Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Vande Bharat Express

বাংলা নয় বিহার, বন্দে ভারত লাইন বদলানোয় বেশি স্বস্তির সঙ্গে খানিক রাজনীতিও রয়ে গেল

বন্দে ভারত এক্সপ্রেস পাথর ছোড়ার ঘটনা এ রাজ্যে ঘটেনি। উদ্বেগ কিছুটা হলেও স্বস্তি পেল কি? বুধবার আনন্দবাজার অনলাইন কথা বলেছিল যাঁদের সঙ্গে, বৃহস্পতিবার এ কথা জানার পর কী বলছেন তাঁরা?

পর পর দু’দিন পাথর ছোড়া হয় বন্দে ভারত এক্সপ্রেস লক্ষ্য করে।

পর পর দু’দিন পাথর ছোড়া হয় বন্দে ভারত এক্সপ্রেস লক্ষ্য করে। গ্রাফিক:শৌভিক দেবনাথ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০২৩ ১৬:০০
Share: Save:

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘ভাগ্যিস বন্দে ভারতে সিসি ক্যামেরা ছিল! না হলে রাজনৈতিক জল আরও ঘোলা হত!’’ মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘স্বস্তি’ পাচ্ছেন। এ কথা ভেবে যে, ‘‘কিছু মানুষকে চিহ্নিত করা গিয়েছে।’’ প্রাক্তন পুলিশকর্তা সন্ধি মুখোপাধ্যায়ের কাছে ‘‘সত্য উদ্ঘাটন হওয়াই আসল স্বস্তির কারণ।’’ রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব অর্ধেন্দু সেনের বক্তব্য, ‘‘স্বস্তি আসলে সত্যের সঙ্গেই জুড়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে রেল যে সত্যিটা প্রকাশ্যে আনল তাকে সাধুবাদ জানাই।’’

শিক্ষাবিদ মীরাতুন নাহার অবশ্য রাজনৈতিক দলাদলিই দেখছেন। রাজনৈতিক ‘তত্ত্ব’ থেকে সরে আসতে নারাজ ভারতীয় মহাকাব্য ও পুরাণ বিশেষজ্ঞ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়িও। যেমন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলছেন, ‘‘আসলে এটা ভারত বিরোধিতার প্রকাশ।’’ আর রাজ্যের মন্ত্রী তথা তৃণমূলের নেত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বিজেপিকে দুষে বলছেন, ‘‘বাংলার লজ্জা নয়, এটা ওদের লজ্জা!’’

বৃহস্পতিবার সকালে জানা গিয়েছে, বন্দে ভারত এক্সপ্রেসে পাথর ছোড়ার ঘটনা বাংলায় ঘটেনি। হয়েছে বিহারে। ‘সেমি হাইস্পিড’ ওই ট্রেনের গায়ের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ প্রকাশ করে এ কথা জানিয়েছে খোদ রেল। পর পর দু’দিন বন্দে ভারতে পাথর ছোড়ার ঘটনায় তৈরি হয়েছিল উদ্বেগ। উদ্বেগ এই মর্মে যে, বাংলা কি তা হলে ‘ভাল’ কিছু পাওয়ার যোগ্য নয়? সেই ‘উদ্বেগ’ কিছুটা হলেও স্বস্তি পেল কি? বুধবার কথা বলেছিল যাঁদের সঙ্গে বৃহস্পতিবারের ‘সত্য’ উদ্ঘাটিত হওয়ার পর আবার তাঁদের সঙ্গে কথা বলল আনন্দবাজার অনলাইন।

বন্দে ভারতে পাথর ছোড়ার ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু। কিছু মানুষের ‘অসভ্যতা’র জন্য নিজেদের ‘সভ্য’ বলে দাবি করার ব্যাপারে কুণ্ঠা বোধ হচ্ছিল লেখকের। পাথর ছোড়ার ‘সংস্কৃতি’ উত্তর ভারতের বলেও দাবি করেছিলেন তিনি। বিহারের ‘কীর্তি’ জানার পর বৃহস্পতিবার শীর্ষেন্দু রেলের প্রযুক্তিকে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন। তাঁর কথায়, ‘‘ভাগ্যিস বন্দে ভারতে সিসি ক্যামেরা ছিল! না হলে রাজনৈতিক জল আরও ঘোলা হত।’’ প্রবীণ লেখক উষ্মা প্রকাশ করে বলছেন, ‘‘এত দিন তো বলা হচ্ছিল, বাংলাতেই ছোড়া হয়েছে! রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে ছোড়া হয়েছে। এখন বলা হচ্ছে ওটা বিহারে হয়েছে। এটা নিয়ে রাজনীতি কেন হচ্ছিল, সেটাই তো বুঝতে পারছি না।’’ পাথর ছোড়ার এই ঘটনায় সকলেরই তীব্র নিন্দা করা উচিত বলেও মনে করেন তিনি।

রাজনৈতিক ‘তত্ত্ব’ থেকে সরে আসতে নারাজ নৃসিংহপ্রসাদ। বাংলায় হয়নি, বিহার থেকে পাথর ছোড়া হয়েছে বলে তিনি স্বস্তি পেতে রাজি নন। একই রাজনৈতিক দলের মধ্যে পরিশোধিত এবং অপরিশোধিত রাজনৈতিক বোধের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘এটা তো বোঝাই যাচ্ছে যে দুষ্কৃতীদের কাজ। তবে বাংলায় হোক বা বিহার, দেশের সম্পদ নষ্ট করার এই প্রবণতা বন্ধ হওয়া উচিত। আমি চাই এটা সর্বৈব ভাবে বন্ধ হোক।’’ দুষ্কৃতীদের এমন আচরণের পিছনে নৃসিংহপ্রসাদ ‘অপরিশোধিত’ রাজনীতিতে বিশ্বাসীদেরই দায়ী করতে চান। তাদের অঙ্গলিহেলনেই দুষ্কৃতীরা এসব করে বলে মনে করেন তিনি।

রাজনৈতিক বিতণ্ডার মধ্যেই রেল যে একটা অনুসন্ধান চালিয়েছে, তার প্রশংসা করছেন মনোবিদ অনুত্তমা কোন মানসিক অবস্থান থেকে মানুষ আসলে এমন পাথর ছোড়ার কাজ করেন, তিনি বুধবার তার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে প্রশ্ন তুলেছিলেন, এটা দলীয় সংঘাতের কারণে প্রতীকী প্রতিবাদ হিসাবে হল কি না এ কথা অনুসন্ধানসাপেক্ষ। বৃহস্পতিবার তিনি ‘স্বস্তি’ পাচ্ছেন এটা ভেবে যে, কিছু মানুষকে চিহ্নিত করা গিয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘একটা অনুসন্ধান প্রক্রিয়া অন্তত সংঘটিত হয়েছে। সেখানে আমরা জানতে পারছি, কিছু মানুষকে চিহ্নিত করা গিয়েছে। আমি বলব এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই যে অনেকের মধ্যে মিশে গিয়ে একটা ধ্বংসাত্মক আচরণ মানুষ দেখায়, যদি এই বার্তাটা পৌঁছনো যায় যে, তুমি মনে করছ তোমাকে চিহ্নিত করা যাবে না। কিন্তু চিহ্নিতকরণেরও নানা প্রক্রিয়া সম্পাদন সম্ভব।’’

রেলের ফুটেজ প্রকাশে স্বস্তি পাচ্ছেন প্রাক্তন পুলিশ কর্তা সন্ধি। তিনি আগেই জানিয়েছিলেন, প্রথমে সব দিক থেকে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। রেলের ফুটেজ প্রকাশ্যে আসার পর তিনি আবার পূর্ণাঙ্গ তদন্তের কথা বলছেন। সন্ধির কথায়, ‘‘তদন্ত না করে কোনও সিদ্ধান্তে না পৌঁছনোই ভাল। সেটাই আগেই বলেছি। আবারও বলছি, ফুটেজ যখন প্রকাশ্যে এসেছে, সেটা ভাল করে খতিয়ে দেখে দোষীদের চিহ্নিত করা উচিত।’’ তবে বিষয়টিতে কিছুটা হলেও স্বস্তি পাচ্ছেন সন্ধি। কারণ, ‘‘বাংলা না বিহার, সেটা স্বস্তির কারণ নয়। আসল কারণ, প্রযুক্তির সাহায্যে সত্যিটাকে জানানো রেল। সত্য উদ্ঘাটন হওয়াই আসল স্বস্তির কারণ।’’

প্রাক্তন আমলা অর্ধেন্দু জানাচ্ছেন, স্বস্তি আসলে সত্যের সঙ্গেই জুড়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে রেল যে সত্যিটা প্রকাশ্যে আনল তাকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘বাংলা ছুড়েছে না বিহার, সেটা বিচার্য নয়! কে ছুড়েছে সেটা বিচার্য। আইনের চোখে সেটাই সত্য। তবে তার ভিতরে কোনও রাজনীতি থাকতেই পারে। সমস্যার মূলে যাওয়া প্রয়োজন। তারই প্রথম পর্ব পেরোনো গিয়েছে। পথ আরও বাকি।’’

তবে পাথর যেখান থেকেই ছোড়া হোক না কেন, বিষয়টায় এখনও রাজনৈতিক দলাদলিই দেখছেন শিক্ষাবিদ মীরাতুন। তাঁর কথায়, ‘‘কোথায় পাথর ছুড়েছে, সেটা কোনও বিষয় নয়। যারা পাথর ছুড়েছে, তারা যে অ-বিজেপির দলভুক্ত, সেটা বোঝা যাচ্ছে। বন্দে ভারত ট্রেন নিয়ে তাদের কোনও মাথাব্যথা নেই। আসলে নরেন্দ্র মোদী আত্মগরিমা প্রকাশ করছেন এই ট্রেনের মাধ্যমে। তারই প্রতিবাদ জানাচ্ছে ওরা। আমি সমর্থন করছি না। এ ভাবে জনসম্পদ নষ্ট করা উচিত নয়। দেশ জুড়ে এই বিরোধিতার পরিসর তৈরি হওয়ায় স্বস্তিও পাই না!’’

গত কয়েক দিন ধরে বাংলার শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধে সুর-চড়ানো রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্ত একটু হলেও তাঁর মত বদলেছেন। শাসকদল থেকে তির অন্য দিকে ঘোরানোরও চেষ্টা করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘কোথায় ঢিল ছোড়া হয়েছে, সেটা বলেছে রেল। কারা মেরেছে বলেনি। তাই তৃণমূলের নৃত্য করার কিছু নেই। বাংলা সংলগ্ন কিষাণগঞ্জে তৃণমূলের লোকজন নেই কে বলল? আসলে এটা ভারত বিরোধিতার প্রকাশ। তৃণমূল না হলে মিমের কাজ হতে পারে। দুই দলে তো আদর্শগত ফারাক কিছু নেই! এটাই তো বাংলার বড় লজ্জা। ভাল কিছু হওয়া বা পাওয়া তাই কঠিন।’’

রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রিমা প্রত্যাশিত ভাবেই বিষয়টি নিয়ে সুকান্ত এবং বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে কটাক্ষ করেছেন। তাঁর দাবি, বিজেপি ‘পরিকল্পিত’ ভাবে প্রচার চালিয়েছে, বাংলার মানুষ এবং তৃণমূল পাথর ছুড়েছে বন্দে ভারতে। তাঁর কথায়, ‘‘বিরোধী দলনেতা থেকে বিজেপির রাজ্য সভাপতি টুইটগুলো করেছেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে। বাংলাকে কালিমালিপ্ত করতে। পূর্ব রেলই বলেছে, বিহার থেকে পাথর ছোড়া হয়েছে। তা হলে বিজেপি ফেক ভিডিয়ো করেছে। বাংলার লজ্জা নয়, এটা ওদের লজ্জা। যাঁরা ফেক ভিডিয়ো করেছে, তাঁরাই বাংলার লজ্জা।’’

তবে এটা ঠিক যে, কৃতকর্মের দায় বিহারের উপর যাওয়ায় আপাতত একটা সার্বিক স্বস্তি দেখা দিয়েছে। সেটা ‘আপাতত’ কি না, তা বলবে অদূর ভবিষ্যৎ এবং রেলের ‘মহার্ঘ’ ট্রেনকে রক্ষা করার চেষ্টা।

অন্য বিষয়গুলি:

Vande Bharat Express
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy