জমি জটে কেন আটকে রয়েছে কেন্দ্রীয় প্রকল্প, প্রশ্ন তুলেছিলেন নরেন্দ্র মোদী। খোদ প্রধানমন্ত্রীর মুখের উপরেই পশ্চিমবঙ্গের স্বরাষ্ট্রসচিব মলয় দে বলে দিলেন, ‘‘সরি স্যার। এ ভাবে জমি অধিগ্রহণ করা রাজ্য সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। রাজ্যটার নাম পশ্চিমবঙ্গ। এখানে কৃষকদের সঙ্গে আলোচনা না করে সরকার জমি নেয় না।’
জবাব শুনে প্রধানমন্ত্রী থ! শুধু বিস্মিত নন, খানিকটা ক্ষুব্ধও বটে। কারণ এর আগে কোনও রাজ্যের সচিব এ ভাবে এক ঘর আমলার সামনে তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানাননি। ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ও।
অন্য দিকে, মলয়বাবুর পাশে দাঁড়াচ্ছে নবান্ন। রাজ্য সরকারের শীর্ষ মহলের বক্তব্য, স্বরাষ্ট্রসচিব কোনও অন্যায় করেননি। রাজ্যের নীতিগত অবস্থান প্রধানমন্ত্রীকে জানানোটা তাঁর কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।
গোটা বিষয়টি আসলে কী?
প্রতি মাসের শেষ সপ্তাহে সাউথ ব্লকের কোণার ঘরটি থেকে কর্মসূচি রূপায়ণ নিয়ে রাজ্য সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স করেন প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রের সংশ্লিষ্ট আমলারা। গত মাসে সেই বৈঠক হয়েছে ২৮ তারিখে।
সাধারণ ভাবে রাজ্যগুলির মুখ্যসচিবরাই এই বৈঠকে থাকেন। কিন্তু সে দিন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় ছুটি নিয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে স্বরাষ্ট্রসচিব বৈঠকে হাজির হন। এক-এক করে রাজ্যভিত্তিক আলোচনার পর আসে রেল প্রকল্প রূপায়ণের কর্মসূচি। রেল মন্ত্রকের অফিসাররা অভিযোগ করেন, পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য সরকার জমি অধিগ্রহণ নিয়ে অসহযোগিতা করায় বহু ঘোষিত প্রকল্প কার্যকর করা যাচ্ছে না। সে কথা শুনে প্রধানমন্ত্রী বলে ওঠেন, ‘‘কহাঁ হ্যায় পশ্চিমবঙ্গাল কে চিফ সেক্রেটারি?’’ মলয়বাবু জবাব দেন, ‘‘চিফ সেক্রেটারি আজ ক্যাজুয়াল লিভ মে হ্যায়। আই এম হোম সেক্রেটারি।’’ প্রধানমন্ত্রী তাঁকে নির্দেশ দেন, আগামী এক বছরের মধ্যে জমি অধিগ্রহণ করে রেলের সমস্ত প্রকল্প রূপায়িত করতে হবে।
সে কথা শুনেই ফোঁস করে ওঠেন মলয়বাবু। তিনি বলেন, ‘‘এ রাজ্যে ওটা হবে না স্যার। আমাদের রাজ্যে আলাপ-আলোচনা না করে জমি নেওয়া যায় না।’’ এর পর পশ্চিমবঙ্গের জমি পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেন তিনি। যার মোদ্দা বক্তব্য, ঊর্বর জমি গায়ের জোরে অধিগ্রহণ করা বর্তমান রাজ্য সরকারের নীতিবিরুদ্ধ।
বস্তুত, শুধু রেল নয়, জমি জটে আটকে রয়েছে কেন্দ্রের একাধিক প্রকল্প। কৃষকদের অনুমতি ছাড়া এক ছটাকও জমি নেওয়া হবে না, এই প্রতিশ্রুতি দিয়েই ২০১১ সালে ক্ষমতায় এসেছিল তৃণমূল। তার পর থেকে বিস্তর সমালোচনা সত্ত্বেও শিল্পের জন্য এক ছটাক জমিও অধিগ্রহণ করেনি সরকার। তাদের বক্তব্য, প্রয়োজন হলে জমি সরাসরি কিনে নিতে হবে চাষিদের কাছ থেকে। কেন্দ্রীয় প্রকল্পের জন্যও একই পথ অনুসরণ করার পক্ষপাতী তারা। বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার জন্যও বিএসএফ-কে এক সময় সরাসরি জমি কিনতে বলা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য পঞ্চায়েত জমি কিনে দেবে বলে রফা হয়েছে। কাটোয়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ার জন্যও সরাসরি জমি কিনেছে এনটিপিসি।
ইতিমধ্যে সিঙ্গুরে টাটাদের ন্যানো কারখানার জমি অধিগ্রহণকে অবৈধ ঘোষণা করে চাষিদের জমি ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। তার জেরে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে অধিগৃহীত জমি ফেরানোর দাবিতে আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়েছে। এই আবহে কোনও প্রকল্পের জন্যই তড়িঘড়ি জমি নেওয়া অসম্ভব বলেই মনে করছে নবান্ন। মলয়বাবু প্রধানমন্ত্রীকে জানান, এক বছর নয়, রেলের প্রকল্পের জন্য জমি নিতে তিন বছর সময় লাগবে।
নবান্ন সূত্র বলছে, যে ভিডিও কনফারেন্সে এই আলোচনা, তা নিয়েই ঘোর আপত্তি মুখ্যমন্ত্রীর। বেশ কয়েক বছর এই বৈঠক চালু হয়েছে। যার লক্ষ্য হল, সংশ্লিষ্ট রাজ্যের আধিকারিকদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করে কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলির পথের জট খোলা। কিন্তু মমতার বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রীর উচিত মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করা। কিন্তু তা না করে তিনি মুখ্যসচিবদের সঙ্গে কথা বলছেন, যা সমান্তরাল প্রশাসন চালানোর সমতুল। তৃণমূল সূত্র বলছে, কেন্দ্রের এই প্রবণতার বিরোধিতা যে তাঁরাই প্রথম করছেন এমনটা নয়। রাজীব গাঁধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন মুখ্যমন্ত্রীকে এড়িয়ে সরাসরি জেলাশাসকদের সঙ্গে কেন্দ্রের যোগাযোগ গড়ে তুলেছিলেন। তখন তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন জ্যোতি বসু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy