শনিবার এক দিনের জেলা সফরে বেরিয়েছিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।
শুরু করেছিলেন পূর্ব মেদিনীপুরের এগরা থেকে। শেষ করলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনিতে। শনিবার এক দিনের জেলা সফরে বেরিয়েছিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথমে গিয়েছিলেন এগরায়। সেখানে গত ১৬ মে একটি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে অন্তত ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। শনিবার ওই ঘটনায় নিহতদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন মমতা। সেখানে গিয়ে তিনি এই ঘটনার জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। মেনেও নিয়েছেন প্রশাসনিক ব্যর্থতার কথা।
সেখান থেকে সরাসরি চলে গিয়েছিলেন শালবনিতে। সেখানে শনিবার তৃণমূলের জনসংযোগ যাত্রা কর্মসূচি ছিল দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যেপাধ্যায়ের। মালদহের পরে শালবনিতে অভিষেকের ওই কর্মসূচিতে আরও এক বার হাজির মমতা। রাজনীতির বৃত্তে যাঁরা ঘোরাফেরা করেন, তাঁদের একাংশ মনে করছেন, দলে তাঁর পর অভিষেককে উত্তরাধিকার হিসাবে ‘সিলমোহর’ দিতেই মমতার এই যোগ দেওয়া। তবে অন্য একটা অংশের মতে, পঞ্চায়েত ভোটের আগে আরও এক বার সংগঠন চাঙ্গা করাই দলনেত্রী মমতার প্রধান উদ্দেশ্য। এমনিতেই পশ্চিম মেদিনীপুরে গোষ্ঠীকোন্দলের নানা অভিযোগ রয়েছে। সেই আবহে মমতা কড়া বার্তা দেন জেলা নেতৃত্বকে। সেই সঙ্গে কুড়মিদেরও কাছে টানার বার্তা দেন তিনি।
একই সঙ্গে শনিবার শালবনিতে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, জিন্দলেরা ইস্পাত এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির জন্য যে ৪,৩৩৪ একর জমি নিয়েছিল সরকারের কাছ থেকে, তার অব্যবহৃত জমি ফিরিয়ে দেবে। মমতা জানিয়েছেন, সেখানে নতুন শিল্প গড়ে তোলা হবে।
এগরাকাণ্ডে মমতার ক্ষমাপ্রার্থনা
এগরার অবৈধ বাজি কারখানায় বিস্ফোরণের ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রী ক্ষমাপ্রার্থী। শনিবার সকালে এগরায় গিয়ে তিনি জানালেন, এই ঘটনায় তাঁর এবং প্রশাসনের চোখ খুলে গিয়েছে। এর পর অবৈধ বাজি কারখানায় কাজ করে যাতে কারও জীবন নষ্ট না হয়, তা দেখা হবে বলে জানান মমতা। ঘটনার ১১ দিন পর এগরায় মুখ্যমন্ত্রী গিয়েছিলেন। দেরি করে আসার জন্য ক্ষমাও চেয়ে নেন তিনি। আকাশ মেঘলা থাকার কারণে তিনি গত কয়েক দিন আসতে পারেননি বলেই জানিয়েছেন। কিন্তু শনিবার ঝুঁকি নিয়ে তিনি এসেছেন বলে জানিয়ে মমতা বলেন, ‘‘আমাকে আসতেই হবে এক বার। আমি আপনাদের সকলের কাছে মাথা নত করে এই ঘটনার জন্য ক্ষমা চাইছি।’’ এই বিস্ফোরণের ঘটনায় প্রশাসনিক ব্যর্থতার কথাও মেনে নিয়েছেন তিনি।
অভিষেকের কনভয়ে কাদের হামলা
শুক্রবার অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কনভয়ে হামলা হয়। সেই সময় রাস্তার ধারে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন কুড়মিরা। তাঁদের দিকেই অভিযোগ উঠেছে। যদিও অভিষেক দাবি করেছেন, বিক্ষোভ স্থল থেকে তিনি ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি শুনেছেন। শনিবার মমতাও শালবনির সভায় গিয়ে জানালেন, এই ঘটনায় কোনও ভাবেই কুড়মিরা জড়িত নন। তাঁর কথায়, ‘‘কুড়মি ভাইয়েরা এ কাজ করেনি। করেছে বিজেপি।’’ মমতা এ-ও জানিয়েছেন, এ রাজ্যে জাতপাতের রাজনীতি ছিল না। বিজেপি এ সব করে জাতপাতের রাজনীতি আমদানি করতে চাইছে। যেমনটা তারা করেছে মণিপুরে। এ রাজ্যে আগে রাজবংশী এবং কামতাপুরীদের সংঘর্ষ বাধানোর চেষ্টা করেছিল। আর এখন কুড়মি এবং মাহাতোদের মধ্যে ঝামেলা বাঁধানোর চেষ্টা করছে। এর থেকে ‘ফায়দা’ তোলার চেষ্টা করছে বিজেপি। এণনটাই জানিয়েছেন মমতা।
সুব্রতের ‘পেটাই’ পরামর্শ
এক কালে অগ্রজ সহকর্মী সুব্রত মুখোপাধ্যায় তাঁকে একটি পরামর্শ দিয়েছিলেন। এখন সেই পরামর্শ বার বার মনে পড়ে তাঁর। শালবনির জনসভায় মমতা জানান, সুব্রত বলেছিলেন, সিপিএমকে মমতার ক্ষমা করা উচিত নয়। কারণ ওরা অত্যাচার করেছে! সে কারণে রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রীর নিদান ছিল, ‘‘সপ্তাহে এক বার যেমন রেশন পাওয়া যায়, তেমন সপ্তাহে এক বার সিপিএমের পেটাই দেওয়া উচিত।’’ তবে তিনি নিজে ওই কথা কখনও শোনেননি। কারণ, তিনি বদলা নয়, বদলের পক্ষপাতী। ‘বদলার রাজনীতি’তে তিনি বিশ্বাস করেন না। কারণ, তাঁর সরকার গুজরাত বা উত্তরপ্রদেশের বিজেপি নয়। আবার নয় কেরলের বামও।
জমি ফেরাচ্ছে জিন্দলরা
প্রায় দেড় দশক আগে বাম জমানায় শালবনিতে জমি পেয়েছিল জিন্দলরা। ইস্পাত এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির জন্য ৪,৩৩৪ একর জমি দেওয়া হয়েছিল। সেই জমির ‘অব্যবহৃত’ অংশ ফিরিয়ে দিচ্ছে তারা। শনিবার শালবনিতে দাঁড়িয়ে এ কথা জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি জানিয়েছেন, ওই জায়গায় নতুন শিল্প গড়ে তোলা হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি পূর্বতন বাম সরকারকে একহাত নিয়েছেন। মমতার কথায়, ‘‘জ্যোতিবাবুরা (বসু) জমি দিয়ে পালিয়েছিলেন। তার পর কিছু হয়েছিল? জিন্দলদের কারখানা আমি এসে উদ্বোধন করেছিলাম। ওঁরা কিছু জমি ফেরত দিচ্ছেন। তাতে নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে।’’ কথা থাকলেও শালবনির ওই জমিতে ইস্পাত এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলেনি জিন্দলরা। ১৩৫ একর জমিতে সিমেন্টের কারখানা তৈরি হয়েছিল। ওই কারখানা সম্প্রসারণের পাশাপাশি রং কারখানাও তৈরি হচ্ছে সেখানে। প্রায় ১,৫০০ একর জমি হাতে রেখে বাকিটা ফিরিয়ে দিতে চায় জিন্দলরা, এমনটাই জানিয়েছেন মমতা।
আন্দোলনের হুঁশিয়ারি অভিষেকের
গত ৩১ দিন ধরে রাস্তায় রয়েছেন অভিষেক। কেউ রুখতে পারেনি। তীব্র দাবদাহ অগ্রাহ্য করেই জেলায় জেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মানুষ আশীর্বাদ করছেন। তবে এখানেই শেষ নয়। এর পর বৃহত্তর আন্দোলনের পথে যাবেন বলে জানিয়ে দিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক। তৃণমূলে নবজোয়ার কর্মসূচি শেষ হলে দিল্লির গিয়ে বৃহত্তর আন্দোলন করা হবে বলে জানালেন তিনি। শনিবার তিনি বলেন, ‘‘এক দিকে, আমাদের মানবিক সরকার, অন্য দিকে, বিজেপির দানবিক সরকার। বাংলার মানুষের ১০০ দিনের টাকা বন্ধ। এই কর্মসূচি শেষ হলে দিল্লির বুকে বৃহত্তর আন্দোলন করব।’’ সাধারণ মানুষের কাছে তাঁর আর্জি, ‘‘প্রধানমন্ত্রীকে পাল্টানোর জন্য লাইন দিন। সরকার বদলানোর জন্য লাইন দিন।’’ পাশাপাশি অভিষেক এ-ও জানিয়েছে, তৃণমূল হল বিশুদ্ধ লোহা। যত আঘাত করা হবে, তত শক্তিশালী হবে।
হাসপাতাল পরিদর্শনে মমতা
শালবনিতে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু স্টেডিয়াম সংলগ্ন যে মাঠে ‘তৃণমূলের নবজোয়ার’ কর্মসূচি ছিল, তার পাশেই শালবনি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল। শনিবার সেই কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার পথে হাসপাতাল পরিদর্শন করে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী। হাসপাতাল পরিদর্শনের পাশাপাশি চিকিৎসকদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘আর কিছুর প্রয়োজন রয়েছে?’’ প্রসূতি বিভাগ ঘুরে দেখার সময় এক মায়ের অনুরোধে তাঁর যমজ সন্তানেরও নাম দিলেন। এক জনের নাম রাখলেন সঙ্গীতা সোরেন। অন্য জনের সঞ্চিতা সোরেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, প্রাথমিক ভাবে পরিষেবা এবং পরিকাঠামো দেখে খুশি হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রয়োজনীয় কিছু নির্দেশ দিয়েছেন জেলাশাসককে।
কোন্দল নিয়ে বার্তা মমতার
পশ্চিম মেদিনীপুরে তৃণমূলের অন্তর্দ্বন্দ্বের কথা সুবিদিত। মাঝেমধ্যে তা প্রকাশ্যেও এসে পড়েছে। মেদিনীপুরের বিধায়ক জুন মালিয়াকে প্রকাশ্যেই কটাক্ষ করেছিলেন ক্রেতা সুরক্ষা প্রতিমন্ত্রী শ্রীকান্ত মাহাতো। শনিবার শালবনির সভা থেকে এই ‘কোন্দল’ নিয়েই বার্তা দিলেন মমতা। জানালেন, তৃণমূল যদি একজোট হয়ে কাজ করে, তা হলে তাঁদের কেউ হারাতে পারবে না। তাঁর বার্তা, ‘‘ঝগড়া বন্ধ করো। সবাই মিলেমিশে কাজ করো। আমি কলকাতায় থাকলেও সব খবর আমার কাছে থাকে।’’ সভায় তিনি নাম ধরে ধরে ‘সতর্ক’ করেছেন স্থানীয় নেতাদের। বিধায়ক জুনের সঙ্গে ‘ভাল’ ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন তৃণমূল জেলা সভাপতি সুজয় হাজরাকে। কেশপুরের বিধায়ক শিউলি সাহার সঙ্গেও তাঁকে বিবাদ মেটানোর পরামর্শ দিয়েছেন। প্রবীণ নেতা মানস ভুইয়াঁকে আরও সক্রিয় হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন মমতা। পঞ্চায়েত ভোটকে নজরে রেখেই যে সংগঠন মজবুত করতে চান তিনি, তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন মমতা। তবে মমতার মতে, তাঁর পাখির চোখ লোকসভা ভোট।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy