(‘মৃত’ শিশুর দাদু)
আমার ঘরেও তো ছেলেপুলে আছে। এত বয়স হল, বুঝি না জন্মের পরে বাচ্চা কেমন দেখতে হয়? আর অত বড়সড় চেহারাই বা হয় কী করে!
এ সব কথাই বলেছিলাম ওদের। কিন্তু কোনও গুরুত্ব দিল না।। খালি বলছিল, মরা বাচ্চা জন্মেছে। ডাক্তারবাবু বললেন, ‘‘আগেই তো বলেছিলাম, অবস্থা ভাল নয়। মা বা বাচ্চা কাউকে একটা বাঁচাতে পারব।’’
এ সব সাত মাস আগের কথা। মেয়েটা পোয়াতি হয়ে আমার কাছে এসেছিল সুন্দরবনের সামশেরনগরের শ্বশুরবাড়ি থেকে। আমি থাকি উত্তর ২৪ পরগনার বাদুড়িয়ার যদুরআটি পঞ্চায়েতের জঙ্গলপুরে। খুব গরিব পরিবার আমাদের। জামাই কাজ করে কেরলে। মেয়ের যখন পেটে ব্যথা উঠল, আমরা আর দেরি করিনি। নিয়ে গিয়েছিলাম বাড়ির কাছেই রুদ্রপুর গ্রামীণ হাসপাতালে। ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, পেট কেটে বাচ্চা বের করতে হবে। মুখ্যুসুখ্যু মানুষ। তার উপরে জামাইটাও সঙ্গে নেই। পেট কাটতে হবে শুনে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
সাত-পাঁচ ভাবছি, হঠাৎ কোথা থেকে যেন হাজির আমিরুল বিশ্বাস (শিশু পাচারের অভিযোগে সোমবার রাতে বাদুড়িয়া থেকে তাকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি)। সম্পর্কে আমার আত্মীয়। চোস্ত ছেলে। বলল, বাদুড়িয়ার সোহান নার্সিংহোমে (এখানেই প্রথম মেলে শিশুপাচার চক্রের হদিস) তার নাকি খুব চেনা-জানা। ডাক্তার তপনকুমার বিশ্বাসের সঙ্গেও (গাইঘাটার এই চিকিৎসককে খুঁজছে সিআইডি) নাকি ওর খুব খাতির। হাজার পাঁচেক টাকায় সব ব্যবস্থা করে দেবে আমিরুল। সব শুনে যেন ধড়ে প্রাণ পেলাম।
আমিরুলই অ্যাম্বুল্যান্স ডেকে পাঠাল মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। খরচ নিল না। আমরা তো তখন ভাবছি, হাতে চাঁদ পেয়েছি। যাই হোক, মেয়েটা যন্ত্রণায় ছটফট করছে। আমরা তাড়াতাড়ি ৬ কিলোমিটার দূরে সোহান নার্সিংহোমে পৌঁছলাম। ডাক্তারবাবুর কী মিষ্টি ব্যবহার। অভয় দিয়ে বললেন, পেট কাটাকাটির দরকার নেই।
মেয়েকে নিয়ে দোতলায় উঠে গেল ওরা। নীচে বসে আছি ঠায়। কয়েক ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। ছটফট করছি। আমিরুলকে বললাম, কই হে, এতক্ষণ লাগছে কেন? গম্ভীর মুখে আমিরুল বলল, অবস্থা একটু গোলমেলে।
একটু পরে ডাক্তারবাবু এসে জানালেন, অবস্থা সত্যিই খারাপ। পেট কাটতেই হবে। হয় মেয়েকে বাঁচানো যাবে, নয় তো বাচ্চাকে। তখন হাউ হাউ করে কাঁদছি। বললাম, ডাক্তারবাবু আপনি মাই বাপ। যা ভাল বোঝেন করুন।
কেটে গেল আরও কিছুটা সময়। থমথমে মুখে নামলেন ডাক্তারবাবু। পিছনে একজন আয়া। তার কোলে কাপড় জড়ানো বাচ্চার দেহ। ডাক্তার বললেন, ‘‘নাঃ, বাচ্চাটাকে বাঁচানো গেল না। তবে মেয়ে ভালই আছে।’’
চোখের জল মুছে মনে হল, মরা
হোক, তবু মেয়ের ঘরে প্রথম নাতি তো বটেই। মুখখানা একটু দেখি।
কিন্তু এ কী!
বাচ্চা আকারে এত বড়সড়? আমার ওই তো রোগা-পাতলা মেয়ে। তার উপরে মায়ের পেট থেকে বাচ্চা বেরিয়ে আসার পরে রক্ত-টক্ত কিছু লেগে থাকে গায়ে। সে সবও তো মনে হচ্ছে যেন শুকিয়ে এসেছে। আর হাতে কাটা দাগটাও তো পুরনো ঠেকছে। আমরা চিৎকার করলাম। বললাম, এ বাচ্চা আমার মেয়ের হতে পারে না। আত্মীয়-বেরাদরকে ডেকে আনলাম।
প্রথমে ওরা ঠান্ডা মাথায় কথা বলছিল। আস্তে আস্তে দেখলাম সুর চড়ছে। দুই মহিলা (জাকিরের দাবি, এরাই মছলন্দপুরের সুজিত দত্ত মেমোরিয়াল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের মালকিন পলি দত্ত ও স্থানীয় বাসিন্দা নাজমা বিবি। দু’জনেই গ্রেফতার হয়েছে) এসে হাজির। ওরা হম্বিতম্বি শুরু করল। ফোনে কাকে যেন ডেকে পাঠাল। দেখি, কয়েকটা ছেলে মোটর বাইক নিয়ে হাজির। ওদের রকমসকম ভাল ঠেকছিল না। হুমকি দিয়ে বলল, বেশি বাড়াবাড়ি না করতে।
এক মহিলা বলল, যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। এখন মরা ছেলে নিয়ে বাড়ি যাও। দাফন করতে যা খরচ হবে, সেটা দিয়ে দিচ্ছি। ৭ হাজার টাকা হাতে ধরিয়েও দিল। আর বলল, নার্সিংহোমের সব খরচ মকুব।
ভেবে দেখলাম, চিৎকার করে লাভ হবে না। ওরা দলে ভারী। মরা নাতি আর আমার মেয়েকে নিয়ে পর দিন সকালে চলে এলাম।
জামাই খুব চোটপাট করল সব শুনে। সেই থেকে মেয়েটাও কেমন যেন হয়ে গিয়েছে। আর আমি লজ্জায় মেয়ের বাড়িতে পা রাখতে পারি না।
ও হ্যাঁ, সে দিন যখন কথা কাটাকাটি চলছে নার্সিংহোমে, এক মহিলাকে দেখেছিলাম, বিস্কুটের পেটি হাতে উপরে গেল। আবার ভারী কিছু ওই পেটিতে নিয়ে নেমেও এল। এখন মনে হচ্ছে, ওই বিস্কুটের পেটিতে আমার জ্যান্ত নাতি নাকি নাতনিটাই ছিল না তো! সব জানিয়েছি বাদুড়িয়া থানার পুলিশকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy