Advertisement
E-Paper

ওয়াকফ সংশোধনী বিল নিয়ে রাস্তায় নেমে আন্দোলনে বাংলার শাসকদল, আগামী বছর ভোটের বাংলায় কী প্রভাব পড়তে পারে

গত কয়েক বছর ধরেই বঙ্গ রাজনীতি মেরুকরণের চক্রব্যূহে। এক দিকে হিন্দু ভোটকে এককাট্টা করার লক্ষ্যে লাগাতার প্রয়াস জারি রেখেছে বিজেপি। অন্য দিকে তৃণমূলও তাদের সঙ্গে থাকা সংখ্যালঘু ভোটকে সংহত রাখতে চাইছে। সেই আবহেই লোকসভায় পাশ হল ওয়াকফ বিল।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। — ফাইল চিত্র।

শোভন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০২৫ ১৪:৩০
Share
Save

টানা ১৩ ঘন্টা বিতর্ক এবং ভোটাভুটির পরে বুধবার মধ্যরাতের পর লোকসভায় পাশ হয়ে গিয়েছে ওয়াকফ সংশোধনী বিল। বৃহস্পতিবার সেটি আনা হবে রাজ্যসভায়। সেখানেও বিলটি পাশ হয়ে যাবে। তার পরে তা পরিণত হবে আইনে। ওয়াকফ বিল নিয়ে প্রথম থেকেই তীব্র বিরোধিতার লাইন নিয়েছে বাংলার শাসকদল তৃণমূল। বৃহস্পতিবার থেকেই পথে নামছে তারা। কারণ, ওয়াকফ সংশোধনী বিল আইনে পরিণত হলে আগামী বছর বাংলার বিধানসভা নির্বাচনে তার ‘প্রভাব’ পড়তে পারে।

কী প্রভাব পড়বে? বাংলায় মূলস্রোতের সমস্ত রাজনৈতিক দলই মানছে, এর ফলে ধর্মীয় মেরুকরণ আরও প্রকট এবং তীব্র হবে। কোনও দলের নেতারা প্রকাশ্যে সে কথা বলছেন, কোনও কোনও দলের নেতারা বলছেন না। কেউ বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিচ্ছেন।

যেমন একটি ব্যাখ্যা বলছে, এর ফলে সংখ্যালঘুদের মধ্যে যে ‘ভীতি’ জিইয়ে থাকবে, তাতে নির্বাচনী রাজনীতিতে লাভবান হবে তৃণমূল। বিপরীত ব্যাখ্যা বলছে, ‘দোদুল্যমান’ হিন্দুদের কাছে আরও ‘বলিষ্ঠ’ বার্তা পৌঁছে দিতে পারবে বিজেপি। তৃণমূল-বিজেপি উভয়ের সঙ্গে দূরত্ব রাখা বঙ্গের রাজনৈতিক শিবিরের অনেকে বলছেন, মেরুকরণের পাশাপাশি ওয়াকফ সংশোধনী বিল আইনে পরিণত করার নেপথ্যে কাজ করছে দেশের ‘রিয়্যাল এস্টেট লবি’র স্বার্থ। অর্থাৎ, মোড়ক ধর্মীয় হলেও আসলে উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক মুনাফা।

গত কয়েক বছর ধরেই বঙ্গ রাজনীতি মেরুকরণের চক্রব্যূহে। এক দিকে হিন্দু ভোটকে এককাট্টা করার লক্ষ্যে লাগাতার প্রয়াস জারি রেখেছে বিজেপি। ভোটের এক বছর আগে থেকে যে মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন শুভেন্দু অধিকারীরা। অন্য দিকে তৃণমূলও তাদের সঙ্গে থাকা সংখ্যালঘু ভোটকে শুধু সংহত রাখতে চাইছে না, অন্যত্র যেটুকু ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে, তা-ও নিজেদের বাক্সে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে। ন’বছর পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক ফুরফুরা সফরকে সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই দেখা হচ্ছে।

বাংলার ২৯৪টি বিধানসভার মধ্যে ৭৪টি বিধানসভা সংখ্যালঘু অধ্যুষিত। তার পাশাপাশি আরও ২০-২৫টি বিধানসভা রয়েছে, যেখানে সংখ্যালঘু ভোট ‘নির্ণায়ক’। সব মিলিয়ে অন্তত ১০০টি আসনে সংখ্যালঘু ভোট জয়ের ‘চাবিকাঠি’। খাতায়কলমে রাজ্য মুসলিম ভোট কম-বেশি ৩০ শতাংশ। কিন্তু অনেকের মতে, গত এক দশকে সেই ভোট আরও কয়েক শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সঠিক পরিসংখ্যান নিয়ে সন্দিহান অনেকেই। কারণ, গত দেড় দশক জনশুমারি হয়নি।

তৃণমূলের নেতারা একান্ত আলোচনায় মানছেন, আগামী বছর বিধানসভা ভোটে তাঁদের অন্যতম ‘হাতিয়ার’ হতে চলেছে ওয়াকফ। যা মুসলিম ভোটকে একচেটিয়া ভাবে একত্রিত করতে কাজ করবে। শাসকদলের তরফে এ-ও তুলে ধরা হবে যে, সংসদে ওই বিল রুখতে তৃণমূলের সাংসদেরা কী কী ভূমিকা নিয়েছেন। পাল্টা বিজেপি চেষ্টা করবে এই ভাষ্য তৈরি করার যে, তারাই ওয়াকফ সংশোধনী বিল এনে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় আইনে হস্তক্ষেপ করতে পেরছে। পদ্মশিবিরের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘‘ওয়াকফ নিয়ে সংখ্যালঘুদের মধ্যে যে বোধ রয়েছে, বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে তা নেই। প্রচারে সেটাই তুলে ধরতে হবে যে, আমরাও ভাঙতে পারি।’’ বিজেপির এ-ও আশা, মিশ্র জনবসতি এলাকায় ওয়াকফ হিন্দুদেরকেও একত্রিত করতে ভূমিকা নেবে। অর্থাৎ এক দিকে বিজেপি যেমন ওয়াকফ আইনকে ‘হিন্দু অস্মিতা’ হিসাবে ব্যবহার করবে, তেমন তৃণমূল এটিকে মুসলিমদের প্রতি ‘বঞ্চনা’ হিসাবে প্রচার করবে। শাসকদল দেখাতে চাইবে, তারা লড়াই করেছিল। এ-ও বলবে যে, যত দিন বাংলায় মমতা আছেন, তত দিন ওয়াকফ সম্পত্তিতে কেউ হাত দিতে পারবে না। কারণ, জমিজমার বিষয় রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত।

ওয়াকফ বিলের পক্ষে যুক্তি

কেন্দ্রের তরফে যুক্তি, এই বিল সার্বিক ভাবে মুসলিমদের উন্নতির জন্য। সেই সূত্র ধরেই কেন্দ্রের বিজেপি নেতাদের আলোচনায় আসছে তিন তালাক বাতিলের প্রসঙ্গ। পদ্মশিবিরের বক্তব্য, সেই সময়েও বিরোধীরা বাধা দিয়েছিল। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী সরকার চেয়েছিল নির্মমতার বেড়াজাল থেকে মুসলিম মহিলাদের মুক্ত করতে। লোকসভায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কিরেন রিজিজু বুধবার বলেছেন, ‘‘আমাদের দেশে মোট ওয়াকফ সম্পত্তির সংখ্যা ৪.৯ লক্ষ থেকে বেড়ে ৮.৭২ লক্ষ হয়েছে। এই পরিমাণ ওয়াকফ সম্পত্তি সঠিক ভাবে পরিচালিত হলে শুধু মুসলমানদের জীবনকেই উন্নত হবে না, সমগ্র দেশের ভাগ্যও বদলে দেবে।’’ রিজিজুর আরও দাবি, মুসলমান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিশ্বাসে ‘হস্তক্ষেপ’ করছে না সংশোধিত বিলটি। একই সঙ্গে তিনি জানান, নতুন বিলে কেবল ওয়াকফ সম্পত্তির দেখভাল সংক্রান্ত বিষয় নিয়েই কাজ করার কথা বলা হয়েছে। পদ্মশিবিরের বক্তব্য, ওয়াকফ বিলে মুসলিম মহিলাদের অংশগ্রহণের কথা বলা হয়েছে। বিরোধীরা কি চায় না মুসলিম মহিলাদের ক্ষমতায়ণ হোক? তাঁরা ওয়াকফের কার্যকলাপ নির্ধারণ করুন?

ওয়াকফের বিলের বিরুদ্ধে যুক্তি

বিজেপি-বিরোধী প্রায় সব দলই প্রাথমিক ভাবে দু’টি কথা বলছে। এক, ধর্মীয় বিষয়ে কখনও কোনও সরকার নাক গলাতে পারে না। দুই, এই বিল সংবিধানের বিরোধী। ওয়াকফের বিষয়ে সম্যক ধারণা থাকা রাজ্য সরকারের এক পদস্থ আধিকারিকের দু’টি যুক্তি দিচ্ছেন। প্রথমত, তাঁর কথায়, ‘‘ধর্ম ব্যক্তিগত বিষয়। এখানে কখনও সরকার নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে পারে না। দ্বিতীয়ত, ওয়াকফ আইন এত দিন ছিল ব্যক্তিগত আইন। এ বার সেটা সর্বজনীন করে দেওয়া হচ্ছে।’’ উদাহরণ হিসাবে তিনি বলেন, ‘‘ধরা যাক, আমি কাউকে একটা পাঞ্জাবি দেব করব। এত দিন পর্যন্ত আমিই ঠিক করতাম কাকে দেব। এ বার থেকে ‘কী’ দেবটা আমি ঠিক করলেও ‘কাকে’ দেব, সেটা সরকার ঠিক করে দেবে। ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোয় এটা কখনও হয় না।’’ তৃণমূলের সাংসদ তথা ওয়াকফ জেপিসির অন্যতম সদস্য কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘সংখ্যার জোরে সংসদে বিল পাশ করালেও আমার মনে হয় সুপ্রিম কোর্টে তা আটকে যাবে। কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিজেপি যা করছে, তা সরাসরি সংবিধান লঙ্ঘন করছে। এটা হতে পারে না।’’ বিরোধীদের এ-ও যুক্তি যে, ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিম সদস্য রাখার রাস্তা খুলে দিচ্ছে এই বিল। তা হলে কেন কাশী-বিশ্বনাথ মন্দিরের ট্রাস্টি বোর্ডে অহিন্দু কাউকে রাখা হবে না? তাতে বাধা কোথায়?

যুক্তি এবং পাল্টা যুক্তিতে স্পষ্ট, মেরুকরণের চক্রব্যূহেই আপাতত আটক থাকবে বঙ্গ রাজনীতি। ইটাহারের তৃণমূল বিধায়ক, শাসকদলের সংখ্যালঘু সেলের চেয়ারম্যান তথা রাজ্যের সংখ্যালঘু বিত্ত নিগমের চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন যেমন বিজেপির বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়ে বলেছেন, ‘‘ওরা উগ্র মুসলিম বিরোধী দল। বিজেপি ধার্মিকদের দল নয়। ওরা ধর্ম ব্যবসায়ী। এ সব করে ওরা হিন্দু ভোটের মেরুকরণের চেষ্টা করছে।’’ হিন্দু ভোট বিজেপির দিকে একত্রিত হলে কি তৃণমূলের মুসলিম ভোট একত্রিত করতে সুবিধা হবে না? মোশারফের জবাব ‘‘সংখ্যালঘু ভোট এমনিতেই তৃণমূলের সঙ্গে রয়েছে। বাংলার সংখ্যালঘু মানুষ মনে করেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই তাঁদের আমানত। তিনিই অতন্দ্র প্রহরী।’’ মোশারফ এ-ও জানিয়েছেন, তিনি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আর্জি জানাবেন, যারা ধর্মের ভিত্তিতে রাজনীতি করতে চাইছে, তাদের নির্বাচন কমিশনের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার দাবি জানাক রাজ্য সরকার। এই মর্মে বিধানসভায় পাশ হোক প্রস্তাবও।

রাজ্য বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি দিলীপ ঘোষের পাল্টা বক্তব্য, ‘‘তৃণমূল মুসলিমদের নিয়ে কেবল রাজনীতি করেছে। বাংলায় যে পরিমাণ ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে, তা কাজে লাগালে গরিব মুসলিমদের লাভ হত। কিন্তু লাভ হয়েছে ধর্মীয় নেতা আর তৃণমূলের নেতাদের। গরিব মুসলিমেরা অবহেলিতই থেকে গিয়েছেন।’’ ওয়াকফ প্রসঙ্গে কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরীর বক্তব্য, ‘‘এক দিকে বিজেপি তাদের হিন্দুত্বের রাজনীতি করতে চাইছে। অন্য দিকে, তৃণমূল রাজ্যের ১ লক্ষ ৪৮ হাজার ২০০ নথিভুক্ত সম্পত্তিকে কার্যকরী ভাবে ব্যবহারই করেনি। বহু সম্পত্তি বেহাত হয়ে গিয়েছে।’’ সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের কথায়, ‘‘দেশের বহু মন্দির পরিচলানার জন্য নিজস্ব বোর্ড রয়েছে। তারাই সেই মন্দির পরিচালনা করে। তা হলে হঠাৎ ওয়াকফের জন্য এই রকম আইন কেন? উদ্দেশ্য স্পষ্ট। আজ ওয়াকফ করছে। কাল মাদ্রাসা করবে। আসলে ভীতি সঞ্চার করতে চায় বিজেপি। আর তৃণমূল বিজেপির গরম করে দেওয়া চাটুতে রুটি সেঁকতে চাইছে।’’

তবে অনেকের বক্তব্য, রামন্দির নির্মাণের পর বিজেপিকে নতুন ‘অস্ত্র’ আস্তিন থেকে বার করতেই হত। ওয়াকফ বিল, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি তারই প্রতিফলন। আবার অনেকের বক্তব্য, তা নয়। বিজেপির ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যেই এগুলি রয়েছে। যেমন ছিল জম্মু ও কাশ্মীর থেকে বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত বা তিন তালাক প্রথা বিলোপের আইন আনা। রাজনীতিতে সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বিজেপিও সেই সময় মেপেই ওয়াকফ বিল আইনে পরিণত করছে। কারণ, আগামী বছর বাংলার পাশাপাশি বিধানসভা ভোট রয়েছে কেরল এবং অসমেও। বাংলায় বিজেপি প্রধান বিরোধীদল। অসমে তারা শাসক। আর কেরলে শাসক সিপিএমের প্রধান বিরোধী কংগ্রেস হলেও গত কয়েকটি ভোটে সেখানেও বিজেপির বৃদ্ধি হচ্ছে। তিন রাজ্যেই ‘উল্লেখযোগ্য’ মাত্রায় সংখ্যালঘু ভোট রয়েছে। বহু আসনে যা নির্ণায়ক।

WAQF Amendment Bill

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}