প্রতীকী ছবি
চরিত্র বদলে ‘আবার সে এসেছে ফিরিয়া’। প্রতিদিন কলকাতা শহর এবং বৃহত্তর কলকাতায় বাড়ছে করোনা রোগীর সংখ্যা। বিভিন্ন কোভিড হাসপাতালে খালি শয্যার পরিমাণও কমতে শুরু করেছে। বুধবারেই শহরের এক সরকারি হাসপাতালের সুপার পরিচিত আমলাকে বার্তা পাঠিয়েছেন, ‘প্রচুর ফোন আসছে। রোগী ভর্তির সংখ্যাও রোজ বাড়ছে’। পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত রাজ্য সরকারও। কিন্তু এখনও সম্পূর্ণ লকডাউন বা দোলের উৎসব নিষিদ্ধ করার পথে হাঁটতে চাইছে না রাজ্য সরকার। কারণ, সামনে ভোট। মার্চের ২৭ তারিখ থেকে আট দফার ভোট শুরু হচ্ছে রাজ্যে। আমলাদের বক্তব্য, এই ভোটের সময়ে আপাতত সতর্কতা এবং কড়াকড়ি বাড়ানোই প্রধান এবং প্রথম লক্ষ্য। পাশাপাশিই লক্ষ্য— নির্বাচনী জনসভায় যদি নেতানেত্রীরা নিজেরা উদাহরণ হয়ে নিয়মিত মাস্ক ব্যবহার করেন এবং জনতাকেও যাতে তাঁরাই মাস্ক ব্যবহারের পরামর্শ দেন।
এরই পাশাপাশি করোনার প্রতিষেধক টিকা দেওয়ার গতি আরও বাড়াতে চাইছে নবান্ন। জনবহুল এলাকায় সংক্রমণ রুখতে পুলিশ-প্রশাসনিক কর্তাদের সক্রিয় হওয়ারও বার্তা গিয়েছে নীলবাড়ির শীর্ষ স্তর থেকে। বিধানসভা ভোটের মুখে রাজ্যে রাজনৈতিক মিছিল এবং জনসভায় মানুষের মুখের মাস্ক অনেকটাই ‘আলগা’ হয়ে গিয়েছে। চিকিৎসকদের বড় অংশ মনে করছেন, দূরত্ববিধিরও তোয়াক্কা কেউ করছেন না। সেই সুযোগে ‘চরিত্র’ বদলে করোনা ফের থাবা বসাতে শুরু করেছে বাংলার নানা প্রান্তে। বিশেষ করে কলকাতা, হাওড়া এবং দুই ২৪ পরগনায়। চিকিৎসকদের বক্তব্য, বাংলার পরিস্থিতি গত একমাস ধরে ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে। তবে অবস্থা এখনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়নি। করোনাকে হারাতে হলে মানুষকে লকডাউন পর্বের মতোই সচেতন হতে হবে। ভোটের মরসুমে প্রশাসনকেও বাড়তি দায়িত্ব নিতে হবে। চিকিৎসকদের বক্তব্য, নির্বাচনী মরসুমে রাজনৈতিক প্রচারে করোনা, মাস্ক এবং দূরত্ববিধি নিয়ে আরও বহুগুণ সচেতনতার প্রয়োজন রয়েছে।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, মঙ্গলবারেই রাজ্যে মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৪০০ ছাড়িয়েছে। কিন্তু এক মাস আগেও এমন পরিস্থিতি ছিল না। অনেকটা ‘কাবু’ হয়ে গিয়েছিল করোনাভাইরাস। পরিসংখ্যান বলছে, গত ২৩ ফেব্রুয়ারি বাংলায় আক্রান্ত হয়েছিলেন ১৮৯ জন। কয়েকদিন তার আশপাশেই ঘোরাফেরা করেছে আক্রান্তের সংখ্যা। তখন অবশ্য মহারাষ্ট্র, কেরল সহ দেশের নানা প্রান্তে সংক্রমিত হচ্ছেন বহু মানুষ। গত ৩ মার্চ পশ্চিমবঙ্গে ২২৫ জন আক্রান্ত হন। এর পর ধীরে ধীরে বেড়েছে সংক্রমণ। গত ১৭ মার্চ আক্রান্ত হয়েছিলেন ৩০৩ জন। গত কয়েকদিন ধরে রাজধানী কলকাতা শহরেই গড়ে দৈনিক আক্রান্ত হচ্ছেন দেড়শোর আশপাশে মানুষ। হাওড়া এবং দুই ২৪ পরগনাতেও আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। এর মধ্যেই কলকাতার প্রাক্তন মেয়র ফিরহাদ হাকিম হাতজোড় করে মানুষকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। লালবাজারের তরফে থানাগুলিকে করোনার বিষয়ে নজরদারি আরও বাড়ানোর বার্তা দেওয়া হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও মানুষ ভয় পাচ্ছেন না। সরকারি হাসপাতালে কর্মরত এক চিকিৎসক বুধবার বলেন, ‘‘মানুষের এবার ভয় পাওয়া উচিত। কারণ, পরিস্থিতি রোজই খারাপের দিকে যাচ্ছে। এখন সচেতন না হলে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ কিন্তু সুনামি হয়ে আছড়ে পড়তে পারে।
ইতিমধ্যেই মহারাষ্ট্রের নাগপুরে আবার লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। চণ্ডীগড় এবং দিল্লিতে হোলি নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে দিয়েছে রাজ্য প্রশাসন। দেশে অন্তত পাঁচটি রাজ্যে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ এসে আছড়ে পড়েছে। কলকাতা এবং বৃহত্তর কলকাতাতেও করোনার অন্য প্রজাতির ভাইরাসের অস্তিত্ব মিলেছে মানবদেহে। ঘটনাচক্রে, গত বছর ২৪ মার্চ দেশ জুড়ে সম্পূর্ণ লকডাউন ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ঠিক এক বছরের মাথায় বুধবার, ২৪ মার্চ করোনা পরিস্থিতি নিয়ে আবার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। বাংলায় পরিস্থিতি যে ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে, তা মানছেন স্বাস্থ্যকর্তাদের একাংশও। সে কারণে বিমানবন্দরেও স্বাস্থ্যপরীক্ষা করা হচ্ছে। আরও বেশি করে টিকা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। পরিস্থিতি আঁচ করে ইতিমধ্যেই নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়েছে চিকিৎসকদের সংগঠন ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টর্স ফোরাম’।
এক দিকে যখন করোনা আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে, তখন কিন্তু সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালে শয্যার সংখ্যা কমছে। যদিও স্বাস্থ্যকর্তারা বলেছেন, করোনা মোকাবিলায় হাসপাতালগুলিতে পর্যাপ্ত শয্যা রয়েছে। গত সোমবার স্বাস্থ্য দফতরের তথ্য থাকে জানা গিয়েছিল, রাজ্যে ৪২টি বেসরকারি হাসপাতালে ৯৪৯টি কোভিড শয্যার মধ্যে ৫৭৪টি খালি রয়েছে। ৪৬টি সরকারি হাসপাতালে ৫,৬০৪টি শয্যার মধ্যে ৫,৫০৩টি খালি। কিন্তু এক মাস আগে ২৩ ফেব্রুয়ারি চিত্রটা অন্যরকম ছিল। ৬১টি বেসরকারি হাসপাতালে ২,৯৫৪টি কোভিড শয্যার মধ্যে খালি ছিল ২,৩৭১টি। আর ৬৫টি সরকারি হাসপাতালে ৮,৭২৭টি কোভিড শয্যার মধ্যে ৮,৫২৬টি শয্যা খালি ছিল। তখন আক্রান্তের তুলনায় শয্যার সংখ্যা অনেকটাই বেশি ছিল। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে বলেই স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে উদ্বেগও। শহরের এক নামী চিকিৎসকের কথায়, ‘‘এখন লোকের একটু ভয় পাওয়া দরকার। প্রয়োজনে আতঙ্ক ছড়ানো দরকার। সুকুমার রায়ের পাগলা দাশুর মতোই মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে আবার ফিরছে করোনা। সতর্ক না হলে কিন্তু কোভিড ১৯ ভাইরাস দাশুর মতোই হুলুস্থূল কাণ্ড ঘটিয়ে ছাড়বে!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy