স্টার থিয়েটারের নাম বদলের ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
‘‘আমি জানিতাম যে আমারই নামে “নাম” হইবে! কিন্তু যেদিন উহারা রেজেষ্ট্রি করিয়া আসিলেন— আমি তাড়াতাড়ি জিজ্ঞাসা করিলাম যে থিয়েটারের নূতন নাম কি হইল? দাসুবাবু প্রফুল্ল ভাবে বলিলেন ‘ষ্টার।’ এই কথা শুনিয়া আমি দুই মিনিট কাল কথা কহিতে পারিলাম না।’’ স্টার থিয়েটার নিজের নামে না হওয়ায় তিনি কতটা ‘আঘাত’ পেয়েছিলেন, তা এ ভাবেই আত্মজীবনীতে লিখে যান নটী বিনোদিনী। মাঝে কেটে গিয়েছে ১৪১ বছর। এত দিনে ‘প্রতারিত’ বিনোদিনীর নাম স্টার থিয়েটারের সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছে। সৌজন্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমবার সন্দেশখালির সভা থেকে তিনি ঘোষণা করেছেন, বিনোদিনীর নামে এই প্রেক্ষাগৃহের নামকরণ হবে। অনেকের মতে, এক দিন ‘বঞ্চনা’ করা হয়েছিল বিনোদিনীকে, এত দিনে তিনি তাঁর যোগ্য স্বীকৃতি পেলেন।
১৪১ বছর আগে ১৮৮৩ সালে উত্তর কলকাতারই বিডন স্ট্রিটে প্রথম তৈরি হয় স্টার থিয়েটার। সেই সময় নাট্যব্যক্তিত্ব গিরিশচন্দ্র ঘোষ বিনোদিনীকে স্টার থিয়েটার তৈরির টাকা জোগাড় করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। বলা হয়েছিল তাঁর নামেই নাম রাখা হবে থিয়েটারের। বিনোদিনী লেখেন, ‘‘থিয়েটার যখন প্রস্তুত হয় তখন সকলে আমায় বলেন যে ‘এই যে থিয়েটার হাউস্ হইবে, ইহা তোমার নামের সহিত যোগ থাকিবে। তাহা হইলে তোমার মৃত্যুর পরও তোমার নামটী বজায় থাকিবে।’’’ ঠিক হয়েছিল প্রেক্ষাগৃহের নাম হবে ‘বি থিয়েটার’। তাতে উৎসাহ পান বিনোদিনী। গিরিশের অনুরোধ ফেলতে পারেননি তিনি। বিনোদিনী তাঁর ভক্ত গুর্মুখ রায়ের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা তুলে তা দিয়েছিলেন স্টার থিয়েটার তৈরির জন্য। সেই টাকাতেই শুরু হয় থিয়েটার তৈরির কাজ। থিয়েটার উদ্বোধনের কয়েক সপ্তাহ আগে বিনোদিনী জানতে পারেন ‘নাম’ পাল্টে গিয়েছে। নতুন থিয়েটারের রেজিস্ট্রি হয়েছে ‘স্টার’ নামে। বিনোদিনীর নামে ‘নাম’ রাখলে তৎকালীন সমাজ আপত্তি তুলতে পারে সেই ‘যুক্তি’তেই শেষ লগ্নে বিডন স্ট্রিটের প্রেক্ষাগৃহের নাম রাখা হয় স্টার থিয়েটার। এ কথা জানতে পেরে অনেক কিছু বলার ইচ্ছে ছিল বিনোদিনীর। কিন্তু পারেননি। বিনোদিনী লেখেন, ‘‘আত্মসংবরণ করিয়া বলিলাম, ‘বেশ!’’’ পরে তিনি বোঝেন তাঁর সঙ্গে ‘ছলনা’ করা হয়েছে। সে সময় বিনোদিনীর মনে হয়েছিল, ‘‘উঁহারা কি শুধু আমায় মুখে স্নেহ মমতা দেখাইয়া কার্য্য উদ্ধার করিলেন? কিন্তু কি করিব, আমার আর কোন উপায় নাই!’’ ‘প্রতারিত’ বিনোদিনী আত্মজীবনীতে লেখেন, ‘‘আমি স্বপ্নেও ভাবি নাই যে উঁহারা ছলনা দ্বারা আমার সহিত এমন ভাবে অসৎ ব্যবহার করিবেন।’’
পাঁচ বছর পরে ১৮৮৮ সালে বিডন স্ট্রিটের ‘স্টার’-এর ঠিকানা বদল হয়। উত্তর কলকাতার হাতিবাগানের কর্নওয়ালিস স্ট্রিট (অধুনা বিধান সরণি)-এ দ্বিতীয় স্টার থিয়েটার তৈরি হয়। হাতিবাগানের এই স্টার থিয়েটার তৈরিতে সরাসরি কোনও টাকা দেননি বিনোদিনী। এমনকি, হাতিবাগানের স্টার থিয়েটারে কোনও দিন অভিনয়ও করেননি। কিন্তু নতুন স্টার থিয়েটার গড়ার জন্য সেই সময় নাট্যব্যক্তিত্ব অমৃতলাল বসু, ধর্মদাস সুর প্রমুখ স্টার থিয়েটারের সঙ্গে বিনোদিনীর জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়েছিলেন।
বিডন স্ট্রিটের প্রথম স্টার থিয়েটার নানা হাত বদল হয়ে নাম হয় ‘মনমোহন থিয়েটার’। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ তৈরির সময়ে ১৯২৮ সালে সেই ‘স্টার’ ভাঙা পড়ে। কিন্তু বিনোদিনী আর স্টারের সম্মিলিত নাম-মাহাত্ম্য এমনই যে, পরবর্তী কালে হাতিবাগানের স্টার থিয়েটারের সঙ্গেও মানুষ বিনোদিনীর স্মৃতি সংযুক্ত করে এসেছেন। সেই স্টারের সঙ্গে এত দিনে জুড়ছে বিনোদিনীর নাম। নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন অভিনেত্রী রুক্মিনী মৈত্র। নারীদের সম্মান জানানোর পাশাপাশি ১৪১ বছরের লড়াই জিততে সাহায্য করার জন্য মমতাকে ধন্যবাদ জানান তিনি। উল্লেখ্য, আসন্ন ‘বিনোদিনী’ ছবিতে নামভূমিকায় অভিনয় করছেন রুক্মিনী। তৃণমূল সাংসদ ও অভিনেতা দেবের প্রযোজনায় ছবিটি তৈরি হয়েছে। আর রুক্মিনী দেবেরই বান্ধবী।
রাজ্যের মন্ত্রী তথা নাট্যব্যক্তিত্ব ব্রাত্য বসুর মতে, স্টার থিয়েটারের সঙ্গে নটী বিনোদিনী নামটি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত আছে। তাঁর কথায়, ‘‘নটী বিনোদিনীকে যোগ্য সম্মান দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। এর সঙ্গে দেড়শো বছরের ইতিহাসকে সম্মান জানালেন তিনি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy