Advertisement
২৭ নভেম্বর ২০২৪
Coronavirus

পার্কে? যায়নি ।। সিনেমা? যায়নি ।। শপিং মল? যায়নি

আমাদেরও কিছু কথা আছে। মুখ খুললেন অক্সফোর্ড পড়ুয়া করোনা-রোগীর ডাক্তার বাবা। একমাত্র আনন্দবাজার ডিজিটালে।

করোনা আতঙ্কে বিমানবন্দর

করোনা আতঙ্কে বিমানবন্দর

শ্যামল ঘোষ
শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০২০ ২১:০০
Share: Save:

সাফ বলে দেওয়াই ভাল।

ছেলের চিকিৎসার ব্যাপারে কোনও গাফিলতিই করিনি— যদিও কোনও উপসর্গ ছিল না।
লন্ডন থেকে ফেরার আগে ও নিজেকে আইসোলেট করে রেখেছিল। এখানে এসেও।
বাড়ি আর হাসপাতালের বাইরে যায়নি। শপিং মলে যাওয়ার প্রশ্নই নেই।
আমার স্ত্রী নবান্নে কিছু ক্ষণের জন্য গিয়েছিলেন। সেই সময় আমাদের ছেলে নবান্নে কার পার্কিংয়ে গাড়িতে বসে ছিল। এটা হয়তো ঠিক হয়নি, মানছি।
এ ছাড়া আমাদের কোনও গাফিলতি হয়নি।
আমি আমার ছেলের সংস্পর্শে আসিনি।

এ বার আসা যাক আমাদের কাহিনিতে।

গত ১৫ মার্চ ভোর তিনটের সময় কলকাতা বিমানবন্দরে নামে আমাদের ছেলে। মুখে মাস্ক পরা অবস্থাতেই সে টার্মিনাল থেকে বেরিয়েছিল। কোথাও কোনও কিছু টাচ করেনি। যে হেতু এয়ারপোর্টের দরজাটা আপনা থেকেই সরে যায়, তাই টাচ করার প্রয়োজনও পড়েনি। আমার স্ত্রী বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে দুটো মাস্ক ছিল। আমাদের ড্রাইভারও মাস্ক পরে ছিলেন। ছেলে গাড়ির পিছনের সিটে বসেছিল। মা-কে বলেছিল, তুমি সামনের সিটে বোসো। আমার পাশে বসবে না।

তার পর ওরা বাড়িতে ফিরে আসে। বিমানবন্দরে কিন্তু ও থার্মাল সেন্সারের ভিতর দিয়ে গিয়েছিল। কারণ, ওটা বাধ্যতামূলক। সবাইকেই থার্মাল সেন্সারের ভিতর দিয়ে যেতে হচ্ছিল। ওর শরীরে কিন্তু কোনও উপসর্গ ছিল না। কোনও জ্বর ছিল না। ইনফ্যাক্ট, এত দিন ধরেও ওর কোনও জ্বর নেই। একেবারে উপসর্গহীন। কখনই ওকে হোম কোয়রান্টিন করতে কোথাও বলা হয়নি। নিজে সাবধান হওয়ার জন্য এবং যে হেতু অক্সফোর্ডে একটা বা দুটো কেস হয়েছিল, নিজে সাবধান হওয়ার জন্য ও নিজেকে এ রকম আইসোলেট করেছিল।

আমার স্ত্রী যেখানে থাকে কলকাতায়, সেটা একটা বড় কমপ্লেক্স। বিমানবন্দর থেকে বাড়ি যাওয়া, লিফ্টের বাটন প্রেস থেকে দরজা খোলা— সবটাই আমার স্ত্রী করেছেন। ছেলে কোথাও কিছুই ছোঁয়নি। এর পর ও সোজা নিজের ঘরে ঢুকে গিয়েছে। ওর আলাদা ঘর আছে। এবং আলাদা টয়লেটের বন্দোবস্তও করা হয়েছিল। ও স্ট্রিক্টলি আমার স্ত্রীকে বলে দিয়েছিল, ওই টয়লেটে দ্বিতীয় কেউ যেন না ঢোকে। ১৫ তারিখেই আমার স্ত্রী ওকে ডাক্তার দেখানোর চেষ্টা করেন। যে হেতু সরকারি হাসপাতালেই যেতে হত, আমার স্ত্রী চেষ্টা করেও সেটা করতে পারেননি। এখানে বলে রাখা ভাল, ডাক্তার দেখানোর কথা কেউ আমাদের বলেননি। ওর কোনও উপসর্গও ছিল না।

আমি কৃষ্ণনগরে থাকি। ছেলে আসছে বলে ১৫ তারিখ বিমানবন্দরে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার স্ত্রী আমাকে জানান, যাওয়ার প্রয়োজন নেই। কারণ, ছেলে নিজেকে আইসোলেশনে রাখতে চাইছে। তবুও বাবার মন। তাই আমি ওই দিন বিকেলে কলকাতার ফ্ল্যাটে যাই। ওর ঘরের দরজাটা ঠেলে, ফাঁক দিয়ে মুখটা ঢুকিয়ে ওকে দেখি। কয়েক মুহূর্ত পর দরজা বন্ধ করে দিই। কিছু ক্ষণের মধ্যে আমি ফের কৃষ্ণনগরে ফিরে যাই। ওখানে গিয়ে কয়েক জন রোগীও দেখি। একে তো আমার ছেলের কোনও উপসর্গ ছিল না, তার উপর আমি ওর সঙ্গে কোনও রকমের সংস্পর্শে যাইনি— ফলে, রোগী দেখে কোনও ভুল করছি বলে তখন মনে হয়নি।

আমরা কিন্তু ছেলেকে ডাক্তার দেখাতে চেয়েছিলাম। ও নিজেও ভীষণ কনসার্নড ছিল। কী হয়েছে বা আদৌ হয়েছে কি না ও নিজেও সেটা নিশ্চিত হতে চাইছিল। কারণ, অক্সফোর্ডে ওদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বড় গেট টুগেদার হয়। সেখানে অনেক লোক জড় হয়েছিলেন। সেটা মার্চের ৬ তারিখ। পরে ও জানতে পারে, ওখানে উপস্থিত ওর কলেজেরই একটি মেয়ের করোনা-পজিটিভ এসেছে। তার পর থেকে ও লন্ডনে থাকাকালীনই নিজেকে আইসোলেশনে রাখতে শুরু করে। ১৫ তারিখ বাড়িতে সে ভাবেই ছিল। এর পর ১৬ তারিখ বেলা সাড়ে ১২টায় বাঙুর হাসপাতালে আমার স্ত্রী ছেলেকে নিয়ে গিয়েছিলেন। ছেলে তখনও মাস্ক পরে ছিল। ড্রাইভারও মাস্ক পরে ছিলেন। ওখানে যাওয়ার সময় আমার স্ত্রী সামনের সিটে বসেছিলেন। বাঙুর হাসপাতালে ওরা সারা ক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। বসেনি পর্যন্ত। বসলে কোথাও যদি টাচ লাগে!

আরও পড়ুন: আমলা পুত্রের মতোই ‘বেপরোয়া’ বিলেতফেরত তরুণী, আতঙ্ক দক্ষিণের অভিজাত আবাসনে

এর পর সেখানে ডাক্তার দেখেছেন ওকে। ওর কোনও রকম উপসর্গ পাননি। ওকে জিজ্ঞেস করা হয়, কোনও কিছু সমস্যা আছে কি না? ও বলে, গলাটা মনে হচ্ছে কেমন একটু লাগছে। ধরা ধরা। কাশতে বলা হলে, ওর কাশিটাশি কিছুই হয়নি। তার পরে ওখানকার চিকিৎসক আমার স্ত্রীকে বলেন, তাঁদের হাসপাতালে ইনফ্রাস্ট্রাকচার নেই। তাই আইডি হাসপাতালে ওকে নিয়ে যেতে বলা হয়। তখন দুপুর প্রায় ১টা বেজে গিয়েছে। বাঙুর হাসপাতালের ওই চিকিৎসক তখন আইডি হাসপাতালে করোনা সংক্রান্ত বিষয়ের যিনি ইনচার্জ, তাঁকে আমার স্ত্রীর সামনেই ফোন করেন। আমার স্ত্রীকে জানানো হয়, সে দিনের মতো স্যাম্পল নেওয়া শেষ হয়ে গিয়েছে। ১টা পর্যন্ত লালারসের স্যাম্পল নেওয়া হয়। তখন আর ওখানে গিয়ে স্যাম্পল দেওয়া যেত না। এর পর ছেলেকে নিয়ে আমার স্ত্রী ওখান থেকে বেরিয়ে যান।

আমার স্ত্রী-র এক ব্যাচমেট স্বাস্থ্যভবনে আছেন। তাঁকে উনি ফোন করে বিষয়টি বলেন। তিনিও বেলেঘাটা আইডি-তে ফোন করে জানতে পারেন, বাঙুর থেকে ফোন করা হয়েছিল। পরের দিন অর্থাৎ ১৬ তারিখ আমার ছেলেকে যেতে বলা হয়েছে, সকাল সাড়ে ৯টায়।

বাঙুরে যখন আমার স্ত্রী ডাক্তারের চেম্বারে, তখন তাঁর কাছে অনেক বার ফোন আসে। একটা জরুরি বৈঠক ডাকা হয়েছিল সে দিন। অফিসাররা এসে বসেছিলেন। অনেক বার ফোন করা হয়েছিল। আমার স্ত্রীর প্ল্যান ছিল, ছেলেকে বাড়িতে রেখে তবে যাবেন। কিন্তু এত বার করে ডাকাডাকি করা হচ্ছিল যে, উনি তখন ছেলেকে নিয়েই নবান্নে যান। আবারও বলছি, ছেলের কিন্তু কোনও উপসর্গ ছিল না। আমাদের মনে হয়েছিল, তার থেকে বড় কথা ছেলেই চাইছিল, সবটা না জানা পর্যন্ত আইসোলেশনে থাকা। তাই ও ডাক্তার দেখানো ছাড়া আর কারও সঙ্গে মেশেনি। কোনও কিছুই ছোঁয়নি। কোথাও যায়ওনি। যদি কোনও উপসর্গ থাকত, তা হলে ওকে নিয়ে নবান্নে যেতেন না আমার স্ত্রী।

তিনি সোজা নবান্নের ১৩ তলায় যান। কিছু ক্ষণের মধ্যে বৈঠক সেরেই আবার গাড়িতে করে ছেলেকে নিয়ে বাড়িতে চলে আসেন। ছেলে তত ক্ষণ নবান্নের কার পার্কিংয়ে গাড়ির ভিতর বসে ছিল। গাড়ির পিছনের সিটে। ফেরার সময়েও আমার স্ত্রী সামনের সিটে বসেন।

আরও পড়ুন: কোয়রান্টিন নয়, ছুটির মেজাজে সবার সঙ্গেই বিদেশ-ফেরত অভিষেক, দেবেন ভাষণও!

বলে রাখি, আমার ছেলে বা স্ত্রী কিন্তু কোনও পার্কে যায়নি, কোনও রেস্তরাঁতে যায়নি, কোনও শপিং মলে যায়নি, কোনও সিনেমা থিয়েটার, ক্লাব কোথাও যায়নি। সে সবের কোনও প্রশ্নই ওঠে না।

বাঙুর আর নবান্নের ব্যাপারটা ছিল ১৬ তারিখ। পরের দিন অর্থাৎ ১৭ তারিখ সকাল সাড়ে ন’টা বাজার আগেই আমার স্ত্রী ছেলেকে নিয়ে আইডি হাসপাতালে পৌঁছে যান। ওঁরা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ছেলের নাম-ঠিকানা সব নিয়ে নেওয়া হয়। ছেলেকে সঙ্গে সঙ্গে ভর্তিও করে নেয় ওরা। সকাল সাড়ে ৯টায় গিয়েছিলেন আমার স্ত্রী ছেলেকে নিয়ে। ১০টার মধ্যে সব ফর্মালিটিস মিটে যায়। আমার স্ত্রীর সামনেই ওর লালারস নেওয়া হয়। এর পর আমার স্ত্রী বাড়ি চলে আসেন। কারণ, তাঁকে বলা হয় ওখানে ওঁর কোনও ভূমিকা নেই। তার পর ওই দিন রাত ৯টা বাজতে ১০ নাগাদ আমাদের জানানো হয়, ছেলের কোভিড-১৯ পজিটিভ এসেছে। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে কোয়রান্টিনে চলে যেতে বলা হয়।

আমরা এখন কোয়রান্টিনেই আছি।

এই হল আমাদের কথা। আমাদের ভুল বুঝবেন না প্লিজ!

(রাজ্যের প্রথম করোনা-আক্রান্তের বাবা)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Kolkata Coronavirus in India
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy