ফাইল চিত্র।
দশ বার সমনে ন’বার হাজিরা এড়িয়েও সিবিআইয়ের জালে জড়িয়ে গিয়েছেন অনুব্রত মণ্ডল। আটঘাট বেঁধে কেষ্টকে ‘কব্জা’ করার পরে এখন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাটির সূত্রে দাবি, গরু পাচারে কেষ্ট-যোগের আদালতগ্রাহ্য এত তথ্য-প্রমাণ তাদের নাগালে যে, কোর্টের কাঠগড়ায় অনুব্রতের দোষ প্রমাণ করা নিয়ে বিশেষ ভাবতে হচ্ছে না তাদের। বরং কোন ‘প্রভাবশালীদের আশীর্বাদে’ বোলপুরের সাধারণ মাছবিক্রেতা থেকে কেষ্টর এমন দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা ও ‘কারবারি’ হয়ে ওঠা, তা জানাকে মূল উদ্দেশ্য করেই বীরভূমে তৃণমূলের জেলা সভাপতিকে জিজ্ঞাসাবাদের পরিকল্পনা সাজাচ্ছে তারা। শুরু হয়েছে প্রশ্ন করাও।
সিবিআই সূত্রের দাবি, গরু ছাড়াও বালি, পাথর—অবৈধ পাচারের প্রায় সমস্ত কর্মকাণ্ডে বীরভূমের এই দাপুটে নেতার যোগের ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু এই কারবার শুধু বীরভূমে সীমাবদ্ধ নয়। তার জাল ছড়িয়ে রয়েছে রাজ্য জুড়ে। গত দু’দশকে রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়িয়ে অনুব্রত নিজেই প্রভাবশালী। কিন্তু তার থেকেও বেশি ‘প্রভাবশালী’ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ‘অদৃশ্য হাত’ মাথায় না থাকলে, এত দিন ধরে এত রকম এত টাকার বেআইনি কারবার চালিয়ে যাওয়া কী ভাবে সম্ভব, সেটিই ভাবাচ্ছে তদন্তকারীদের। সূত্রের খবর, কেষ্টর মুখ থেকে এ বিষয়ে ‘কথা বার করতে’ প্রশ্নবাণ সাজাচ্ছেন তাঁরা।
এক সিবিআই কর্তার কথায়, ‘‘অনুব্রতকে তাঁর নিজের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা কার্যত অযথা সময় নষ্ট। কারণ, সে বিষয়ে বহু প্রামাণ্য নথি সিবিআইয়ের হাতে রয়েছে। আদালতে তাঁর দোষ প্রমাণের জন্য তাই তথ্য না থাকার ঝুঁকি নেই।’’
সিবিআই সূত্রের বক্তব্য, অনুব্রতর গরু পাচারে জড়িত থাকার প্রচুর আদালতগ্রাহ্য তথ্য-প্রমাণ তাঁদের হাতে রয়েছে। যেমন, বীরভূমের বেশ কয়েক জন গরু ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগাযোগের ও অবৈধ কারবারের প্রমাণ। তাঁর বিশ্বস্ত দেহরক্ষী এবং দীর্ঘ সময়ের কার্যত ছায়াসঙ্গী সেহগাল হোসেনের আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পত্তি। অনুব্রত, তাঁর প্রয়াত স্ত্রী এবং কন্যার নামে আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন বিপুল সম্পত্তির হদিস। প্রমাণের আরও এমন অনেক তাস অস্তিনে আছে বলে সিবিআই সূত্রে দাবি।
কিন্তু একই সঙ্গে ওই পদস্থ কর্তার বক্তব্য, গরু-বালি-পাথরের বেআইনি পাচার শুধু বীরভূমে সীমাবদ্ধ ছিল না। জেলার সীমানা পেরিয়ে কারবারের টাকা আরও অনেক ‘প্রভাবশালীর’ কাছে পৌঁছেছে। অনুব্রতকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে ওই প্রভাবশালীদের যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করা হবে। সিবিআই সূত্রের বক্তব্য, ২০১৪ সালের পর থেকে অনুব্রত বীরভূমে একচ্ছত্র দলীয় ক্ষমতার অধিকারী। এক জন জেলা সভাপতি হয়েও গাড়িতে সরকারি নিয়ম ভেঙে ইচ্ছেমতো লালবাতি ব্যবহার করেছেন। জেলা স্তরে পুলিশ ও প্রশাসনের অফিসারদের ‘নিয়ন্ত্রণ’ করেছেন। মাথায় কোনও ‘অত্যন্ত প্রভাবশালীর অদৃশ্য হাত’ না থাকলে এই রমরমা এবং দাপট সম্ভব নয় বলেই ধারণা তদন্তকারীদের। সূত্রের খবর, গরু পাচারে মূল অভিযুক্ত এনামুল হক, বীরভূমের অন্যান্য ব্যবসায়ী এবং সেহগালের বয়ানের ভিত্তিতেও ওই ‘অদৃশ্য হাত’ সম্পর্কে নানা তথ্য ও ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, ওই তথ্যের ভিত্তিতে পাচার-চক্রের কোটি কোটি টাকা জেলাস্তরের নেতাদের কাছ থেকে হাতবদল হয়ে ‘উঁচু মহলে’ গিয়েছে বলে ইঙ্গিত মিলেছে। ‘প্রভাবশালীদের’ ঘরেও নাকি পৌঁছেছে মোটা লোভ্যাংশ। এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুক্রবার সকাল থেকেই ধীরে ধীরে শুরু করা হয়েছে বলে তদন্তকারী সংস্থাটির দাবি।
তদন্তকারীদের সূত্রে খবর, বৃহস্পতিবার সকালে নিজের গড়ে বাড়ি থেকে আটক হয়ে গ্রেফতারের পরে বীরভূমের দাপুটে নেতা কিছুটা মানসিক ভাবে ধাক্কা খেয়েছেন। শুক্রবার ভোররাত নাগাদ বেশ বিপর্যস্ত মনে হয়েছে তাঁকে।
তদন্তকারীদের বক্তব্য, বৃহস্পতিবার সকালে বোলপুরের নিচুপট্টির বাড়িতে ঘণ্টা খানেক প্রশ্নের পরে অনুব্রতকে আটক করা হয়। ঠিক হয় নিয়ে যাওয়া হবে বীরভূমের বাইরে। আইন বলে, আটক করার পরে অভিযুক্তের আইনজীবী অথবা পরিবার কিংবা নিকটাত্মীয়কে তা জানাতে হয়। এ ক্ষেত্রে নিজের মোবাইল থেকে আইনজীবীকে ফোন করে অনুব্রত প্রথমে বলেন, ‘‘ওরা (সিবিআই) সকালবেলায় বাড়িতে এসে আমাকে গ্রেফতার করল। তবে আমি ঘাবড়ে যাইনি। তোমরা আইনের বিষয়টি ঠিকঠাক দেখে নাও।’’
সূত্রের দাবি, তখনও কেষ্টর গলায় ঝাঁঝ বজায় ছিল। এর পরে অনুব্রতকে নিয়ে আসানসোল রওনা দেওয়া হয়। মাঝপথে দুপুর আড়াইটে নাগাদ পশ্চিম বর্ধমানে কুলটির শীতলপুরে ইসিএলের অতিথিশালায় পৌঁছয় সিবিআই। সেখানে ইসিএলের চিকিৎসকদের দিয়ে অনুব্রতের স্বাস্থ্যপরীক্ষা ও নথিপত্র তৈরির পরে বিকেল ৩টে ৪০ নাগাদ গ্রেফতার।
এক তদন্তকারী অফিসার বলেন, ‘‘গ্রেফতারের সময়ে কোন নিকট আত্মীয়কে খবর দিয়ে ‘অ্যারেস্ট মেমো’ তৈরি করতে হয়। অনুব্রত মেয়ে সুকন্যাকে ফোন করেন।’’ তাঁর দাবি, মেয়েকে অনুব্রত বলেন, ‘‘সবই তো শুনেছিস। টিভিতে দেখছিস। তবে আমি ঠিক আছি।’’ তখন চোখ ছলছল করছিল। এর পরে তাঁর দেহরক্ষী রাজ্য পুলিশের বীরভূম জেলার অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব ইন্সপেক্টর চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় গ্রেফতারের সাক্ষী হিসেবে সই করেন।
এর পরে রওনা দিয়ে সেই ভোররাতে কলকাতার নিজাম প্যালেস। সূত্রের দাবি, ধীরে ধীরে খানিকটা কাবু হয়ে পড়েন অনুব্রত। শুক্রবার সকাল ন’টায় ঘুম থেকে ওঠার পরে স্নান করে চা-টোস্ট খেয়ে তদন্তকারীদের মুখোমুখি তিনি।
সিবিআইয়ের এক কর্তার মন্তব্য, ‘‘প্রভাবশালীর অদৃশ্য হাতের বিষয়ে এমন কিছু তথ্য রয়েছে, যে তা নিয়ে প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া অনুব্রতর পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy