মুখ্যসচিবের সঙ্গে বৈঠক সেরে বেরোচ্ছেন কেন্দ্রের বিশেষ পর্যবেক্ষক দলের সদস্যেরা। সোমবার নবান্নে। —নিজস্ব চিত্র।
করোনাকে ঘিরেও সম্মুখসমরে কেন্দ্র-রাজ্য!
পশ্চিমবঙ্গের কিছু জেলায় লকডাউন ও করোনা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে পর্যবেক্ষকেরা যাচ্ছেন— স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক থেকে মুখ্যসচিবকে ফোন করে এ কথা জানানোর ১৫ মিনিটের মধ্যে রাজ্যে পা দিল দু’টি কেন্দ্রীয় দল। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ফোন এল আরও প্রায় তিন ঘণ্টা পরে!
কেন্দ্রীয় দলের একটি কলকাতা, হাওড়া, উত্তর ২৪ পরগনা ও পূর্ব মেদিনীপুরের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখবে। অন্য দলটি যাবে দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি ও কালিম্পঙে। এ ছাড়া আরও চারটি দল গঠন করেছে কেন্দ্র। দু’টি যাবে মহারাষ্ট্রের মুম্বই ও পুণেতে। একটি করে দল যাবে মধ্যপ্রদেশের ইনদওর এবং রাজস্থানের জয়পুরে।
আরও পড়ুন: করোনা আক্রান্তের মধ্যে উপসর্গ না থাকলেই ভয় বেশি!
কিন্তু কিসের ভিত্তিতে কেন্দ্র এ রাজ্যের সাতটি জেলার করোনা-পরিস্থিতি সরেজমিন খতিয়ে দেখতে দল পাঠাল, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে নবান্ন। খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টুইট করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের কাছে এই ঘটনার ব্যাখ্যা চেয়ে বলেছেন, যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া ওই সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর সঙ্গে খাপ খায় না। এই ব্যাখ্যা না-পাওয়া পর্যন্ত রাজ্য সরকার এ বিষয়ে এগোতে পারবে না বলেও জানিয়ে দেন তিনি। পাশাপাশি, মোদীকে পাঠানো তিন পাতার চিঠিতে মমতা বলেছেন, আগে থেকে আলোচনা না-করে এমন পদক্ষেপ সরকার পরিচালনার প্রতিষ্ঠিত রীতিনীতির বিরোধী।
কোভিড-১৯ সঙ্কট মোকাবিলায় সব রকম গঠনমূলক সহযোগিতা এবং পরামর্শকে স্বাগত জানাচ্ছি, বিশেষ করে কেন্দ্রীয় সরকারের। কিন্তু কিসের ভিত্তিতে দেশের নির্দিষ্ট কিছু জেলায়, যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গেরও কয়েকটি রয়েছে, ওই দল পাঠানো হচ্ছে, তা স্পষ্ট নয়। বিষয়টি স্পষ্ট করতে প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরোধ করছি। যত ক্ষণ তা না হচ্ছে, আমরা কোনও ভাবেই এটা নিয়ে এগোতে পারব না। এটা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিপন্থী। —মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
তৃণমূল নেতৃত্বের অভিযোগ, রাজনৈতিক কারণেই পরিকল্পিত ভাবে নিশানা করা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গকে। দলের যুক্তি, গোটা দেশের ৩৭০টি জেলাকে ‘হটস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অথচ পর্যবেক্ষণের জন্য রাজ্যের যে-সাতটি জেলাকে বেছে নেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে জলপাইগুড়ি ও কালিম্পঙে গত ১৪ দিন কোনও সংক্রমণ হয়নি বলে গত কালই জানিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক। লকডাউন না-মানা এবং পরিস্থিতির গভীরতা সম্পর্কে কেন্দ্রের ধারণা তথ্যনির্ভর নয় বলে দাবি করে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর চিঠিতে জানিয়েছেন, কালিম্পঙে করোনা-আক্রান্ত হওয়ার খবর শেষ পাওয়া গিয়েছে ২ এপ্রিল। জলপাইগুড়িতে ৪ এপ্রিল। দার্জিলিঙেও ১৬ এপ্রিলের পরে আর নতুন করে আক্রান্তের খবর নেই। পূর্ব মেদিনীপুরে গত দু’দিনে কেউ করোনায় আক্রান্ত হননি। কেন্দ্রের বিভিন্ন মন্ত্রকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে রাজ্য প্রশাসন সক্রিয় ভাবেই লকডাউন কার্যকর করছে বলে প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তৃণমূল সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘নাকের ডগায় দিল্লিতে ক’টা দল গিয়েছে? উত্তরপ্রদেশ, গুজরাতে ক’টা দল গিয়েছে? বেছে বেছে বিরোধী রাজ্যকে নিশানা করা হচ্ছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভাল কাজ করছেন, সেটাই ওঁদের গাত্রদাহের কারণ।’’
তৃণমূলের বক্তব্য, গোটা দেশের করোনা-তালিকায় পশ্চিমবঙ্গের স্থান ১৩ নম্বরে। তিন নম্বরে রয়েছে গুজরাত। সাত নম্বরে উত্তরপ্রদেশ। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা এবং গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি— এই দুই নিরিখেই পশ্চিমবঙ্গের থেকে এগিয়ে রয়েছে বিজেপি-শাসিত এই দুই রাজ্য। অথচ সেখানে পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর প্রয়োজন অনুভব করেনি কেন্দ্র। কেন, তার কোনও ব্যাখ্যাও দেয়নি। মধ্যপ্রদেশে দল পাঠানো হলেও সেখানে সদ্য ক্ষমতায় এসেছে বিজেপি। করোনা-পরিস্থিতির জন্য এখনও আগের কংগ্রেস সরকারকেই দুষে চলেছে তারা।
নজরে যে-সব জেলা
দার্জিলিং
• আক্রান্ত ৪ জন • মৃত্যু নেই • ছাড়া পেয়েছেন ৪
• কোয়রান্টিনে ৫৬ • ছাড়া পেয়েছেন শতাধিক
কালিম্পং
• আক্রান্ত ৭ • মৃত ১
• সুস্থ হয়ে ছাড়া পেয়েছেন ৬ • কোয়রান্টিনে ১৬
• ছাড়া পেয়েছেন ৪৬ • গৃহ পর্যবেক্ষণে ৬৮
• ছাড়া পেয়েছেন ৬৩২
জলপাইগুড়ি
• আক্রান্ত ৪ • মৃত্যু নেই
• ছাড়া পেয়েছেন ৪ • কোয়রান্টিনে ২৩
• ছাড়া পেয়েছেন ৯৩ • গৃহ পর্যবেক্ষণে ৪০৮০
• ছাড়া পেয়েছেন ৫৪৬৮
হাওড়া
• অ্যাক্টিভ করোনা পজ়িটিভ ৫৯ • মৃত্যু ৭
• সুস্থ হয়ে ছাড়া পেয়েছেন ২
• ডুমুরজলা আইসোলেশন কেন্দ্রে রয়েছেন ১১০
পূর্ব মেদিনীপুর
• আক্রান্ত ১৮ • সুস্থ হয়ে ছাড়া পেয়েছেন ১৪
• মৃত্যু: তথ্য নেই
তথ্য সূত্র: রাজ্য সরকার
উত্তর চব্বিশ পরগনা ও কলকাতার কোনও তথ্য সরকারি সূত্রে পাওয়া যায়নি।
কেন্দ্রের অবশ্য পাল্টা বক্তব্য, যে সাতটি জেলায় কেন্দ্রীয় দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে, তার সব ক’টির অবস্থাই উদ্বেগজনক। লকডাউনের শুরু থেকেই এ রাজ্যে নিয়ম মানা হচ্ছে না বলে রিপোর্ট পাঠাচ্ছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। এ নিয়ে একাধিক বার রাজ্যকে সতর্ক করা হয়েছে। অথচ, সুপ্রিম কোর্ট তার পর্যবেক্ষণে বলেছে, করোনা-নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রের নির্দেশ সমস্ত রাজ্যকে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে হবে। এই পর্যবেক্ষণকে নির্দেশ হিসেবে গণ্য করার কথাও বলেছে শীর্ষ আদালত। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের যুগ্মসচিব পুণ্যসলিলা শ্রীবাস্তব আজ জানান, রাজ্যগুলিকে সাহায্য করার জন্য অনেক ভেবেচিন্তেই ওই আন্তঃমন্ত্রক দল গঠন করা হয়েছে। ওই দল স্বাস্থ্য, প্রশাসনিক ও বিপর্যয় মোকাবিলার প্রশ্নে রাজ্যগুলিকে সাহায্য করবে। কিন্তু যে ভাবে কার্যত বিনা নোটিসে রাজ্যে দল পাঠিয়েছে কেন্দ্র, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে নবান্ন। এ দিন সকাল সওয়া দশটায় বিশেষ মালবাহী বিমানে কলকাতায় আসেন কেন্দ্রের দুই পর্যবেক্ষক দলের দশ সদস্য। এঁদের মধ্যে পাঁচ জন বিমানবন্দর থেকে চলে যান বিএসএফ-এর এডিজি-র অফিসে। অন্য পাঁচ জন সেই বিমানেই রওনা দেন শিলিগুড়ি। সেখানে গিয়ে ওঠেন এসএসবি-র অতিথিশালায়। পরে তাঁরা জলপাইগুড়ি যান।
এ প্রসঙ্গে নবান্নে রাজ্যের মুখ্যসচিব রাজীব সিংহ বলেন, ‘‘কেন্দ্র এই দল পাঠানোর কথা জানানোর ১৫ মিনিটের মধ্যে দলের সদস্যেরা রাজ্যে এসে গিয়েছেন। তাঁরা কোথাও বিএসএফ, কোথাও এসএসবি-কে সঙ্গে নিয়ে ফিল্ডে গিয়েছেন। এতে ওদের ইন্টারনাল সার্কুলার লঙ্ঘিত হয়েছে। আমাদের সঙ্গে কথা বলে, তথ্য নিয়ে দরকার পড়লে ফিল্ডে যেতে পারতেন। এমন ভাব করা হচ্ছে, যেন আমরা কিছু লুকোচ্ছি!’’
আরও পড়ুন: মাথাপিছু ১ হাজার টাকা, পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য ‘স্নেহের পরশ’ রাজ্যের
কেন্দ্রীয় দল সকাল সওয়া দশটায় রাজ্যে এসে গেলেও বেলা একটা নাগাদ মুখ্যমন্ত্রীকে ফোন করে সে কথা জানান অমিত শাহ। অথচ কেন্দ্রীয় দল রাজ্যে এলে তাদের থাকা-খাওয়া, যাতায়াতের ব্যবস্থা রাজ্যই করে থাকে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে রাজ্যকে কার্যত অন্ধকারে রেখে তারা বিএসএফ এবং এসএসবি-র সাহায্য নেওয়ায় নবান্ন ক্ষুব্ধ। সে কথা উল্লেখ করে মুখ্যমন্ত্রী মোদীকে লিখেছেন, এলাকা পরিদর্শনের আগে কেন্দ্রীয় দল রাজ্য সরকারের বক্তব্য শুনবে, এটাই প্রত্যাশিত ছিল। ইতিমধ্যে কলকাতায় থাকা কেন্দ্রীয় দলটিকে নবান্নে ডেকে পাঠান মুখ্যসচিব। উত্তরবঙ্গে যাওয়া দলটির সঙ্গে ফোনে কথা বলার নির্দেশ দেন। বলেন, ‘‘যত ক্ষণ পর্যন্ত না-বুঝছি কী প্রয়োজন, কী কারণে ওঁরা এসেছেন, তত ক্ষণ ঘুরতে দেব না। এখন যে ঘুরছেন, উচিত কাজ করছেন না।’’ এ দিন সন্ধ্যায় নবান্নে মুখ্যসচিবের সঙ্গে দেখা করতে যান কলকাতায় থাকা কেন্দ্রীয় দলের সদস্যেরা। তাঁদের মধ্যে দীর্ঘ বৈঠক হয়। এরই মাঝে নবান্নে যান কলকাতার মেয়র তথা পুরমন্ত্রী ববি হাকিম। নবান্ন থেকে বেরনোর সময় অবশ্য সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেননি কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিরা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রে বলা হচ্ছে, কেন্দ্রীয় দলগুলি মূলত জরুরি পণ্য সরবরাহ, দূরত্ব পালন, স্বাস্থ্য পরিকাঠামো, পরীক্ষা-কিট ও মাস্ক-গ্লাভসের সরবরাহ ও ত্রাণশিবিরগুলির পরিস্থিতি খতিয়ে দেখবে। রাজ্যের পাল্টা বক্তব্য, কেন্দ্রে কাছে বারবার চেয়েও প্রয়োজনীয় উপকরণ ও সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। মুখ্যসচিবের কথায়, ‘‘কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিরা যদি রাজ্যের প্রয়োজনমতো উপকরণ ও ওষুধ জোগান দিতে পারতেন, তা হলে আমরা তাঁদের স্বাগত জানাতাম।’’
কোন দলে কে। দক্ষিণবঙ্গে পরিদর্শক দলের নেতৃত্বে রয়েছেন প্রতিরক্ষা দফতরের অতিরিক্ত সচিব অপূর্ব চন্দ্র। সদস্য হিসেবে রয়েছেন এনডিএমএ-র যুগ্মসচিব রমেশ কুমার গান্টা, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আর আর পতি, উপভোক্তা বিষয়ক দফতরের প্রধান সীতারাম মিনা, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকের উপসচিব জাইল সিংহ ভিকল। উত্তরবঙ্গের দলের নেতৃত্বে আছেন মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের অতিরিক্ত সচিব বিনীত জোশী। সদস্য হিসেবে আছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ শিবানী দত্ত, এনডিএমএ-র অজয় গাঙ্গোয়ার, উপভোক্তা দফতরের প্রধান ধর্মেশ মাকওয়ানা, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকের উপসচিব এন বি মণি।
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy