তৃণমূলের আগামীর পথে আইপ্যাকের ভূমিকা কী হবে? গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
প্রশান্ত কিশোর (পিকে) ভোটকুশলীর কাজ ছেড়ে রাজনৈতিক দল গড়েছেন। কিন্তু তাঁর হাতে তৈরি সংস্থা আইপ্যাক জুড়ে রয়েছে বাংলার শাসকদল তৃণমূলের সঙ্গে। তারাই তৃণমূলের ‘পরামর্শদাতা’ সংস্থা। কিন্তু সেই পেশাদার সংস্থাকে উদ্দেশ্য করে সোমবার বিধানসভায় তৃণমূলের পরিষদীয় দলের বৈঠকে যে মন্তব্য করেছেন মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তার পর দলের মধ্যেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, তৃণমূলের আগামীর পথে আইপ্যাকের ভূমিকা কী হবে?
তৃণমূলের পরিষদীয় দল সূত্রের খবর, বিধায়কদের উদ্দেশে মমতা বলেছিলেন, কে কোথায় কী ‘প্যাক-ফ্যাক’ করল, তা নিয়ে ভাবার দরকার নেই। সূত্রের খবর, মমতা এ-ও বলেছেন, সংস্থার নাম করে ফোন করে কেউ যদি কোনও তথ্য চায়, তা যেন বিধায়কেরা না দেন। যা জানানোর তাঁকে এবং রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সীকে সরাসরি জানানোর পরামর্শ দিয়েছেন মমতা।
‘প্যাক ফ্যাক’ বলতে মমতা কাদের বোঝাতে চেয়েছেন, তা বিধায়কদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি। সংশ্লিষ্ট সংস্থারও তা না-বোঝার কথা নয়। কিন্তু মঙ্গলবার এ নিয়ে আইপ্যাকের কেউই আনুষ্ঠানিক ভাবে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তবে সূত্রের খবর, তারা মমতার মন্তব্যকে ‘তলিয়ে’ দেখতে চাইছে।
বিধায়কদের কেউ কেউ বলছেন, ফোনে তথ্য দেওয়ার বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের ‘সাবধান’ করেছেন। যে কেউ তথ্য চাইলেই তা দিতে বারণ করেছেন তিনি। সেই সূত্রেই আইপ্যাকের একটি অংশের অভিমত, ওই মন্তব্য সরাসরি তাদের উদ্দেশে করা হয়নি। সামগ্রিক ভাবে বলা হয়েছে। যাতে বিধায়কেরা মমতা বা বক্সীকেই সরাসরি তথ্য দেন। কিন্তু দলের পোড়খাওয়া নেতাদের অনেকে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। এক প্রবীণ সাংসদের কথায়, ‘‘এতে তলিয়ে ভাবার কিছু নেই। আইপ্যাক ছাড়া তৃণমূলের বিধায়কদের অন্য কেউ ফোন করে তথ্য জানতে চাইবে কেন?’’ তাঁর এ-ও বক্তব্য যে, ‘‘পেশাদার সংস্থা যে কায়দায় কাজ করছিল, মমতা আসলে সেই মাঠটাকেই ছোট করে দিতে চেয়েছেন।’’
আইপ্যাকের সঙ্গে সমন্বয় রেখে চলার ক্ষেত্রে তৃণমূলে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা নেয় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্যামাক স্ট্রিটের দফতর। সম্প্রতি মমতার একাধিক সিদ্ধান্তে অভিষেকের এক্তিয়ারেও ‘রাশ’ টানা হয়েছে বলে মনে করছেন তৃণমূলের অনেকে। পেশাদার সম্পর্কে তৃণমূলনেত্রীর বক্তব্যকে তার সঙ্গেই জুড়ে দেখতে চাইছেন দলের প্রথম সারির নেতৃত্বের বড় অংশ।
উল্লেখ্য, এর আগেও আইপ্যাকের সঙ্গে তৃণমূলের মূল সংগঠনের ‘অবনিবনা’ প্রকাশ্যে এসেছিল। আবার তা মিটেও গিয়েছিল। ২০২২ সালের পুরসভা নির্বাচনের সময়ে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়দের দেওয়া প্রার্থীর তালিকা এবং সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেকের তালিকার পার্থক্য নিয়ে সরগরম হয়েছিল শাসকদলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। গত পঞ্চায়েত ভোটের সময়েও দল এবং সংস্থার ‘ঠোকাঠুকি’ হয়েছিল। আবার পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে অভিষেক যখন কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ পর্যন্ত ‘নবজোয়ার যাত্রা’ করেছিলেন, তখন আইপ্যাকের ভূমিকার প্রশংসাই করেছিলেন মমতা। ছ’মাস আগের লোকসভা ভোটের ফলাফলের পরেও আইপ্যাক কর্তা প্রতীক জৈন এবং তাঁর টিমকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন তৃণমূলনেত্রী। ফল ঘোষণার সন্ধ্যায় মমতা এবং অভিষেকের সঙ্গে প্রতীক নিজের হাসিমুখের ছবি এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে পোস্ট করেছিলেন। ফলে আইপ্যাক সম্পর্কে মমতা এখন যে মনোভাব দেখাচ্ছেন, আগামী দিনেও তা স্থায়ী হবে, তেমন না-ও হতে পারে বলে অভিমত দলেরই অনেকের। তাঁরা দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন অতীতের।
গত কয়েক মাস ধরেই তৃণমূলে সাংগঠনিক এবং পুরসভার প্রশাসনিক স্তরে রদবদল হবে বলে জল্পনা রয়েছে। গত ২১ জুলাইয়ের সভা থেকে সেই ঘোষণা করেছিলেন অভিষেকই। সেই সংক্রান্ত প্রস্তাবও যে অভিষেক মমতাকে দিয়ে দিয়েছেন, তা-ও জানিয়েছেন তিনি। আমেরিকায় চোখের চিকিৎসা করাতে যাওয়ার আগে রদবদলের প্রস্তাব নেত্রীর কাছে দিয়ে গিয়েছিলেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু তা এখনও ‘বাস্তবায়িত’ হয়নি। গত ৭ নভেম্বর নিজের জন্মদিনে একান্ত আলোচনায় অভিষেক আশা প্রকাশ করেছিলেন, উপনির্বাচনের ফল ঘোষণার পরে রদবদল বাস্তবায়িত হবে। কিন্তু তার পরে ১০ দিন কেটে গেলেও রদবদল সংক্রান্ত ঘোষণা হয়নি। তৃণমূলের অনেকের বক্তব্য, রদবদল হলে দেখতে হবে, পরামপর্শদাতা সংস্থার পরামর্শ কতটা গুরুত্ব পেল মমতার কাছে। যা থেকে ‘ভবিষ্যৎ’ সম্পর্কে কিছুটা আন্দাজ করা যাবে।
২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বাংলায় বিজেপির কাছে ‘ধাক্কা’ খাওয়ার পরেই প্রশান্ত কিশোরকে নিয়ে নবান্নে মমতার সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন অভিষেক। তার পরে তৃণমূলের সঙ্গে চুক্তিও করে আইপ্যাক। গত লোকসভা ভোটে তৃণমূলের বিপুল জয়ের পরে সেই চুক্তির মেয়াদও বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে আইপ্যাকের ভূমিকা নিয়ে তৃণমূলের প্রবীণদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। এবং তা নতুন নয়। গোড়া থেকেই। যদিও ২০২১ সালের বিধানসভা ভোট পর্যন্ত সে ব্যাপারে তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব খুব একটা আমল দেননি। দেখা গিয়েছিল, পেশাদার সংস্থার পরামর্শে তৃণমূল সেই ‘কঠিন’ ভোটে জিতেছিল। কিন্তু তার পরেই দলের মধ্যে ক্ষোভ ধূমায়িত হতে থাকে। যা জেলায় জেলায় প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। তৃণমূলে যাঁরা ‘ধ্রুপদী’ ঘরানার, তাঁরা মনে করেন আইপ্যাক ‘দলের মধ্যে দল’ তৈরি করছে। দলের এক প্রবীণ নেতার কথায়, ‘‘পরামর্শদাতা সংস্থা পরামর্শ দিলে অসুবিধা নেই। কিন্তু তারা নিজেদেরই দল ভেবে ফেলছে। তাতেই সমস্যা তৈরি হচ্ছে।’’ আবার নবীন প্রজন্মের এক নেতার বক্তব্য, ‘‘দলের অনেকেই ভাবেন, তাঁদের ভাবনাটাই সঠিক। ১০ বছর আগের পরিস্থিতি মাথায় নিয়ে তাঁরা দল পরিচালনা করতে যান। কিন্তু প্রতি দিন যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে, তা তাঁদের ভাবনার মধ্যে থাকে না। এই জন্যই আইপ্যাকের প্রয়োজন।’’ বস্তুত, ‘নবীন’ প্রজন্মের অনেকে মনে করেন, সময় বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতির ধারাও বদলে গিয়েছে। সেই ধারাতেই কাজ করে আইপ্যাক পর পর ভোটে দলকে সাফল্য এনে দিচ্ছে। পাল্টা যুক্তিতে তৃণমূলের প্রবীণদের বক্তব্য, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি সরে গেলে কোনও সংস্থাই কিছু করতে পারবে না। আসল হল মমতার মুখ।’’
প্রসঙ্গত, সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে দলের ‘সমন্বয়’ রাখার ক্ষেত্রেও অভিষেকের দফতর এবং আইপ্যাক যুগলবন্দিতেই কাজ হত। কোন মুখপাত্র কোন চ্যানেলে, কোন বিষয়ে বলতে যাবেন, তা ঠিক হত ক্যামাক স্ট্রিট থেকে। যার নেপথ্যে থাকত আইপ্যাক। কিন্তু আরজি কর পর্বে সেই কাজ থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয় অভিষেকের দফতর। তার পর তা দেখছিল রাজ্য সভাপতি বক্সীর দফতর। কিন্তু মৌখিক ভাবে সমগ্র বিষয়টি তত্ত্বাবধানের বিষয়ে মমতা দায়িত্ব দিয়েছিলেন মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসকে। জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকে এ বিষয়ে অরূপকে ‘আনুষ্ঠানিক’ ভাবেও দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি মুখপাত্রদের নিয়ে একটি হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপও খুলেছেন। যে তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন ‘অভিষেক-ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিত চার মুখপাত্র। আবার সর্বভারতীয় চ্যানেলে তৃণমূল কাকে পাঠাবে, তা ঠিক করার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে দিল্লিতে। সংবাদমাধ্যমের উদ্দেশে একটি ‘বিন্যাস’ পাঠিয়েছে তৃণমূল। সেখানে চ্যানেলের নাম, আলোচনার বিষয়, সঞ্চালকের নাম আর অন্য কারা প্যানেলে থাকবেন, তাঁদের মধ্যে কত জন প্রাক্তন বা বর্তমান সাংসদ, এই বিষয়গুলি উল্লেখ করে নির্দিষ্ট নম্বরে হোয়াট্সঅ্যাপ পাঠাতে হবে। তার পরে তৃণমূল প্রতিনিধি ঠিক করে পাঠাবে। তবে কোনও প্যানেলে তিন জনের বেশি থাকলে তৃণমূল কাউকে পাঠাবে না। এই কাজও আগে আইপ্যাক এবং অভিষেকের অফিসের যুগলবন্দিতেই হত।
সমাজমাধ্যমে প্রচারের অভিমুখ কী হবে, কী ধরনের বিষয়বস্তু প্রচার করা হবে, তা ঠিক করে আইপ্যাক সংস্থাটি। আবার তারাই জেলায় জেলায় গিয়ে পাড়া-মহল্লা স্তরে সমীক্ষাও চালায়। সেই সমীক্ষা কখনও সাংগঠনিক বিষয়ে হয়, আবার কখনও সরকারি প্রকল্পের বাস্তবায়ন নিয়েও হয়। যার ভিত্তিতে অভিষেকের দফতর রিপোর্ট তৈরি করে পাঠায় মমতাকে। নির্বাচনে ‘আসনভিত্তিক’ পৃথক দল কাজ করে। যেমন সদ্যসমাপ্ত ছ’টি বিধানসভার উপনির্বাচনেও আইপ্যাকের দল পুরোদমে কাজ করেছে বলেই খবর। ছ’টিতেই হাসতে হাসতে জিতেছে তৃণমূল।
তৃণমূলের প্রথম সারির নেতাদের অনেকেই মনে করছেন, আপাতত আইপ্যাককে প্রকাণ্ড গাছ থেকে ‘বনসাই’ করে দেওয়া হয়েছে। আগামীতে আইপ্যাকের ভবিষ্যৎ নির্ণিত হবে ভবিষ্যতেই। যা আসলে নির্ভর করবে দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের নিজেদের মধ্যে ‘বোঝাপড়া’র উপর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy