ক্যাম্পে জিৎ। ফাইল চিত্র
আইটিবিপি ক্যাম্প। সেখানে প্রায় চারশো মানুষ, যাঁরা ফিরেছেন চিন থেকে। চিকিৎসকেরা তাঁদের পরীক্ষা করছেন।
একজনের পর একজন। চলছে শারীরিক পরীক্ষা। সকলের মনেই চরম উদ্বেগ। এই বুঝি করোনা ভাইরাস ধরা পড়ে। কিন্তু না, প্রাথমিক পরীক্ষার পর চিকিৎসকরা জানিয়ে দেন যে, ক্যাম্পের কারও শরীরেই করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ মেলেনি। এর পরে অপেক্ষা শুরু নমুনা পরীক্ষার রিপোর্টের। যদিও প্রাথমিক পরীক্ষায় ক্যাম্পের চারশো জনের কারও শরীরেই ভাইরাস মেলেনি। তবুও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে তাঁদের রাখা হল আইটিবিপি ক্যাম্পে। কারণ, ২ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে যে কোনও সময় এই ভাইরাসের লক্ষণ ধরা পড়তে পারে। ভয়ে ভয়ে কাটতে লাগল এক একটা দিন। চিনের উহান প্রদেশ থেকে দেশে ফিরে এই অভিজ্ঞতাই হয়েছিল এক বাঙালি গবেষক দম্পতির।
গবেষক জিৎ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘সাধারণত ৭-৮ দিনের মধ্যে করোনাভাইরাসের প্রভাব প্রকট হতে শুরু করে। প্রতি দিন চিকিৎসকরা এসে আমাদের পরীক্ষা করতেন। এর মধ্যে কারও শরীরে তেমন কোনও লক্ষণ ধরা না পড়ায় আমরা কিছুটা নিশ্চিন্ত হতে থাকি।’’ ১৪ দিনের মাথায় আবার নমুনা সংগ্রহ করা হল। ১৬ দিনের মাথায় জানিয়ে দেওয়া হল যে, ক্যাম্পের কারও শরীরেই করোনাভাইরাস ধরা পড়েনি।
জিৎ জানান, বছর ছয়েক আগে চিনে যান তিনি এবং তাঁর স্ত্রী ঈপ্সিতা নাথ। উহানের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁরা যৌথ ভাবে গবেষণা শুরু করেন। ২০১৮ সালে পিএইচডি করার পর ওই বিশ্ববিদ্যালয়েই তাঁরা গবেষক হিসাবে কাজ শুরু করেন। সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিল, কিন্তু ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু হয় অস্বস্তিটা। কারণ ওই সময় থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় একজন দু’জনের আক্রান্ত হওয়ার খবরটা ছড়াচ্ছিল।
তখনও নোভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) চিহ্নিত হয়নি। তখন প্রতিদিন একজন দু’জন করে আক্রান্তের খবর আসতে শুরু করেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় জোর আলোচনা ২০০২-০৩ সালের ভয়ঙ্কর ‘সার্স’ ভাইরাস আবার ফিরে এল নাকি। কিন্তু সরকার থেকে কোনও ঘোষণা হয়নি। শুধু বেসরকারি ভাবে কয়েকজন চিকিৎসক সতর্ক করে যাচ্ছিলেন। প্রতি দিন বাড়ছিল আক্রান্তের সংখ্যা। মানুষ রাস্তায় মাস্ক পরে বের হচ্ছিলেন। রাস্তাঘাটে ক্রমশ কমছিল মানুষের সংখ্যা। কলকাতার বাড়িতে বসে জিৎ বলেন, “আমরা কিন্তু আশঙ্কা করছিলাম যে, নববর্ষের ছুটিতে এই ভাইরাস দ্রুত ছড়াবে। কারণ চিনে নববর্ষ হল আমাদের দুর্গা পুজোর মত। এই সময় সকলে ঘরে ফেরেন বা কোথাও বেড়াতে যান। সে ক্ষেত্রে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেশি। আর হলও তাই।”
আতঙ্ক বাড়তে থাকায় স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে জিৎ সিদ্ধান্ত নিলেন, তেমন হলে দেশে ফিরে যাবেন। কিন্তু পর দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে জানতে পারেন যে, সরকারি ভাবে শহরের সমস্ত যান চলালচ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শহর থেকে বের হওয়ার রাস্তাগুলো আটকে দিয়েছে সেনাবাহিনী।
জিৎ বুঝতে পারেন, পরিস্থিতি ক্রমশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। দিনের পর দিন ঘর বন্দি। দেশে ফিরতে হবে। শুরু হল দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ। ৩০ জানুয়ারি দূতাবাস থেকে জানিয়ে দেওয়া হল যে, পর দিনই তাঁদের ভারতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। ৩১ জানুয়ারি সকালে গাড়ি আসার কথা। কিন্তু চিনের চালকরা ঘরের বাইরে বের হতে রাজি নন। শেষ পর্যন্ত বিমান বন্দরে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ি এল রাত ৮টার সময়। রাতে বিমানবন্দরে কিছু খেলেন না কেউ। কারণ তখন কোনও কিছু ছুঁতেও ভয়। খাওয়া তো দূরের কথা।
বিমানে উঠে ভয়টা যেন আরও বেড়ে গেল। কারণ এত দিন ঘরের ভিতরে নিজেদের যত দূর সম্ভব সাবধানে রাখা গিয়েছিল। কিন্তু বিমানে তখন তিনশো জন যাত্রী। কার শরীরে যে করোনাভাইরাস বাসা বেঁধে আছে, কেউ জানেন না। গোটা রাত বিমানের ভিতরে আতঙ্কে, ভয়ে কেটেছে। সকালে দিল্লির বিমানবন্দরে পৌঁছনোর পর শুরু হয় নানা পরীক্ষা। সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় ‘আইটিবিপি’ ক্যাম্পে। সেখানে ১৬ দিনের বন্দিদশা কাটার পরে জানিয়ে দেওয়া হল যে ক্যাম্পে থাকা কারও শরীরেই করোনাভাইরাস ধরা পড়েনি।
গবেষক দম্পতি ক্যাম্পের বাইরে খোলা আকাশের নীচে এসে দাঁড়ালেন। নিঃশ্বাস নিলেন বুক ভরে। মুক্তি। মনের ভিতরে এত দিন ধরে চাপ ধরে থাকা করোনাভাইরাসের আতঙ্ক থেকে মুক্তি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy