সকলের গন্তব্য একটাই— বাড়ি। প্রিয়জনের কাছে ফিরতে হবে কয়েকশো মাইল হেঁটে।

সেই ভিড়ে ছিলেন হাঁসখালির বেনালির বাসিন্দা নারায়ণ বৈদ্যও। তিনি ময়ূরহাট-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্যের স্বামী। টানা ২৯ দিন ধরে হেঁটে বাড়ি ফিরেছেন তিনি।

হাঁটা শুরু করেছিলেন পুনের আম্বেদনগর থেকে। ১৮ এপ্রিল ভোররাতে কপাল ঠুকে বেরিয়ে পড়েছিলেন। আগের দিন স্থানীয় এক হার্ডওয়ারের দোকান থেকে তিনটে বিয়ারিং নিয়ে এসে কাঠের পাটাতনের নীচে লাগিয়ে নিয়েছিলেন। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে গেলে, পা দু’টো রাস্তার সঙ্গে আটকে গেলে তিনি সেই পাটাতনের উপরে বসে পড়ে হাত দুটো দিয়ে সেই পাটাতন রাস্তার উপরে ঠেলতে থাকতেন। কিন্তু এ ভাবেও বেশি ক্ষণ চলা যায় না। ব্যথা হয়ে যেত হাত।

পুণে থেকে রায়পুর পর্যন্ত খাওয়ার কষ্ট সে ভাবে হয়নি। রাস্তার পাশে অনেক মানুষ তাবু টাঙিয়ে খাবার নিয়ে বসে থেকেছেন। সঙ্গে ছিল পানীয় জল। অনেকে গাড়িতে করে খাবার নিয়ে ঘুরছেন। কেউ হাতে তুলে দিয়েছেন নগদ টাকা। কখনও রাতে ক্লান্তিতে রাস্তার পাশে, ধাবার সামনে ঘুমিয়ে পড়েছেন নারায়ণ। ভোর সাড়ে তিনটে থেকে আবার হাঁটা।

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অসহ্য গরম আর রোদ। তবুও থামা যাবে না। হাঁটতে হবে। তাঁকে যে পৌঁছতেই হবে বেনালির বাড়িতে। সেখানে তাঁর অপেক্ষায় দিন গুনছেন মা, বাবা, স্ত্রী-সন্তান। তিনি জানাচ্ছেন, রাস্তায় খাওয়া-ঘুম হলেও স্নান হত না। তিন- চার দিন অন্তর কোথাও ছোটখাট জলাশয় পেলে গা কোনও রকমে ভিজিয়ে নিতেন। তার পর আবার হাঁটা। কোনও কোনও দিন গা, হাত-পা যন্ত্রণায় ঘুম আসত না রাতে। তবু ভোরের আলো ফোটার আগেই আবার শুরু হত হাঁটা।

এ ভাবে ২৬ দিন চলার পর হঠাৎ এক দিন তাঁর সামনে দাঁড়ায় একটা কন্টেনার। দরজার ফাঁক দিয়ে মুখ বাড়িয়ে তাঁর নাম ধরে ডাকেন চেনা কণ্ঠ। তাঁর পাড়াতুতো ভাই শুভঙ্কর। সে-ও আসছেন পুনে থেকে। আগেই কলকাতাগামী কন্টেনার পেয়ে তাতে উঠে পড়েছিলেন। তাতে উঠে পড়েন নারায়ণ। মাঝে ধাবায় নেমে স্নান খাওয়াদাওয়া করে আবার যাত্রা শুরু। একটা সময়ে ওড়িশা সীমান্ত থেকে সাত-আট কিলোমিটার আগে তাঁদের দু’জনকে সেই কন্টেনার থেকে নামিয়ে দেন চালক। নিয়ে নেয় মোবাইল ফোন আর টাকা।

ফাঁকা পকেটে আবার যাত্রা শুরু হয়। মাঝে পুলিশ চৌকি থেকে তাঁদের একটা পাথর বোঝাই লরিতে তুলে দেওয়া হয়। ১৬ মে তাতে করে সাঁতরাগাছি পৌঁছন। এগিয়ে আসেন স্থানীয় সিপিএমের কয়েক জন। খাওয়ার ব্যবস্থা করে হাতে তুলে দেন চোদ্দোশো টাকা। যোগাযোগ করিয়ে দেন হাঁসখালির সিপিএম নেতা তথা কৃষ্ণগঞ্জ বিধানসভার প্রার্থী মৃণাল বিশ্বাসের সঙ্গে। মৃণালবাবু তাঁদেরকে একটা গাড়ি ভাড়া করে পাঠিয়ে দিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু ভাড়া পাঁচ হাজার টাকা। মৃণালবাবু যদিও জানিয়ে দেন, সেই টাকা তিনিই মেটাবেন।

ওই দিন বিকেলে তাঁরা দু’জন পৌঁছন হাঁসখালি, যেখানে অপেক্ষায় ছিলেন মৃণালবাবু। সেখান থেকে বগুলা গ্রামীণ হাসপাতাল। পরীক্ষার পরে হাঁসখালি কোয়রান্টিন সেন্টারে। সেখান থেকেই ফোনে নারায়ণ বলছেন, “অনেক কষ্ট করেছি। অনেক যন্ত্রণা সহ্য করেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাড়ি পৌঁছতে পেরে বড্ড ভাল লাগছে। তবে সবচেয়ে ভাল লাগছে যে, তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্যের স্বামীকে গাঁটের কড়ি খরচ করে ফিরিয়ে আনলেন সিপিএম নেতা। আসলে মানুষই আগে। পরে দল।”

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy