চাকরির পরীক্ষায় বসে সাদা খাতা জমা দিতে বলা হয়েছিল প্রার্থীদের। খাতায় একটি শব্দও না-লিখে তাঁরা পরীক্ষায় পাশ করেছেন। তার জন্য দিয়েছেন মোটা অঙ্কের ঘুষ! সিবিআইকে এমনটাই জানিয়েছেন চাকরিপ্রার্থী তথা এজেন্টরা। সম্প্রতি প্রাথমিকে নিয়োগ দুর্নীতির মামলায় তৃতীয় অতিরিক্ত চার্জশিট আদালতে জমা দিয়েছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। সেখানেই এমন চার জন এজেন্টের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া গিয়েছে মোট ১০টি ডায়েরি, যেখানে ঘুষের হিসাব বিশদ লেখা থাকত। এই টাকা অরুণ কুমার হাজরা ওরফে চিনু হাজরা এবং সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র ওরফে ‘কালীঘাটের কাকু’র কাছে পৌঁছে যেত বলে চার্জশিটে জানিয়েছে সিবিআই।
তদন্তকারীদের দাবি, শেখ আব্দুল সালাম, বকুল বিশ্বাস, রৌসন আলম ওরফে মিলন এবং তৃস্তান মান্নার কাছ থেকে ১০টি ডায়েরি পাওয়া গিয়েছে। এই চার জনই অরুণের এজেন্ট হিসাবে কাজ করেছেন। চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে তাঁরা টাকা তুলে অরুণের কাছে পৌঁছে দিতেন। সেখান থেকে টাকা যেত সুজয়কৃষ্ণের কাছে। এই টাকা তোলা এবং টাকা দেওয়ার হিসাব লেখা থাকত ডায়েরিগুলিতে। টাকার প্রাপ্তিস্বীকার করে নথিতে সই করে দিতেন অরুণই। কখনও সুজয়কৃষ্ণের বেহালার বাড়িতে, কখনও ‘বেহালা উত্তরসূরি’ নামের ক্লাবে, কখনও আবার ‘লিপ্স অ্যান্ড বাউন্ডস’-এর দফতরে টাকার লেনদেন চলত। সুজয়কৃষ্ণের পরিবর্তে কখনও কখনও ঘুষের টাকা নিতেন তাঁর কর্মচারী নিখিল হাতি।
আরও পড়ুন:
সিবিআই চার্জশিটে আরও জানিয়েছে, টাকা তোলার পরেও অধিকাংশ চাকরি নিশ্চিত করতে পারেননি অরুণ বা সুজয়কৃষ্ণ। তখন চাকরিপ্রার্থী এবং এজেন্টরা তাঁদের টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য চাপ দেন। সেই টাকা ফেরত দিতে ৩৭ কাঠার একটি জমিও সুজয়কৃষ্ণ বিক্রি করেছিলেন বলে জানতে পেরেছেন তদন্তকারীরা। সাড়ে তিন কোটি টাকায় ওই জমি কেনা হয়েছে সুজয়কৃষ্ণেরই আত্মীয় বা বন্ধুদের সংস্থার নামে। অরুণ এবং তাঁর এজেন্টদের মধ্যে এই লেনদেন সংক্রান্ত চুক্তি হয়েছিল। চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে মোট ৭৮ কোটি টাকা ঘুষ হিসাবে তোলার কথা উল্লেখ করা হয় সেই চুক্তিতে। পরে ঘুষের টাকা ফেরত দিয়ে দেওয়া হয়। চার এজেন্টের বয়ান নথিভুক্ত করেছে সিবিআই। টাকা তুলে দেওয়ার কথা তাঁরা স্বীকার করেছেন।
সাদা খাতা জমার নির্দেশ
পশ্চিম মেদিনীপুরের সালাম সিবিআইকে জানিয়েছেন, তিনি উচ্চ প্রাথমিকে চাকরির জন্য চেষ্টা করছিলেন। এক বন্ধুর মাধ্যমে অরুণের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়। অরুণ দাবি করেন, অজিত পাঁজা, গনি খান চৌধুরীর মতো প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যোগাযোগের সুবাদে তিনি রেল, পুরসভা-সহ বিভিন্ন সরকারি চাকরি পাইয়ে দিতে পারেন। বর্তমান রাজ্য সরকারের কোনও চাকরিই টাকা ছাড়া পাওয়া যায় না। কারণ, পার্টির তহবিলের জন্য টাকা তোলা প্রয়োজন। উচ্চ প্রাথমিকে চাকরির জন্য আট লক্ষ টাকা দাবি করা হয়েছিল বলে দাবি করেন সালাম। অগ্রিম হিসাবে দিতে বলা হয়েছিল চার লক্ষ টাকা। কিন্তু তাঁরা অগ্রিম দিতে রাজি হননি। পরে তাঁদের বলা হয়, অগ্রিম ছাড়াই লিখিত পরীক্ষায় পাশ করিয়ে দেওয়া হবে। ঘুষ দিতে হবে তার পরে। তাতে সালামরা রাজি হয়েছিলেন। তাঁদের সাদা ওএমআর শিট জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। সাদা খাতা দিয়েও এক জন বাদে প্রত্যেকে পরীক্ষায় পাশ করেন।
আরও পড়ুন:
প্রার্থী জোগাড় করে কমিশন
সাদা খাতা জমা দিয়ে পরীক্ষায় পাশ করার পর ওই প্রার্থীদের কাছ থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা করে নেওয়া হয়েছিল বলে সিবিআইকে জানিয়েছেন সালাম। ঘুষের বাকি টাকা এর পর দাবি করা হয়। কিন্তু তা দিতে পারেননি সালামেরা। এই সময়ে অরুণ কলেজ স্কোয়্যারের একটি হোটেলে সালামদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। বলেছিলেন, আরও প্রার্থী জোগাড় করে দিলে তাঁদের কাছ থেকে কমিশন বাবদ টাকা তুলতে পারবেন সালামরা। সেই টাকা দিয়ে ঘুষের বাকি অর্থ শোধ করে দেওয়া যাবে। অরুণের কথায় প্রাথমিক, উচ্চ প্রাথমিক ছাড়াও অন্য ক্ষেত্রের চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা তোলেন সালাম। অরুণ তাঁকে জানিয়েছিলেন, তাঁর ‘বস্’ সুজয়কৃষ্ণ। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘যুবরাজ’ বলে উল্লেখ করা হত এবং সেই ‘যুবরাজ’ সুজয়কৃষ্ণের কথা শুনতেন।
আদিগঙ্গায় মোবাইল বিসর্জন
সালাম জানিয়েছেন, নিয়োগ মামলায় সিবিআই এবং ইডির হাতে কুন্তল ঘোষ গ্রেফতার হওয়ার পর সুজয়কৃষ্ণ হোয়াট্সঅ্যাপে একাধিক বার তাঁকে ফোন করেছিলেন। ঘুষের টাকা লেনদেনের বিষয়ে যাবতীয় তথ্য মুছে ফেলতে অনুরোধ করেন তিনি। সুজয়কৃষ্ণ তাঁকে জানিয়েছিলেন, তিনি নিজের দু’টি মোবাইল কালীঘাটের আদিগঙ্গায় ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন। মুছে ফেলেছেন সমস্ত ইমেল। তাঁর অনুরোধে সালাম কিছু ছবি, ভিডিয়ো এবং অন্য নথি মুছে ফেলেন। ২০২৪ সালের অগস্ট মাসে অরুণও মোবাইল বন্ধ করে গা-ঢাকা দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন সালামকে।
না-চেনার ভান!
অরুণের অন্য এজেন্ট মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার বাসিন্দা বকুল সিবিআইকে জানিয়েছেন, তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে সালামের সঙ্গে একই ঘরে থাকতেন। তৃণমূল ছাত্রপরিষদের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে পরিচয় হয়েছিল অরুণের সঙ্গে। উচ্চ প্রাথমিকে পাঁচ লক্ষ টাকার বিনিময়ে চাকরি দেওয়ার কথা বলেছিলেন অরুণ। বকুলের দাবি, উচ্চ প্রাথমিকের ১০ জন প্রার্থী জোগাড় করে দিতে পারলে টাকা দিতে হবে না বলেও জানানো হয়েছিল তাঁকে। সেই অনুযায়ী তিনি অনেক প্রার্থী জোগাড় করেন এবং তাঁদের কাছ থেকে ঘুষের টাকা তোলেন। কিন্তু সেই প্রার্থীরা চাকরি পাননি। অরুণের সঙ্গে ২০১৮ সালে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলেন বকুল। কিন্তু যাঁদের কাছ থেকে টাকা তুলেছিলেন, তাঁরা সব সময় তাঁকে চাপে রাখতেন। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে অরুণের সঙ্গে সালাম এবং আরও কয়েক জন-সহ বকুল গিয়েছিলেন সুজয়কৃষ্ণের বাড়িতে টাকা ফেরত চাইতে। সেই সময়ে সুজয়কৃষ্ণ তাঁদের না-চেনার ভান করেন বলে অভিযোগ। জানিয়ে দেন, টাকা তিনি ফেরত দেবেন না।
প্রাথমিক দিয়ে উচ্চ প্রাথমিকের ঘাটতি পূরণ
নদিয়ার কালিগঞ্জের বাসিন্দা রৌসন আলম সিবিআইকে জানিয়েছেন, গ্রামের এক বন্ধুর মাধ্যমে বকুলের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। আট লক্ষ টাকার বিনিময়ে উচ্চ প্রাথমিকে চাকরি হবে বলে জানতে পেরেছিলেন তিনি। অগ্রিম হিসাবে দিতে বলা হয়েছিল এক লক্ষ টাকা। এ ভাবে গ্রামের অনেকের কাছ থেকে তিনি টাকা তোলেন। অরুণের হাতে তুলে দিয়েছিলেন প্রায় ৩০ কোটি টাকা। এই টাকা নেওয়ার জন্য তাঁদের গ্রামে গাড়ি পাঠাতেন অরুণ, জানিয়েছেন রৌসন। তিনি ঘুষের টাকার হিসাব ডায়েরিতে লিখে রাখতেন। সেখানে টাকার প্রাপ্তিস্বীকার করে সই করে দিতেন অরুণ। কিন্তু কোনও প্রার্থীই চাকরি পাননি। ফলে তাঁদের উপর থেকে বিশ্বাস সরে যেতে শুরু করে। অরুণ তখন রৌসনকে বলেছিলেন, উচ্চ প্রাথমিকের এই ঘাটতি মিটিয়ে দেওয়া হবে প্রাথমিকে নিয়োগের মাধ্যমে। ঘুষের টাকা ফেরত চাইতে নিউ আলিপুরে লিপ্স অ্যান্ড বাউন্ডসের দফতরে ১৮ থেকে ২০ বার গিয়েছিলেন রৌসন। সুজয়কৃষ্ণের কাছ থেকে তিনি ফেরত পেয়েছেন তিন থেকে চার কোটি টাকা। তা প্রার্থীদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সাদা খাতায় ১২৫ নম্বর!
দক্ষিণ ২৪ পরগনার সাগরের বাসিন্দা তৃস্তান সিবিআইকে জানিয়েছেন, কলেজের সূত্রে বকুলের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়েছিল। তাঁর মাধ্যমে অরুণের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তৃস্তান তাঁর স্ত্রীর জন্য উচ্চ প্রাথমিকে চাকরির চেষ্টা করছিলেন। অরুণ আট লক্ষ (অগ্রিম এক লক্ষ) টাকা চাইলে তা দিতে পারেননি। পরিবর্তে ১৫ জন চাকরিপ্রার্থী জোগাড় করে দেন। তাঁদের কাছ থেকে ঘুষের টাকাও তোলেন। অরুণের হাতে মোট ৯ কোটি টাকা তিনি তুলে দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। উচ্চ প্রাথমিকের পাশাপাশি প্রাথমিকে নিয়োগের জন্যও টাকা তুলেছিলেন তৃস্তান। তাঁর স্ত্রীকে পরীক্ষায় সাদা খাতা জমা দিতে বলা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও তিনি ১২৫ নম্বর পেয়েছিলেন। এর পর থেকেই অরুণের প্রতি ভরসা আরও দৃঢ় হয়েছিল, জানান তৃস্তান। তিনিও ডায়েরিতে ঘুষের হিসাব লিখে রাখতেন। তাতে সই করে দিতেন অরুণ।
নিয়োগ মামলায় সুজয়কৃষ্ণকে গ্রেফতার করেছিল সিবিআই। আপাতত অন্তর্বর্তী জামিন পেয়ে তিনি বেহালার বাড়িতেই রয়েছেন। প্রসঙ্গত, সিবিআইয়ের তৃতীয় অতিরিক্ত চার্জশিটে অভিষেকের নামোল্লেখের খবর প্রথম প্রকাশ করেছিল আনন্দবাজার ডট কম। তার পরেই অভিষেকের আইনজীবী সঞ্জয় বসু বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিলেন, সিবিআই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে তাঁর মক্কেলের ভাবমূর্তি নষ্ট করার মরিয়া চেষ্টা করছে। অভিষেক নিজেও নেতাজি ইন্ডোরে তৃণমূলের সাংগঠনিক সভা থেকে ওই বিষয়ে সিবিআইকে পাল্টা আক্রমণ করেছিলেন। ওই খবরের সূত্র ধরে তৃণমূলের সাংসদ বলেছিলেন, ‘‘চার্জশিটে দু’বার আমার নাম আছে। কিন্তু কোনও পরিচয় নেই। সিবিআই ভাববাচ্যে কথা বলছে কেন? এই অভিষেক কে?’’ তাঁর বিরুদ্ধে যে সমস্ত দাবি উঠে এসেছে, সেগুলি তদন্তসাপেক্ষ।