Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Coronavirus

নিয়ম ভাঙছেন সমাজের প্রথম সারির ওঁরা, বিমানবন্দরেই ফস্কা গেরো

কলকাতা বিমানবন্দরে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশিকা মেনে গত ১৭ জানুয়ারি থেকে প্রথম স্ক্রিনিং শুরু হয়।

বিমানবন্দরে মুখোশবিহীন মিমি, অন্যদিকে মুখোশ পরিহিত জিৎ।

বিমানবন্দরে মুখোশবিহীন মিমি, অন্যদিকে মুখোশ পরিহিত জিৎ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০২০ ২২:১৫
Share: Save:

এ দেশে এখনও পর্যন্ত যাঁদের দেহে করোনাভাইরাসের প্রমাণ মিলেছে, তাঁদের প্রায় সকলেই দু’ভাবে আক্রান্ত হয়েছেন। হয় তাঁরা কোভিড-১৯ ছড়িয়েছে এমন দেশ ঘুরে এসেছেন, নয়তো সে দেশ থেকে ঘুরে আসা করোনা-আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেছেন। সে কারণে প্রথম থেকেই কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের উপর নজরদারিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিদেশ থেকে যাঁরা এ দেশে আসছেন, তাঁদের বেশির ভাগই বিমানপথে এসেছেন। ফলে, বিমানবন্দরকেই করোনাভাইরাস রোখার প্রাথমিক চেক পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।

এ রাজ্যের ক্ষেত্রে কলকাতা, অন্ডাল এবং বাগডোগরা— সে রকমই তিনটি প্রাথমিক চেক পয়েন্ট। ওই চেক পয়েন্ট কতটা কার্যকরী? আদৌ কি বিদেশ থেকে ফেরা সবাইকে সঠিক ভাবে চিহ্নিত করে শ্রেণি বিভাগ করা সম্ভব হচ্ছে রাজ্যের ওই তিন বিমানবন্দরে? প্রশ্নটা উঠছে, কারণ রাজ্যের এক আমলার ছেলে, যাঁর দেহে করোনার প্রমাণ মিলেছে, তিনি বিমানবন্দর থেকে সোজা বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। পরে শহরের অন্যান্য জায়গাতেও ঘুরে বেড়ান। আবার এ দিন লন্ডন থেকে কলকাতা ফিরেছেন অভিনেত্রী-সাংসদ মিমি চক্রবর্তী। ফিরেছেন অভিনেতা জিৎ-সহ অনেক কলাকুশলী। মিমি-জিৎ দু’জনেই নিজেদের বাড়িতে আইসোলেশনে থাকার কথা ঘোষণা করেছেন। কিন্তু তাঁর আগে তাঁদের দেখা যায় বিমানবন্দর চত্বরে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে। জিতের মুখে মাস্ক থাকলেও মিমির মুখে সে সব কিছুই ছিল না। আর সেখানেই প্রশ্নটা উঠছে, বিমানবন্দরে ঠিক কী পদ্ধতিতে বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের চিহ্নিত করা হচ্ছে?

কলকাতা বিমানবন্দরে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশিকা মেনে গত ১৭ জানুয়ারি থেকে প্রথম স্ক্রিনিং শুরু হয়। সেই সময় করোনাভাইরাসের গতিবিধি সীমাবদ্ধ ছিল শুধুমাত্র চিনেই। তাই চিন এবং হংকং ঘুরে আসার ইতিহাস আছে এমন যাত্রীদের থার্মাল স্ক্রিনিং শুরু করা হয়। সেই স্ক্রিনিংয়ে যাঁদের দেহের তাপমাত্রা নির্ধারিত মাত্রার বেশি হয় অথবা করোনাভাইরাসের উপসর্গ দেখা যায়, চিকিৎসকদের পরামর্শ নিতে তাঁদের পাঠানো হচ্ছিল বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে। এর পর এই তালিকায় যুক্ত হতে থাকে একের পর এক দেশের নাম।

আরও পড়ুন: করোনা আক্রান্ত তরুণের বাবা-মা-চালকের সংক্রমণ নেই, রিপোর্ট নাইসেডের

গত ২ ফেব্রুয়ারি ওই তালিকায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশের নাম যুক্ত হয়। বিমানবন্দরে থার্মাল স্ক্রিনিংয়ের দায়িত্বে থাকা এক আধিকারিক জানান, আন্তর্জাতিক বিমানের যাত্রীদের উড়ানের ভিতরেই দু’টি সেল্ফ ডিক্ল্যারেশন ফর্ম দেওয়া শুরু হয়। সেখানে যাত্রীদের জানাতে বলা হয় তাঁদের ভ্রমণের ইতিহাস অর্থাৎ কোথায় কোথায় তাঁরা গিয়েছেন। এবং অন্যটিতে জানাতে বলা হয়, তাঁদের কোনও শারীরিক সমস্য হচ্ছে কি না? ওই ডিক্ল্যারেশন ফর্মের সঙ্গে পাসপোর্টে পাওয়া তথ্য মিলিয়ে যাত্রীদের থার্মাল স্ক্রিনিং করা শুরু হয়। ওই আধিকারিক বলেন, ‘‘কোনও ধরনের উপসর্গ ধরা না পড়লে আমরা বাড়িতে ১৪ দিন পর্যবেক্ষণের নির্দেশ দিচ্ছিলাম। উপসর্গ থাকলে সরাসরি হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছিল। বিশেষত বয়স্ক যাত্রীদের আমরা চিকি‌ৎসকের কাছেই পাঠাচ্ছিলাম।’’

আরও পড়ুন: কাল থেকে বিকেল চারটেয় ছুটি সরকারি অফিস, বিজ্ঞপ্তি জারি নবান্নের

তবে পরিস্থিতি আমূল বদলে যায় মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে। পশ্চিম এশিয়া, আমেরিকা এবং ইউরোপের একের পর এক দেশে করোনাভাইরাস ছড়ানো শুরু হওয়ায় কড়াকড়ি বাড়ে বিমানবন্দরে। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে যাত্রীদের চাপও। সেল্ফ ডিক্ল্যারেশন ফর্মে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রথমে দু’টি শ্রেণিতে ভাগ করা হয় যাত্রীদের। যাঁদের উপসর্গ রয়েছে এবং যাঁদের উপসর্গ নেই। যাঁদের থার্মাল স্ক্রিনিংয়ে পজিটিভ পাওয়া গিয়েছে এবং উপসর্গ রয়েছে তাঁদের বাধ্যতামূলক ১৪ দিনের কোয়রান্টিনে পাঠানো হয়। যাঁদের কোনও উপসর্গ নেই তাঁদেরও নিজেদের বাড়িতে পর্যবেক্ষণে থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয় ১৪ দিনের জন্য। কিন্তু গত সোমবার থেকে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব হয়েছে এমন দেশ থেকে কেউ এলেই তাঁকে কোয়রান্টিনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। যদিও স্বাস্থ্য কর্তারা জানিয়েছেন, সেটা অতিরিক্ত সতর্কতা হিসাবেই।

আরও পড়ুন: ‘ঘোর কলি, প্রতি ১০০ বছরে এমন মহামারি আসে’, মন্তব্য সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির

এতো গেল আন্তর্জাতিক বিমানের যাত্রীদের ক্ষেত্রে। অন্তর্দেশীয় বিমানের যাত্রীদের ক্ষেত্রে? বিমানবন্দর সূত্রে খবর, মঙ্গলবারের আগে কলকাতা বিমানবন্দরে অন্তর্দেশীয় বিমানের যাত্রীদের কোনও স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা ছিল না। মঙ্গলবার থেকে থার্মাল স্ক্রিনিং করা শুরু হয়েছে। তা-ও সবাইকে করা যাচ্ছে এমন নয়— স্বীকার করে নিচ্ছেন স্বাস্থ্য কর্তারা। বিমানবন্দরের আধিকারিকরাও জানাচ্ছেন, কেউ যদি আমেরিকা বা ইউরোপ থেকে দেশের অন্য কোনও বিমানবন্দরে এসে পৌঁছন এবং তার পর ক’দিন কাটিয়ে অন্তর্দেশীয় বিমানে কলকাতা আসেন, তা হলে তাঁকে চিহ্নিত করার কোনও উপায় নেই। করোনা ছড়িয়ে পড়া কেরল বা মহারাষ্ট্র থেকে ওই ভাইরাস আক্রান্ত কোনও ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা কোনও ব্যক্তি যদি কলকাতা বিমানবন্দরে এসে পৌঁছন, উপায় নেই তার ক্ষেত্রেও।

অর্থাৎ প্রথম চেক পয়েন্টেই রয়েছে অনেক ফাঁকফোকর। আর আছে ভিআইপিদের দাপট। কলকাতা বিমানবন্দরের এক আধিকারিক এ দিন বলেন, ‘‘আজ সকালের বদলে যদি বিকেল সাড়ে পাঁচটার পর জিৎ এবং মিমি চক্রবর্তী ইংল্যান্ড থেকে কলকাতায় আসতেন তা হলে তাঁদের বাধ্যতামূলক রাজারহাট বা বারাসতের কোয়রান্টিন সেন্টারে যেতে হত ১৪ দিনের জন্য। এমনটাই নির্দেশ কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের। মিমি, জিৎ ছাড়াও এ দিন লন্ডন থেকে ফিরেছেন আরও অনেক অভিনেতা এবং কলাকুশলী। তাঁদেরকেও বাড়িতে পর্যবেক্ষণে থাকতে বলা হয়েছে।

আর এখানেই প্রশ্ন, যাঁদের আইসোলেশনে যেতে বলা হচ্ছে তাঁরা কতটা সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে স্বাস্থ্য বিধি মানছেন? তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ রাজ্যের এক আমলা পুত্র। যিনি আইসোলেশনে যাওয়ার পরিবর্তে রীতিমতো ঘুরে বেড়িয়েছেন গোটা শহরে। প্রশ্ন উঠেছে মিমি চক্রবর্তীকে নিয়েও। তিনি নিজের বাড়িতে আইসোলেশনে থাকার ঘোষণা করেছেন। কিন্তু তাঁর আগে তাঁকে দেখা যায় বিমানবন্দর চত্বরে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে। তাঁর মুখে কোনও মাস্কও ছিল না। স্বাস্থ্য দফতরের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মানলে বাইরে এসে কারওর সংস্পর্শে আসা উচিৎ হয়নি।” তাঁর সঙ্গী জিতের মুখে মাস্ক থাকলেও তিনিও চলে আসেন সংবাদ মাধ্যমের কাছাকাছি। স্বাস্থ্য দফতরের কর্তাদের একাংশ বলেন, ‘‘১০০ শতাংশ নিরাপদ করা সম্ভব নয় বিমানবন্দরের প্রাথমিক স্ক্রিনিংকে। সে ক্ষেত্রে একমাত্র ভরসা মানুষের নিজেদের সচেতনতা।”

সেই সচেতনতার উপর যে বিশেষ ভরসা করতে পারেনি মহারাষ্ট্র। তাই সেখানে যাঁদের গৃহ-পর্যবেক্ষণে থাকতে বলা হয়েছে, তাঁদের হাতে ভোটে ব্যবহৃত কালি দিয়ে রীতিমতো স্ট্যাম্প মেরে চিহ্নিত করা হচ্ছে ‘হোম আইসোলেশন’ লিখে। উদ্দেশ্য একটাই, ওই ব্যক্তি যদি রাস্তায় ঘুরে বেড়ান তা হলে অন্য মানুষরা তাঁকে চিহ্নিত করতে পারবেন এবং বাড়িতে পাঠাতে পারবেন। স্ট্যাম্প মেরে চিহ্নিত করা নিয়ে অনেকেই মানবাধিকার ভঙ্গ হচ্ছে বলে প্রশ্ন তুলেছেন। তবে এ রাজ্যের এক স্বাস্থ্য কর্তা বলেন, ‘‘দেখা যাচ্ছে চিকিৎসক, সরকারি আমলা বা অভিনেতা অভিনেত্রীদের মতো সমাজের উপর তলার মানুষরা সামান্য ক’দিন কোয়ারান্টিনে থাকা এড়াতে হাজারো মানুষের জীবন বিপন্ন করতে পিছ পা হন না। সে ক্ষেত্রে তো জন স্বাস্থ্য রক্ষা করতে স্ট্যাম্প মেরে চিহ্নিত করার মতো পদ্ধতি নিতেই হবে সরকারকে।”

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy