দুবাইয়ের বাণিজ্য সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর বৈদেশিক বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী থানি বিন আহমেদ আল জ়েয়াউদি। —নিজস্ব চিত্র।
তিনি চিরকালই নিজের মতো। প্রথাগত বক্তৃতার মঞ্চেও তিনি নিজের মতো করেই সাবলীল। অনেকে বলেন, এটাই ওঁর ইউএসপি। শুক্রবার বিকালে তা দেখল সংযুক্ত আমিরশাহির দুবাইয়ের মঞ্চও। বাণিজ্য সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দুবাইয়ের শিল্পমহলের প্রতিনিধিদের সম্বোধন করলেন ‘ভাইবোন’ বলে। এটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু বাণিজ্য সম্মেলনের বিশেষ অতিথি, আমিরশাহির সৌম্যদর্শন বৈদেশিক বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী থানি বন আহমেদ আল জ়েয়াউদিকে ‘কিউট’ বলে সম্বোধন করতেই সভাগৃহে তা অন্য অনুরণন তুলে দিয়ে গেল। দ্য রিজ় কার্লটল হোটেলের চোখধাঁধানো ফ্লোর ফেটে পড়ল হাততালিতে। স্পেন এবং বার্সেলোনার মতো দুবাইয়ের সম্মেলনেও বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তাঁর রাজ্যে লগ্নির আবেদন জানালেন। এবং ঘোষণা করলেন, শিল্পের জন্য যা যা দরকার, আজকের বাংলার সব রয়েছে। সেই সঙ্গে আরব দেশের বণিকমহলকে বার্তা দিলেন, পশ্চিমবাংলায় বিনিয়োগ মানে তা শুধু সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। বাংলাদেশ ও উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির জন্যও সম্ভাবনার দরজা খুলে যাবে তাঁদের জন্য। আর মমতার ‘কিউট’ মন্ত্রী থানিও জানালেন, বাংলার সঙ্গে বাণিজ্যে গাঁটছড়া বাঁধতে তারা ভীষণ ভাবেই ইচ্ছুক। তিনি নিজে এ ব্যাপারে সদর্থক ভূমিকা নেবেন।
মমতা এ দিন তাঁর বক্তৃতায় বলেন, ‘‘আমাদের রাজ্যে সব পরিকাঠামো তৈরি। জমি তৈরি রয়েছে। বিদ্যুৎ রয়েছে। কয়লা রয়েছে। সমুদ্র রয়েছে। রয়েছে মেধা এবং প্রশিক্ষিত শ্রমিক। বাংলায় আসুন। বিজিবিএস (বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন)-এ আসুন।’’ আগামী নভেম্বরেই নিউটাউনে হতে চলেছে এই বাণিজ্য সম্মেলন। শিল্পের জন্য পুরোপুরি তৈরি থাকা রাজ্যের পরিকাঠামো এবং পরিবেশের কথা শুক্রবারের বাণিজ্যবৈঠকে বার বার উঠে এসেছে সঞ্জীব গোয়েন্কা, হর্ষ নেওটিয়া-সহ প্রায় সব ভারতীয় শিল্পপতির কথাতেও।
বাংলাকে পরিচয় করাতে গিয়ে মমতা বলেন, ‘‘নাসা থেকে ভাষা, শিক্ষা থেকে বাণিজ্য সবেতে বাঙালিরা রয়েছেন। আমাদের মেধা এই রকমই। চন্দ্রযানের নেপথ্যে রয়েছেন প্রায় ৪০ জন বাঙালি বিজ্ঞানীর পরিশ্রম। অক্সফোর্ড থেকে হার্ভার্ড— সব জায়গায় বাঙালিরা রয়েছেন। আমাদের রাজ্যের অনেক শ্রমিক দুবাইয়ে কাজ করতে আসেন।’’ বণিকমহলের উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘আপনারা বিনিয়োগ করুন। শুধু বাংলা নয়, পাশেই রয়েছে বাংলাদেশ। আমাদের রাজ্যে সাড়ে ১০ কোটি মানুষের বাস। আর বাংলাদেশে ১৫ কোটি। এত বড় বাজার রয়েছে। সেই সঙ্গে উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিও রয়েছে।’’
দুবাইয়ের বাণিজ্য মহলকে নভেম্বরের বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে দরাজ আমন্ত্রণ জানাতে গিয়েই মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘শুধু আপনারা গেলেই হবে না। ওই কিউট, হ্যান্ডসাম মন্ত্রীকেও নিয়ে যেতে হবে।’’ এর পরেই হাততালিতে ফেটে পড়ে চারপাশ। শুক্রবার বাণিজ্যবৈঠকের মঞ্চেই মন্ত্রী থানিকে নিজের আঁকা ছবি উপহার দেন দিদি। বাণিজ্য সম্মেলনের আগে মমতার সঙ্গে একান্ত বৈঠকও হয় আমিরশাহির বৈদেশিক বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীর। তার পর মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গ মোট যত পণ্য রফতানি করে, তার ১২ শতাংশই যায় আরব আমিরশাহিতে। তিনি এ-ও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দেশের গড় বৃদ্ধির তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের বৃদ্ধির হার বেশি। ২০২৩-২৪ সালে রাজ্যের জিডিপির পরিমাণ হতে চলেছে ২১ হাজার ২০০ কোটি আমেরিকান ডলার। ভারতীয় মুদ্রায় ১৭ লক্ষ ৫৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
আমিরশাহির মন্ত্রী থানি এই সম্মেলনে বাংলা সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য নিয়ে তৈরি হয়েই এসেছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘ভারত-আমিরশাহি বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়ছে। জনসংখ্যার বিচারে ভারতের চতুর্থ বৃহত্তম রাজ্য পশ্চিমবঙ্গকে আমরা বিশেষ নজরে দেখছি।’’ বাংলার সঙ্গে দুবাইয়ের সম্পর্কে নতুন অধ্যায় তৈরি হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
ভারতীয় তথা রাজ্যের শিল্পপতিরাও দুবাইয়ের শিল্পপতিদের আবেদন করেন, বাংলায় চলুন। বাংলা এখন বদলে গিয়েছে। মাদ্রিদ ও বার্সেলোনায় ছিলেন না সঞ্জীব গোয়েন্কা। তাঁর ছেলে শাশ্বত গোয়েন্কা সেখানে ছিলেন। দুবাইয়ের বাণিজ্য সম্মেলনে উপস্থিত সঞ্জীব বলেন, ‘‘এই মুখ্যমন্ত্রীর হাতে পড়ে বাংলা বদলে গিয়েছে। তার আগে ৩৪ বছর ধরে বাংলা ভুগেছে। দৃষ্টিভঙ্গির অভাব, শ্রমিক সমস্যা, লকআউট। কিন্তু গত ১২ বছরে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলা পুরোপুরি বদলে গিয়েছে। এখন একটা কর্মদিবসও নষ্ট হয় না। আইনশৃঙ্খলারও কোনও সমস্যা নেই। চাইলেই মুখ্যমন্ত্রীকে পাওয়া যায়। দ্রুত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়। আমার অভিজ্ঞতা দারুণ।’’
অম্বুজা গ্রুপের কর্ণধার হর্ষ নেওটিয়া বলেন, ‘‘দুবাই যেমন সারা পৃথিবীর চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে উন্নয়নে, তেমনই বাংলার উন্নয়নও তাৎপর্যপূর্ণ। ভারত বিশ্বে পঞ্চম থেকে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়ার দিকে এগোচ্ছে। আর দেশের গড় উৎপাদনের থেকে এগিয়ে রয়েছে বাংলা।’’ আইটিসি গ্রুপের সিএমডি সঞ্জীব পুরীর কথায়, ‘‘গত ১২ বছরে বাংলার বদলে যাওয়া দেখেছি। গত ৬০ বছর ধরে আমরা বাংলায় ব্যবসা করছি। কিন্তু গত ১০ বছরে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছি বাংলায়।’’ তিনি বলেন, ‘‘পুঁজি সেখানেই ঝলমল করে যেখানে এটা গুণিতক হারে বাড়ে। গত এক দশক ধরে মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলায় বিরাট এক পরিবর্তন এসে গিয়েছে।’’
দুবাইয়ে দীর্ঘ ২০ বছর ধরে ব্যবসা করছেন দর্শন হীরানান্দানি। তিনিও মুখ্যমন্ত্রীর ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, ‘‘দেশে এখন মহিলা সংরক্ষণ বিল নিয়ে হইহই হচ্ছে। কিন্তু দিদি কবেই নিজের দলে ৪০ শতাংশ মহিলাকে সংসদে পাঠিয়েছেন। তাঁর মানসিকতাই লিঙ্গসাম্যের।’’ হীরানান্দানি গোষ্ঠীই দুবাইয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু বহুতল আবাসন (রেসিডেন্সিয়াল টাওয়ার) নির্মাণ করেছে। দুবাইয়ের বণিক মহলের উদ্দেশে দর্শন বলেন, ‘‘বাংলায় অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। আপনারা সেখানে গিয়ে বিনিয়োগ করুন। সুফল পাবেন।’’
শুক্রবারের বাণিজ্য সম্মেলনের সঞ্চালনা করেন মুখ্যমন্ত্রীর মুখ্য উপদেষ্টা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রারম্ভিক বক্তৃতা দেন মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদী। পশ্চিমবঙ্গ বিষয়ক একটি তথ্যচিত্র দেখানো হয় বাণিজ্য সম্মেলনে। ছিলেন শিল্প ও বাণিজ্য দফতরের প্রধান সচিব বন্দনা যাদব। সম্মেলনে বক্তৃতা করেন দুবাইতে নিযুক্ত ভারতীয় উপরাষ্ট্রদূত আমন পুরীও। পুরীও গত ১২ বছরে বাংলার পরিকাঠামোর উন্নতির কথা বলেন।
রিলায়্যান্স চেয়ারম্যান তরুণ ঝুঝুনওয়ালা আমিরশাহির সঙ্গে বাংলার দীর্ঘ সাংস্কৃতিক যোগাযোগের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘‘গত ১২ বছরে আমাদের সংস্থা ৫০০ কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে বাংলায়।’’ শিল্পপতি মায়াঙ্ক জালান রাজ্যের জিডিপির কথা তুলে ধরে বলেন, ‘‘২০১৬ পরবর্তী সময়ে পশ্চিমবঙ্গের ভূমিকা চমকে দেওয়ার মতো।” শ্রী সিমেন্ট কর্তা প্রশান্ত বাঙ্গারের কথায়, ‘‘শুধু পরিকাঠামোই নয়, শিল্পের সুরক্ষাতেও আজকের বাংলা আমাদের ভরসা দিচ্ছে।’’ পেট্রোকেমিক্যাল এবং চা শিল্পের অন্যতম মুখ সিকে ধানুকা বলেন, ‘‘২০১৩ সালে আমি বাংলায় আমার দ্বিতীয় কারখানা তৈরি করেছিলাম। গত কাল তৃতীয়টি তৈরি হল। দ্বিতীয়টার থেকে টাকা তুলতে না-পারলে তৃতীয়টা আমি করতাম না। দারুণ পরিকাঠামো। দারুণ ব্যবস্থা বাংলায়।’’
দুবাইকে কেন্দ্র করে মুলত বেকারির ব্যবসা করেন আদিল খোরাকিওয়ালা। বাংলার সঙ্গে তাঁদের তিন দশকের ব্যবসায়িক সম্পর্ক। আদিল বলেন, ‘‘এই সরকারের আমলে সুন্দর ভাবে এগোচ্ছে বাংলা।’’ বণিকসভা ফিকির পশ্চিমবঙ্গ কাউন্সিলের চেয়ারম্যান রুদ্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কোভিডের সময়েও বাংলার উৎপাদন বেড়েছে। চা, চা-বাগান কেন্দ্রিক পর্যটন, বস্ত্রশিল্পে বাংলায় বিনিয়োগের জন্য আমি দুবাইকে বলছি বাংলায় আসতে। সুযোগ হারাবেন না। আসুন।’’
শিল্পপতি কেকে বাঙ্গুর, সঞ্জয় বুধিয়া, প্রীতীশ চৌধুরীরাও বলেন দুবাইয়ের মঞ্চে। উপস্থিত ছিলেন মায়াঙ্ক জালান, সুমিত ডাবরিওয়াল, মেহুল মোহানকা, সত্যম রায়চৌধুরী, দিলীপ দুগার, কমল মিত্তলরাও।
দুবাই শিল্প সম্মেলনের আগে সেখানকারই লুলু গোষ্ঠীর এগ্জ়িকিউটিভ ডিরেক্টর আশরফ আলির সঙ্গে বৈঠকে বসেন মুখ্যমন্ত্রী। সূত্রের খবর, বৈঠক খুবই সদর্থক হয়েছে। রাজ্যে বিনিয়োগ-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে একসঙ্গে কাজ করার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে দু’জনের। এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে এই বৈঠকের কথা লিখেছেন মুখ্যমন্ত্রী। জানিয়েছেন, শুক্রবারের বৈঠক বাংলার উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত আশাপ্রদ। সব ঠিক থাকলে নিউটাউনে একটি মল তৈরি করবে তারা। বিশ্বের সমস্ত দেশে লুলু গোষ্ঠীর সমস্ত শপিং মলে ‘বিশ্ববাংলা’র জন্য আলাদা ‘কাউন্টার’ খোলা হতে পারে। সেখানে বিক্রি হবে শুধুই ‘বিশ্ববাংলা’র পণ্য। নিজেদের সমস্ত বিপণির জন্য প্রয়োজনীয় ফল এবং সব্জি লুলু সংস্থা পশ্চিমবঙ্গ থেকেই কিনতে পারে। বাংলায় খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র খুলতেও আগ্রহী ওই সংস্থা। মৎস্য এবং মাংস প্রক্রিয়াকরণ, পোলট্রি, ডেয়ারি শিল্পে বিনিয়োগেও আগ্রহ প্রকাশ করেছে ওই সংস্থা। বাংলায় দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্পেও আগ্রহ দেখিয়েছে তারা। মুখ্যমন্ত্রী এক্স হ্যান্ডলে জানিয়েছেন, ২০২৩ সালের বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে আসার জন্য লুলু গোষ্ঠীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy