পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে একাধিক বার ‘লোভী’ বলে উল্লেখ করেছেন ‘কালীঘাটের কাকু’ ওরফে সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র। জানিয়েছেন, পার্থের সঙ্গে তাঁর আলাপ ১৯৮২ সাল থেকে। তাই পার্থকে তাঁর চেয়ে বেশি আর কেউ চেনেন না। ২০১৭ সালে তৃণমূল নেতা (অধুনা বহিষ্কৃত) কুন্তল ঘোষ, শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়দের সঙ্গে সুজয়কৃষ্ণের ৭২.৫৯ মিনিটের কথোপকথনের সিবিআইকৃত প্রতিলিপি হাতে পেয়েছে আনন্দবাজার ডট কম। সেখানেই পার্থের ‘লোভের’ ব্যাখ্যা রয়েছে। বেশ কিছু ঘটনার উল্লেখ করে এই লোভের উদাহরণ দিয়েছেন সুজয়কৃষ্ণ নিজেই।
কথোপকথন অনুযায়ী, কী ভাবে চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা তোলা হবে, সেই টাকা পার্থকে দিয়ে কী ভাবে তাঁর মুখ বন্ধ করাতে হবে, তা নিয়ে শান্তনু, কুন্তলদের সঙ্গে পরামর্শ করছিলেন সুজয়কৃষ্ণ। তখনই তিনি বলেন, ‘‘পার্থদা লোভী লোক। পার্থদাকে ২০ কোটি দেব বললে পার্থদা আর ও দিকে তাকাবে না। চোখে একদম ঠুলি লাগিয়ে দেবে। বলবে, চোখে অপারেশন করতে সিঙ্গাপুর চলে গেলাম।’’ পার্থের সঙ্গে আলাপের কথা বলতে গিয়ে সুজয়কৃষ্ণ জানান, ১৯৮২ সালে তিনি যখন প্রথম বার পার্থের বাড়িতে গিয়েছিলেন, তখন পার্থের চেয়ে তাঁর স্ত্রী বেশি ক্ষমতাশালী ছিলেন। সাধারণ একটি সংস্থায় কাজ করতেন পার্থ। তাঁর স্ত্রী ছিলেন ওই সংস্থার চেয়ারম্যানের সচিব। সুজয়কৃষ্ণের দাবি, তিনি বেহালায় একটি অফিস খুলে দিয়েছিলেন পার্থকে। একটি ফ্ল্যাট দিয়েছিলেন, সেটি ছিল একাধারে পার্থের দফতর এবং বিশ্রামস্থল।
আরও পড়ুন:
‘দুলটা দিসনি তো!’
পার্থের স্ত্রীর জন্য এক বার একটি হার কিনে পাঠিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন সুজয়কৃষ্ণ। কথোপকথন অনুযায়ী, হারটি পেয়ে নাকি পার্থ দুলের কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন। সুজয়কৃষ্ণের কথায়, ‘‘পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বৌকে এক বার একটা হার কিনে পাঠিয়েছি। বলছে, দুলটা দিসনি তো! পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে একটা গিনি দিয়েছি। বলছে, বেচা এসে ওটাকে নিয়ে নিয়েছে। আর একটা দিতে বল না! এই পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে আমার থেকে বেশি কে চিনবে পৃথিবীতে?’’
‘সর্বকালের শ্রেষ্ঠ আশ্চর্য’
কথোপকথনে ‘বেচা’র নাম এসেছে পরেও। সুজয়কৃষ্ণের দাবি, হুগলির এই ‘বেচা’ পার্থের কাছে প্রচুর ‘মাল’ পৌঁছে দিয়েছেন। শান্তনুকে তিনি বলেন, ‘‘তোমরা তো সিঙ্গুরের। তোমরা বেচাকে একদিন জিজ্ঞেস করে নিয়ো, আজ পর্যন্ত পার্থদার বাড়িতে কত মাল পৌঁছেছেন। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বয়স যদি ৬৫ বছর হয়, জন্ম থেকে আজ অবধি খেয়ে উঠতে পারবে না, এত মাল পাঠিয়েছে। আমার দেখা পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ আশ্চর্য ওই পার্থ চট্টোপাধ্যায়।’’
‘পার্থদাকে সামলে নেবে মানিক’
চাকরিপ্রার্থীদের বিষয়ে পার্থকে সামলে নেবেন মানিক ভট্টাচার্য। তাঁর সেই ক্ষমতা আছে। কুন্তল, শান্তনুদের সঙ্গে আলোচনার সময়ে এ কথা জানিয়েছিলেন সুজয়কৃষ্ণ। পার্থ যাতে টাকার বিষয়ে কোথাও মুখ না-খোলেন, অভিষেক যেন এ বিষয়ে কিছু না-জানতে পারেন, তা নিশ্চিত করার ভার মানিককেই দেওয়া হবে, ঠিক হয়েছিল ওই আলোচনায়। সুজয়কৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘‘মানিক ভট্টাচার্য পার্থদাকে সামলে নেবেন। মানিক ভট্টাচার্যের সেই ক্ষমতা আছে। উনি পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে ডিল করবেন। পার্থদা, গুরু ২০ কোটি দেব। মুখে কুলুপ আঁটো। কত হচ্ছে, অভিষেককে বলবে না। এ বার ২০০০-এর জায়গায় ২৫০০ করে বাকি ৫০০ মানিক ভট্টাচার্য নিয়ে নিক। আমি কি বোঝাতে পারলাম?’’
পোস্টিংয়েও ৫০ হাজার!
চাকরিতে পোস্টিংয়ের জন্যেও টাকা দিতে হয়েছে প্রার্থীদের। কুন্তল, শান্তনু, সুজয়কৃষ্ণের আলোচনায় বিষয়টি উঠে এসেছে। কুন্তল জানিয়েছেন, প্রত্যেক জেলার চেয়ারম্যান পোস্টিংয়ের জন্য ৫০ হাজার টাকা করে প্রার্থীদের থেকে নিয়েছেন। উত্তর দিনাজপুরের উদাহরণ দিয়ে কুন্তল বলেন, ‘‘ধরুন উত্তর দিনাজপুর। সেখানকার চেয়ারম্যান হচ্ছে গোলাম রব্বানির ভাগ্নে। প্রত্যেক প্রার্থীর কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা করে নিয়েছেন। ৩৮ জন প্রার্থী ধরুন।’’ অর্থাৎ, এই প্রার্থীদের কাছ থেকে ১৯ লক্ষ টাকা শুধু পোস্টিংয়ের জন্য তোলা হয়েছে, কথোপকথনের দাবি অনুযায়ী।
আদালতে মামলার মাধ্যমে চাকরি!
যে চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়েছে, তাঁদের চাকরি পাইয়ে দেওয়ার জন্য আদালতে মামলাও করা হয়। সেই পরিকল্পনা উঠে এসেছে কুন্তল, সুজয়কৃষ্ণদের কথোপকথনে। কুন্তল বলেছেন, ‘‘প্রথমে এদের দিয়ে একটা মামলা করানো হয়। আরটিআই করানো হয়। তার পর খাতা স্ক্রুটিনি হয়। স্ক্রুটিনি করে এরা নতুন করে পাশ করে। এর পর আদালতে মামলা করে যে, এরা প্রশিক্ষিত এবং যোগ্য। আর একটা যে তালিকা ছিল অপ্রশিক্ষিতদের, আরটিআই করে রিভিউ করে দেখা হয়েছে যে, এরা পাশ করেছে, কিন্তু নথির জন্য আটকে রেখেছে। সেটা যাচাই করে আদালত বলেছে, ক্লিয়ার করো। মে মাসে ভেরিফিকেশন হয়েছে। আদালতকে জানিয়েছে, এদের নথি ঠিকঠাক রয়েছে। তখন অগস্ট মাসে আদালত বলেছে, এরা যদি যোগ্য হয়, নিয়ে নাও। আমি এখনও বলছি, ওই ১৫২১ জনের প্রত্যেকটা নাম পিটিশনে ছিল।’’
উল্লেখ্য, প্রাথমিক মামলায় সুজয়কৃষ্ণ, কুন্তল, শান্তনুদের গ্রেফতার করেছিল সিবিআই। সুজয়কৃষ্ণ অন্তর্বর্তী জামিন পেয়ে আপাতত বেহালার বাড়িতেই রয়েছেন। জামিন পেয়ে গিয়েছেন কুন্তলও। শান্তনু এখনও জেল হেফাজতে। তিন জনের কণ্ঠস্বরের নমুনা সংগ্রহ করেছে সিবিআই। সেই নমুনা ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে দিল্লিতে। অডিয়োর সঙ্গে ওই কণ্ঠস্বরের নমুনা মিলিয়ে দেখবেন তদন্তকারীরা। অডিয়োতে যে দাবিগুলি করা হয়েছে, তা-ও তদন্তসাপেক্ষ।
প্রসঙ্গত, সিবিআইয়ের তৃতীয় অতিরিক্ত চার্জশিটে অভিষেকের নামোল্লেখের খবর প্রথম প্রকাশ করেছিল আনন্দবাজার ডট কম। তার পরেই অভিষেকের আইনজীবী সঞ্জয় বসু বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিলেন, সিবিআই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে তাঁর মক্কেলের ভাবমূর্তি নষ্ট করার মরিয়া চেষ্টা করছে। অভিষেক নিজেও নেতাজি ইন্ডোরে তৃণমূলের সাংগঠনিক সভা থেকে ওই বিষয়ে সিবিআইকে পাল্টা আক্রমণ করেছিলেন। ওই খবরের সূত্র ধরে তৃণমূলের সাংসদ বলেছিলেন, ‘‘চার্জশিটে দু’বার আমার নাম আছে। কিন্তু কোনও পরিচয় নেই। সিবিআই ভাববাচ্যে কথা বলছে কেন? এই অভিষেক কে?’’