কলকাতা হাই কোর্টে শুনানির পরে সাংবাদিক বৈঠকে আইনজীবীরা। ছবি: রণজিৎ নন্দী
শুনানি হল। কিন্তু চার নেতা-মন্ত্রীর জামিন কিংবা মামলা স্থানান্তর নিয়ে বুধবার রায় দিল না কলকাতা হাই কোর্টের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি রাজেশ বিন্দল এবং বিচারপতি অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চ। ফলে আরও অন্তত ২৪ ঘণ্টার জন্য ঝুলে রইল রাজ্যের দুই মন্ত্রী-সহ চার নেতার ভাগ্য।
বুধবার দুপুরে হাই কোর্টে প্রায় আড়াই ঘণ্টার আইনি লড়াই চলে দু’পক্ষের (সিবিআই বনাম অভিযুক্ত চার জন)। শুনানি শেষে আদালত জানায়, আজ, বৃহস্পতিবার বেলা দু’টোয় ফের মামলার শুনানি হবে। নারদ মামলার বিচার অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সিবিআই যে মামলা করেছে, তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে তাতে এ দিন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, আইনমন্ত্রী মলয় ঘটক এবং তৃণমূল সাংসদ-আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কেও যুক্ত করে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে।
আইনজীবী মহলের দাবি, চার নেতার গ্রেফতারের দিন মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে নিজাম প্যালেসে ছ’ঘণ্টা ঘাঁটি গেড়ে থেকেছেন, আইনমন্ত্রী যে ভাবে লোকজন সমেত সেখানে পৌঁছেছেন, তা বিক্ষোভে ইন্ধন জুগিয়েছে বলে সিবিআইয়ের অভিযোগ। তাই এঁদের মামলায় যুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি, এই তিন জনের বিরুদ্ধে নিম্ন আদালতের বিচারককে প্রভাবিত করতে চেষ্টারও অভিযোগ তুলেছে সিবিআই। কিন্তু নিম্ন আদালতে ভার্চুয়াল শুনানি হয়েছিল। তাতে বিচারককে কী ভাবে প্রভাবিত করা যায়, সে ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছেন অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবী অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি।
কল্যাণ প্রশ্ন তুলেছেন গ্রেফতারের ক্ষেত্রে রাজ্যপালের অনুমতি ও সিবিআইয়ের তাড়াহুড়ো নিয়ে। তিনি আদালতে জানান, ‘‘জানুয়ারিতে রাজ্যপালের কাছে অনুমতি চাওয়া হয়েছিল। এত দিন বকেয়া থাকার পরে আগের রাজ্য সরকারের মেয়াদ শেষে মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের পরে আচমকা রাজ্যপাল সেই অনুমতি দিলেন। কেন?’’
এ দিন শুনানির শুরুতেই সিবিআইয়ের পক্ষে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা দাবি করেন, ‘এমন বেনজির ঘটনা আগে ঘটেনি। সিবিআইকে অভিযুক্তদের চার্জ শোনাতে বাধা দেওয়া হয়েছে।’ বিচারপতি অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য বলেন, চার্জশিট জমা পড়েছে। অভিযুক্তেরা তদন্তে অসহযোগিতা করেছেন, এমন কথা শোনা যায়নি। তাহলে কোভিড পরিস্থিতিতে জেলবন্দি করে রাখার প্রয়োজন হবে কেন? সলিসিটর জেনারেলের পাল্টা যুক্তি, অভিযুক্তেরা প্রভাবশালী। তাঁরা বিচার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারেন। বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায় ও তুষারের কথোপকথনের মধ্যে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘‘ওদের (সিবিআই) যা বলার আছে তা আমরা আগে শুনি।”
সিঙ্ঘভি অবশ্য কিছুটা কটাক্ষের সুরে বলেন, বেনজির ঘটনাই ঘটেছে বটে। কারণ, সিবিআই যা করেছে, তা আগে দেখা যায়নি। অভিযুক্ত পক্ষকে না-জানিয়ে একতরফা শুনানি ও চার জন ধৃতকে ন্যায্য বিচার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে বলে জানান ওই প্রবীণ আইনজীবী। মনে করিয়ে দেন যে, অভিযুক্তকে না-জানিয়ে এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না-দিয়ে দেশের কোনও আদালত জামিন খারিজ করতে পারে না।
জামিনের শুনানির ক্ষেত্রেও সিবিআইয়ের কৌঁসুলি এ দিন বারবারই বিক্ষোভ ও নিম্ন আদালতকে প্রভাবিত করার দিকে সওয়াল নিয়ে গিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে নিজাম প্যালেসে মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতির কথা উত্থাপন করেন তিনি। অভিযোগ, আইনমন্ত্রী নিম্ন আদালতে উপস্থিত ছিলেন। যদিও কল্যাণ হাই কোর্টে জানিয়েছেন, আইনমন্ত্রী এজলাসে যাননি। বিক্ষোভ যে বিচার ব্যবস্থার পরিপন্থী নয়, তা-ও মনে করিয়ে দিয়েছেন সিঙ্ঘভি। তিনি জানান, শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ গাঁধীবাদের অনুসারী। আদালতে বিচার্য মামলা নিয়ে গণতান্ত্রিক বিক্ষোভে বাধা নেই। ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি নিজাম প্যালেসে পাথর ছোড়ার প্রসঙ্গ উত্থাপন করলে, সিঙ্ঘভি জবাব দেন, মন্ত্রী নিজে সমর্থকদের সংযত করেছেন। এ ব্যাপারে তিনি ভিডিয়ো ফুটেজ দেখাতেও সক্ষম বলে আদালতকে জানান তিনি।
এই পরিস্থিতিতে বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, তিনি ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির সঙ্গে একান্তে কিছুক্ষণ আলোচনা করতে চান। আদালতে সাময়িক বিরতি ঘোষণা করে দুই বিচারপতি উঠে যান। আলোচনা সেরে পাঁচ মিনিট পরে ফের এজলাসে বসেন তাঁরা।
এ দিন আদালতে অভিযুক্তদের পক্ষের অন্যতম আইনজীবী মণিশঙ্কর চট্টোপাধ্যায় জানান, সিবিআই বারবার জামিনের মূল বিরোধিতা থেকে সরে যাচ্ছে। কারণ, চার্জশিট পেশের পরে জামিনের বিরোধিতার জন্য জোরালো যুক্তি তাদের নেই। কোভিড পরিস্থিতিতে কেন চার নেতাকে আটকে রাখা হবে, সেই প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। বলেছেন, মদন মিত্র ও শোভন চট্টোপাধ্যায় তো মন্ত্রী নয়। তাঁদের ক্ষেত্রে প্রভাবশালী তত্ত্ব খাটে না।
অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবী সিদ্ধার্থ লুথরা জানান, তদন্ত শেষ হয়ে যাওয়ার পরে গ্রেফতার করে জেলবন্দি করার প্রয়োজন কী? সিঙ্ঘভি জানান, তিন জন অভিযুক্ত ইতিমধ্যেই হাসপাতালে ভর্তি। আদালত যেন তাঁদের জামিন দেয়। শোভন চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে কোভিড সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে বলেও জানান সিদ্ধার্থ। প্রসঙ্গত, মদন মিত্র সম্প্রতি কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
তবে শেষমেশ অবশ্য জামিনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়নি আদালত। আজ, বৃহস্পতিবার ফের আইনি লড়াই হতে পারে। তবে আইনজীবী মহলের ধারণা, ধৃতদের শর্তসাপেক্ষে জামিন দিলেও বিচারের স্থান বদলের লড়াই চলবে। আইনজীবীদের একাংশের মতে, শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিক্ষোভ হয়েছে বলে বা প্রভাবশালী তত্ত্ব দিয়ে বিচারের স্থান বদলের আর্জি গ্রহণযোগ্য নয়। সে ক্ষেত্রে আরও জোরালো যুক্তির প্রয়োজন হতে পারে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাটির।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy