ওয়াকফ সংশোধনী আইন বাতিলের দাবিতে মুর্শিদাবাদের অশান্তির কারণ কি শুধু রাজনৈতিক ইন্ধন, না পিছনে ওয়াকফ সম্পত্তি বেহাত হওয়ার ক্ষোভও জড়িয়ে রয়েছে, প্রশ্ন উঠছে বিভিন্ন মহলে। রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডের সদস্য, জঙ্গিপুরের তৃণমূল সাংসদ খলিলুর রহমান মানছেন, ওয়াকফ সম্পত্তি বেদখল হয়ে রয়েছে এবং সে জবরদখলে তৃণমূল কংগ্রেসের কারও ভূমিকা নেই এমনটা নয়। ওয়াকফ বোর্ড এবং রাজ্য সরকার জবরদখল উচ্ছেদ করতে চাইছে বলেও দাবি তাঁর।
প্রশাসন সূত্রের দাবি, মুর্শিদাবাদে মোট ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে প্রায় সাড়ে চার হাজার। এই সম্পত্তির বেশির ভাগটাই কৃষিজমি। তবে তার মধ্যে সাড়ে পাঁচশোটি বেদখল হয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ। স্থানীয় স্তরে ‘প্রভাবশালীরা’ সে সম্পত্তি দখলে রেখেছেন, অভিযোগ এমনই। এই পরিস্থিতিতে রবিবার মুর্শিদাবাদের একাধিক ইমাম, মোয়াজ্জিম সংগঠন রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমারের সঙ্গে আলোচনায় দাবি তুলেছে, বেদখল হয়ে থাকা ওয়াকফ সম্পত্তি ফেরানোয় জোর দিতে হবে রাজ্য সরকারকে।
ইমাম, মোয়াজ্জিমদের একটি সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘‘মুর্শিদাবাদে প্রচুর ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে। এর অনেক অংশই বেদখল হয়ে রয়েছে। যে, যখন ক্ষমতায় থেকেছে, ওয়াকফ সম্পত্তি হাতিয়েছে। জবরদখল হওয়া সেই সব সম্পত্তি ফেরাতে তৎপর হোক রাজ্য সরকার। তার সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ হোক।’’ ইমাম ও মোয়াজ্জিমদের আর একটি সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক নিজামুদ্দিনের দাবি, ‘‘কম-বেশি প্রায় এক লক্ষ একর ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে মুর্শিদাবাদে। সে সম্পত্তি উদ্ধারে গা কোথায় সরকারের? সরকার সে কাজে সদিচ্ছা না-দেখালে ক্ষোভ বাড়বেই।’’ শমসেরগঞ্জ ইমাম-মোয়াজ্জিম সংগঠনের নেতা নুরুল ইসলাম বলেন, ‘‘ওয়াকফের কোটি টাকার সম্পত্তি যাঁরা ১০০ টাকা ভাড়ায় ভোগ করছেন, তাঁদের চিহ্নিত করে আইনের পথে উদ্ধার করতে হবে।’’ তবে প্রত্যেকের সংযোজন: ‘‘হিংসা কোনও আন্দোলনের গতিমুখ হতে পারে না।’’ বৈঠকে ডিজি ইমামদের কাছে এলাকায় শান্তি ফেরাতে আরও তৎপর হতে অনুরোধ করেন।
সিপিএমের জেলা সম্পাদক জামির মোল্লা বলেন, ‘‘ওয়াকফ সম্পত্তি যারাই দখল করুক, উদ্ধার করতে হবে সরকারকে। শাসক পক্ষের নিচু তলার একটা প্রভাব ওয়াকফ সম্পত্তিতে থাকে। এখন বেশির ভাগ সম্পত্তি তৃণমূলের দখলে। কোথায়, কত সম্পত্তি বেদখল হয়েছে তার তালিকা প্রকাশ করলেই বোঝা যাবে, কারা এতে জড়িত। আমরা যেমন সংশোধিত ওয়াকফ আইনের বিরোধী, তেমনই জবরদখলেরও বিরোধী।’’ কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য অধীর চৌধুরীর বক্তব্য, ‘‘এ রাজ্যে এক লক্ষ ৪৮ হাজার ২০০টি ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে। তৃণমূল সরকারের আমলে ওয়াকফ সম্পত্তি সব থেকে বেশি বেদখল হয়েছে। তদন্ত করলে সব বেরিয়ে আসবে। রাজ্য সরকার ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করুক।’’
সাংসদ খলিলুরের দাবি, ‘‘যাঁরা দখল করে রেখেছেন, তাঁদের উচিত, স্বেচ্ছায় সে জমি ওয়াকফ বোর্ডকে ফিরিয়ে দেওয়া। আমরা চেষ্টা করছি। এই জবরদখলে কোথাও কোথাও তৃণমূল নেই, তা বলছি না। কিন্তু যারাই সম্পত্তি দখল করুক, তা উচ্ছেদে ওয়াকফ বোর্ডের আপত্তি নেই। রাজ্য সরকারও তা চাইছে। কোথাও কোথাও তা নিয়ে আইনি জটিলতা রয়েছে। তবে রাজ্য সরকারের সদিচ্ছার অভাব নেই।’’
এরই পাশাপাশি, তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশের আলোচনায় উঠে আসছে মুর্শিদাবাদের এই অশান্তিতে বাংলাদেশ থেকে চলে আসা কিছু অংশের ভূমিকার কথাও। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রাথমিক রিপোর্টেও তেমন ইঙ্গিত আছে বলে একটি সূত্রের খবর। তবে সীমান্ত পেরিয়ে এসে জেলায় কেউ ঘাঁটি গেঁড়ে থাকলে শাসক দলের স্থানীয় সংগঠন কেন খবর পায়নি, সেই প্রশ্নও থেকে যায় বলে তৃণমূল শিবিরের একাংশ মানছে। প্রকাশ্যে তাঁরা এই নিয়ে এখনই মুখ খুলতে চাই না। আর অশান্তির কারণ চিহ্নিত করতে গিয়ে কংগ্রেসের প্রাক্তন সাংসদ অধীর সরাসরিই বলছেন, ‘‘শাসক দলের এক মন্ত্রী উস্কানিমূলক বক্তৃতা করলেন। মুসলিমদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে কিছু কট্টরপন্থীর প্রবেশ ঘটল। পাশেই বাংলাদেশ। কট্টরপন্থী লোকজন কম নেই। আর পুলিশ দর্শক হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকল! পঞ্চায়েত, পুরসভা, বিধায়ক, সাংসদ— সব তৃণমূলের। তাদের কাছে কোনও খবর ছিল না? আসলে সবই ছিল, সেটাকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে।”
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)