ফাইল চিত্র।
এমনটা বাংলাই প্রথম ভাবল কি না, তা নিশ্চিত না-ও বলা যেতে পারে। তবে এমন পদক্ষেপের দৌড়ে এগিয়ে বাংলাই! যদিও রাজ্যে সব সরকারি (রাজ্য) বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকেই আচার্য হিসেবে ঘোষণার সিদ্ধান্তটি সারস্বত সমাজের অনেকেই হজম করতে পারছেন না।
প্রবীণ ইতিহাসবিদ তথা বিশ্বভারতীর মতো কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য রজতকান্ত রায়ই রাজ্য মন্ত্রিসভার নতুন সিদ্ধান্তে স্তম্ভিত। তিনি স্পষ্ট বলছেন, ‘‘এটা আইনে সম্ভব কি না দেখতে হবে। তবে তা হলেও, এমনটা অবাঞ্ছিত। এটাকে জঘন্য মনোবৃত্তিই বলব।’’ পশ্চিমবঙ্গের এমন সিদ্ধান্তের পিছনে মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যপালের মধ্যে নিরন্তর সংঘাতের প্রেক্ষাপট আছে, যা রাজ্যে সবারই জানা! রজতকান্তের মতে, ‘‘রাজ্যপাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আচার্য হবেন এটাই এ রাজ্যে প্রচলিত নিয়ম। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অবশ্যই বিশেষ পরিস্থিতি। রাজ্যপালের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর নানা বিষয়ে লড়াই চলছে। কিন্তু এই তাৎক্ষণিক পরিস্থিতির জন্য নিয়ম পালটাবে কেন?’’
এমনিতে এ দেশের বিভিন্ন কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রপতি ‘ভিজ়িটর’ পদে আসীন থাকেন। বেশির ভাগ রাজ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রাজ্যপাল। তবে বিশ্বভারতীর মতো কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার আচার্য প্রধানমন্ত্রী। কারও কারও যুক্তি, মুখ্যমন্ত্রীর মতো প্রধানমন্ত্রীও জনপ্রতিনিধি। মুখ্যমন্ত্রীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য করা হলে প্রধানমন্ত্রীকে আচার্য করাও গর্হিত হবে। বিশ্বভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য রজতকান্তবাবু অবশ্য মনে করেন, ‘‘বিশ্বভারতীর বিষয়টি আলাদা। বিশ্বভারতীর আচার্য পদে প্রধানমন্ত্রী থাকার পরম্পরাটি ঐতিহাসিক।
তা জওহরলাল নেহরুর আমল থেকে চলে আসছে।’’ এক বার বিশ্বভারতীর ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটেছিল বলে মনে করাচ্ছেন অর্থনীতির প্রবীণ অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক সৌরীন ভট্টাচার্য। প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই আচার্য হতে রাজি না-হলে তখন সাহিত্যিক উমাশঙ্কর জোশীকে আচার্য করা হয়। সৌরীনবাবুর আক্ষেপ, ‘‘পরে প্রধানমন্ত্রীর বদলে অন্য কোনও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদকে আচার্য পদে বসানোর সুযোগ তখনই তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তা মানা হয়নি।’’ পরে বিশ্বভারতীতেও কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের নানা অভিযোগ উঠেছে। আচার্য পদে প্রধানমন্ত্রীর বদলে অন্য কেউ থাকলে পরিস্থিতি আর একটু ভাল হত কি না, তাও শিক্ষাবিদদের জল্পনার বিষয়।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আচার্য— এ কথা বলে রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে আচার্য পদে মুখ্যমন্ত্রীকে বসানোর চেষ্টা কুযুক্তি বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ অমল মুখোপাধ্যায়। তিনি সোজাসুজি বলছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী হলেন রাজ্যে প্রশাসনিক প্রধান। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হলে সরকারের হস্তক্ষেপ তো সর্বাত্মক হবেই! এবং তার থেকেও বড় কথা, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভাবেন, সরকারটা তাঁর জমিদারি। তিনি এ বার উপাচার্যকে যা খুশি আদেশ দেবেন। সেটা তাঁরা মানতে বাধ্য হবেন। এতে শিক্ষার সর্বনাশ ছাড়া অন্য কিছু দেখছি না।’’ সৌরীনবাবুও মনে করছেন, যা চলছে তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে। তাঁর কথায়, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ে আচার্যের পদটির আলাদা মর্যাদা এবং কৌলীন্য। রোজকার কাজকর্মে ওঁর মাথা ঘামানোর কথা নয়। অনেকটা যেমন সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে রাষ্ট্রপতিকে বলা হয়। রাজ্যপাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হলেও তাঁর পদটি আলঙ্কারিক। প্রশাসনের প্রধান আধিকারিক হিসেবে মুখ্যমন্ত্রীর আচার্য হওয়াটা অনভিপ্রেত।’’
তা ছাড়া, সব ক’টি বিশ্ববিদ্যালয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে আচার্য করতে হলে কতগুলি আইন পাশ করাতে হবে এবং তাতেও রাজ্যপালের ভূমিকা কী হবে, সে-সব নিয়েও শিক্ষাজগৎ মুখর। ফের রাজ্যপাল-মুখ্যমন্ত্রী তথা কেন্দ্র-রাজ্যে নতুন টানাপড়েনেরও আশঙ্কা করছেন অনেকে।
সাম্প্রতিক অতীতে কেরল এবং তামিলনাডুর কয়েকটি ঘটনা নিয়েও এখন আলোচনা চলছে রাজ্যে। তা তুলে ধরে পশ্চিমবঙ্গের বিশ্ববিদ্যালয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে আচার্য পদে বসাতে মন্ত্রিসভার তদ্বিরকে কেউ কেউ মান্যতা দিতে চাইছেন। কেরলেও রাজ্যপাল-মুখ্যমন্ত্রী সংঘাত এ রাজ্যের সঙ্গে তুলনীয়। তাঁকে নানা অনৈতিক কাজে সায় দিত হচ্ছে বলে মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নকে চিঠি দিয়ে কেরলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য পদ ছাড়তে চেয়েছিলেন রাজ্যপাল। কিন্তু তা উড়িয়ে দেন কেরলের মুখ্যমন্ত্রী। আর তামিলনাডুতে ডাক্তারি পড়ার একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিনকে বিধানসভায় বিল পাশ করে আচার্য করা হয়। তামিলনাডুর উচ্চ শিক্ষামন্ত্রীকেও বলতে শোনা যায়, রাজ্যপাল নয়, মুখ্যমন্ত্রীই বিশ্ববিদ্যালয়ে আচার্য হিসেবে বরণের যোগ্য। বিরোধীদের সমালোচনার মুখে তিনিই আবার গুজরাতে শাসক বিজেপি-র বিশ্ববিদ্যালয় তথা শিক্ষাঙ্গনে নিয়ন্ত্রণ বা উপাচার্য নিয়োগে যথেচ্ছাচার নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
তবে পশ্চিমবঙ্গেও শিক্ষাক্ষেত্রে শাসক দলের সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ বাম আমল থেকেই চলে আসছে। বাম আমলে এই দখলদারির নাম লোকমুখে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাসের নামে ‘অনিলায়ন’ বলে এক সময়ে ছড়িয়ে পড়ে। আজকের জমানায় রাজ্যে অন্য সব কিছুর মতো শিক্ষাক্ষেত্রেও তা ‘মমতায়ন’ বা ‘মমতার ছোঁয়া’ বলে অনেকে দেখছেন। কারও আক্ষেপ, বাম আমলে সরকারি নিয়ন্ত্রণে তা-ও কিছু আড়াল থাকত, এ বার আর আড়াল-আবডালটুকুও থাকছে না।
এ সব কটাক্ষের জবাবে মুখ খুলেছেন তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত পুরাণবিদ অধ্যাপক নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি। তাঁর কথায়, ‘‘রাজ্যপালের তো সহায়ক অভিভাবকের ভূমিকা থাকার কথা ছিল। কিন্তু সেটা কি দেখা যাচ্ছে? তা ছাড়া, আগেও সব সিদ্ধান্ত রাজ্য সরকার নিত, আচার্য রাজ্যপালের কাজ ছিল সই করা। মুখ্যমন্ত্রী সই করলে তফাৎটা কী?’’ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসন, স্বাধীন সত্তার অস্তিত্বটাও ‘মৌখিক আড়ম্বর’ বলে কার্যত ছুড়ে ফেলছেন নৃসিংহবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘এটা কি হার্ভার্ড না বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়? কোন বিশ্ববিদ্যালয় এখানে আর্থিক ভাবে স্বনির্ভর! তা না-হলে স্বশাসনের কথা লোক দেখানো।’’ আর বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজ্য সরকারের হস্তক্ষেপ প্রসঙ্গে নৃসিংহবাবুর যুক্তি, ‘‘কে আর শুধু নিজের কাজটুকু করছে। বিশ্বভারতীও তো ধ্বংস হয়ে গেল। সিবিআই, ইডি সবার তদন্তেরও দফা রফা। বিচারবিভাগই বা কেন কারও চাকরির নিয়োগে হস্তক্ষেপ করবে!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy