মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।
উপনির্বাচন হইহই করে জিতেছে তৃণমূল। আপাতত তাঁর ‘পাখির চোখ’ ২০২৬। সেই লক্ষ্যে এখন থেকেই প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেটি তাঁর সাম্প্রতিক রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড থেকে স্পষ্ট। তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেত্রী হিসাবে যেমন তিনি একবারে সামনে এসে দলের হাল ধরেছেন, তেমনই মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে সরকারে নিজের ‘সক্রিয়তা’ আরও বাড়িয়েছেন। বস্তুত, যে সব দফতরের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সরাসরি যোগাযোগ, বেছে বেছে সেই সব দফতরেরও ‘সক্রিয়তা’ বাড়াচ্ছেন রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান।
সোমবার বিধানসভার অধিবেশন শেষে পূর্ত ও জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের মন্ত্রী পুলক রায় ও তাঁর দফতরের শীর্ষ আধিকারিকদের নিয়ে বৈঠকে বসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই বৈঠকে হাজির থাকতে নির্দেশ দিয়েছিলেন মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ-সহ রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, পঞ্চায়েত মন্ত্রী প্রদীপ মজুমদার, কৃষি মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় এবং সেচ ও জলসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী মানস ভুঁইয়াকে। ওই বৈঠকে উপস্থিত সব মন্ত্রী ও আধিকারিককে তিনি জানিয়েছেন, প্রতি সোমবারই বৈঠক হবে। অর্থাৎ, এক সপ্তাহে কাজের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হবে।
খেয়াল করলে দেখা যাবে, মুখ্যমন্ত্রী যে দফতরগুলিকে একত্রে নিয়ে বৈঠক করে কাজের পর্যালোচনা করবেন বলে জানিয়েছেন, সেগুলির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত সাধারণ মানুষ। পূর্ত দফতর রাজ্যের বড় অংশের রাস্তা নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে। রাজ্যের ১২৮টি পুরসভার দায়িত্ব পুর ও নগরোন্নয়ন দফতরের। কৃষি দফতরের সঙ্গে যুক্ত রাজ্যের কৃষকসমাজ। সেচ ও জলসম্পদের ওপর নির্ভর করে গ্রামীণ এলাকার কৃষিকাজকে জল পৌঁছে দেওয়া এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ। আর ত্রিস্তর পঞ্চায়েত দিয়ে গোটা গ্রামীণ এলাকার আর্থ সামাজিক উন্নয়ন নির্ভর করে পঞ্চায়েত দফতরের ওপর। তাই এই দফতরগুলির কাজ নিজেই তদারকি শুরু করেছেন মমতা। আগামী ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটে যে মমতা যাবেন, তিনি তাঁর শাসনকালের তিনটি মেয়াদ উত্তীর্ণ করে ফেলবেন। প্রত্যাশিত ভাবেই, তাঁকে সেই ভোটে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার মোকাবিলা করতে হবে। রাজ্য সরকার কী কী কাজ করেছে, তার তুল্যমূল্য বিচার হবে। ‘লক্ষ্ণীর ভান্ডার’-এর মতো জনকল্যাণমূলক প্রকল্প দিয়ে তার মোকাবিলা করা যাবে কি না, তা নিয়ে দলের অন্দরেই অনেকে সংশয়ী। তাঁরা মনে করেন, মানুষ কাজ দেখেন। যাঁরা এই ধারণার ধারক, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। যিনি এর আগে সরকারের কাজকর্ম নিয়ে ‘অসন্তুষ্টি’ প্রকাশ করেছেন বলেই খবর। সেই কারণেই তিনি প্রশাসন এবং মন্ত্রিসভার একাংশে রদবদল করারও প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
কয়েক মাস আগে পরিবহণ দফতরের দুই মন্ত্রী-সহ সব শীর্ষ আধিকারিককে নিয়ে নবান্নে একটি পর্যালোচনা বৈঠক করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই বৈঠকে ধারাবাহিক ভাবে দফতরের কাজ পর্যালোচনা করে রিপোর্ট পাঠাতে বলেছেন তিনি। সেই মর্মে কাজও শুরু করে দিয়েছেন পরিবহণ মন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তী। বলা বাহুল্য যে, পরিবহণ দফতরের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগাযোগ নিত্যদিনের। ফলে মমতা পরিবহণ দফতরের উপর ‘বিশেষ নজর’ দিচ্ছেন।
আরও একটি দফতরের উপর ‘বিশেষ নজর’ রয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতার। সেটি হল স্বাস্থ্য। স্বাস্থ্য দফতরের দায়িত্ব ২০১১ সাল থেকে নিজের হাতেই রেখেছেন তিনি। আরজি কর কাণ্ডের পরে রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্য প্রশাসন নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিরোধীরা। স্বাস্থ্য দফতরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসাবে মমতার নেতৃত্বকেও তাঁরা প্রশ্নের মুখে ফেলেছেন। নবান্ন সূত্রের খবর, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে স্বাস্থ্য দফতরের খোলনলচে বদলাতে চান মমতা। সেই ইঙ্গিতও পাওয়া গিয়েছে সোমবার। ওইদিনই রাজ্যের সব সরকারি হাসপাতালের রোগীকল্যাণ সমিতির নতুন চেয়ারম্যানের নাম ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। নবান্নের এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘নতুন বছরে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্য প্রশাসনে আরও নতুন নতুন পদক্ষেপ দেখতে পাবেন। আরজি কর কাণ্ডের পর যেসব ত্রুটি সামনে এসেছে, সেই সব ত্রুটি থেকে স্বাস্থ্য দফতরকে মুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তেমনই নতুন সিদ্ধান্তও নেওয়া হচ্ছে।’’ প্রশাসনের একাংশের বক্তব্য, আরজি করের ঘটনা রাজ্য সরকারকে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা সম্পর্কে সম্যক ‘সজাগ’ করেছে। আরজি কর সংক্রান্ত জুনিয়র চিকিৎসকদের আন্দোলন আগের মতো নেই। নাগরিক আন্দোলেনর ঝাঁজও স্তিমিত। কিন্তু শাসকের উপর উষ্মা যে চলে গিয়েছে, তা নয়। সেই বোধ থেকে উৎসবপর্ব মিটে যেতে দল ও প্রশাসনকে সজাগ করতে উদ্যোগী হয়েছেন তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেত্রী।
অনেকে মমতার এই ‘সক্রিয়তা’র সঙ্গে ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগের প্রস্তুতির তুলনা করছেন। ২০১৫ সালের শেষের দিকে প্রতি শনিবার তৃণমূলের জেলা কমিটিগুলির সঙ্গে কালীঘাটের বাসভবনে বৈঠক করতেন মমতা। পাশাপাশি, কোন দফতরে কী কাজ হয়েছে, নবান্নে বসে সেই খতিয়ান নিতেন স্বয়ং। কিন্তু এ বার সেই প্রস্তুতি বিধানসভার ভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণার দেড় বছর আগে থেকেই শুরু করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সে বার একার হাতে নির্বাচনী রণকৌশল সাজিয়ে দ্বিতীয় বার ‘নীলবাড়ি’ দখল করেছিলেন মমতা। এ বারের লড়াই আরও কঠিন হতে পারে বলেই মনে করছে প্রশাসনিক মহল। তাই প্রস্তুতিও আগে থেকে নেওয়া হচ্ছে।
সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী কালীঘাটের বাসভবনে জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠক ডেকেছিলেন। তখনও তাঁর সতীর্থ বা প্রশাসনিক আধিকারিকেরা মুখ্যমন্ত্রীর এই মনোভাব টের পাননি। কিন্তু গত সোমবার বিধানসভায় এসে দুপুরে তৃণমূল পরিষদীয় দলের বৈঠকের পর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নিজের ঘরে বসে প্রশাসনিক বৈঠক করে যে ভাবে কাজের খতিয়ান চাইতে শুরু করেন মমতা, তাতে দল থেকে শুরু করে রাজ্য প্রশাসনের কর্তারা ‘মিশন ২০২৬’-এর প্রস্তুতির স্পষ্ট বার্তা দেখছেন। মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকে উপস্থিত এক মন্ত্রীর কথায়, ‘‘উনি দেশের অগ্রণী রাজনীতিকদের মধ্যে একজন। উনি আমাদের সকলের চেয়ে এবং সময়ের চেয়ে এগিয়ে ভাবতে পারেন। ২০২৬ সালের ভোটের কথা উনি বৈঠকে তোলেননি। কিন্তু আমরা বুঝতে পেরেছি, বিধানসভা ভোটের আগে তিনি কী ভাবে দল ও প্রশাসনকে প্রস্তুত করবেন, তার নীল নকশা আঁকা হয়ে গিয়েছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy