সোমবারের নির্দেশের ফলে গত ১০ মাসে মোট ১২টি মামলার তদন্তের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে দিল আদালত। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মের মামলায় সোমবার সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাই কোর্ট। হিসাব বলছে, সোমবারের নির্দেশের ফলে গত ১০ মাসে মোট ১২টি মামলার তদন্তের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে দিল আদালত।
২০২১ সালের ২ মে রাজ্যে তৃতীয় বার ক্ষমতায় এসেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল সরকার। তার পর থেকেই বিরোধীরা রাজ্যে ভোট পরবর্তী খুন, ধর্ষণ, অত্যাচারের অভিযোগ তুলতে শুরু করে। একের পর এক মামলা হয় আদালতে। শেষে ১৯ অগস্ট সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয় কলকাতা হাই কোর্ট।
এর পরে ২২ নভেম্বর। গ্রুপ ডি নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সিঙ্গল বেঞ্চ সিবিআই অনুসন্ধানের নির্দেশ দেয়। যদিও পরে সেই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে ডিভিশন বেঞ্চে যায় স্কুল সার্ভিস কমিশন। সেখানে সিবিআই অনুসন্ধানের নির্দেশ খারিজ হয়ে গেলেও কমিটি গঠন করে তদন্তের কথা বলে আদালত। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি রঞ্জিতকুমার বাগের নেতৃত্বে কমিটি গড়ে তদন্ত শুরু হয়। পরে ডিভিশন বেঞ্চ একক বেঞ্চের রায়ই বহাল রাখে।
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের একক বেঞ্চ পরে আরও একটি মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয়। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি এসএসসি-র গ্রুপ সি পদে নিয়ম ভেঙে নিয়োগের মামলায়। তার আগে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে ‘ভুয়ো’ ৩৫০ জন কর্মীর বেতন বন্ধেরও নির্দেশ দেয় ওই একক বেঞ্চ। ১৮ ফেব্রুয়ারি এই মামলায় সিবিআই তদন্ত নিয়ে স্থগিতাদেশ দেয় ডিভিশন বেঞ্চ। শেষে অবশ্য একক বেঞ্চের রায়ই বহাল থাকে।
ফেব্রুয়ারি মাসে আরও একটি মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয় আদালত। হলদিয়া বন্দরে লরি থেকে তোলাবাজির অভিযোগের মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয় ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখ। নির্দেশের বিরোধিতা করে সুপ্রিম কোর্টে যায় রাজ্য। আবেদন ছিল, সিবিআইয়ের বদলে পুলিশকেই তদন্তের ভার দেওয়া হোক। কিন্তু ১৪ মার্চ সেই আর্জি নাকচ করে দেয় সর্বোচ্চ আদালত।
শিক্ষাক্ষেত্রে আরও একটি মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয় ২৮ ফেব্রুয়ারি। ২০১৬ সালে নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয় কলকাতা হাই কোর্ট।
ফেব্রুয়ারিতে তিনটির পরে মার্চ ও এপ্রিল মাসে একটি করে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে আদালত।রামপুরহাটের বগটুই-কাণ্ড নিয়ে প্রথম থেকেই সব বিরোধী দল সিবিআই তদন্তের দাবি তুলেছিল। অন্য দিকে, রাজ্য পুলিশের উপরে ভরসা রেখেই সিট গঠন করে নবান্ন। তদন্তও শুরু হয়। কিন্তু ততক্ষণে একাধিক মামলা চলে গিয়েছে আদালতে। ২৫ মার্চ আদালত সিবিআইকে তদন্ত শুরু করতে বলে। সেই তদন্ত শুরু হতে না হতেই রাজ্যে আরও একটি তদন্ত হাতে পেল কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা।
গত ১৩ মার্চ বিকেলে পুরুলিয়ার ঝালদায় খুন হন তপন কান্দু। কংগ্রেসের ওই পুর-কাউন্সিলর খুনের পর থেকেই বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরের সঙ্গে তপনের পরিবারও সিবিআই তদন্তের দাবি তোলে। পুলিশ তপনের ভাইপো দীপক কান্দুকে গ্রেফতার করে। এর পরে রাজ্য সরকার সিট গঠন করলে ওই হত্যায় জড়িত অভিযোগে, তপনের দাদা নরেন কান্দু ছাড়াও আশিক খান ও কলেবর সিংহ নামে দুই ব্যক্তিকে গ্রেফতার হয়। কিন্তু তপনের পরিবারের অভিযোগ ছিল, খুনের ঘটনায় ঝালদা থানার তৎকালীন আইসি সঞ্জীব ঘোষও জড়িত। রবিবারই সঞ্জীবকে ক্লিনচিট দেয় পুরুলিয়া পুলিশ। আর সোমবার তদন্ত চলে গেল সিবিআইয়ের হাতে।
এর পর ১৩ মে নদিয়ার হাঁসখালি ধর্ষণ মামলার তদন্তও কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই-র হাতে দেওয়ার নির্দেশ দেয় কলকাতা হাই কোর্ট।
এর পরে ১৯ মে কলকাতা হাই কোর্ট দু’টি তদন্তের ভার দেয় সিবিআইকে। তার একটি কলকাতা পুরসভার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগকে কেন্দ্র করে। ২০১৮ সালে হেরিটেজ ত্রিপুরা ভবনের একাংশে বেআইনি নির্মাণের অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলায় বিচারপতি অমৃতা সিন্হা এই নির্দেশ দেন। ঘটনাচক্রে, এই সেই সময় কলকাতা পুরসভার মেয়র ছিলেন শোভন চট্টোপাধ্যায়। তবে এই মামলাটি এখনও ডিভিশন বেঞ্চে বিচারাধীন।
একই দিনে মালদহের কালিয়াচকে জোর করে ধর্মান্তরণের অভিযোগ সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেন বিচারপতি রাজাশেখর মান্থা। সিবিআইয়ের পাশাপাশি পাশাপাশি ওই ঘটনায় তদন্তভার জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)-এর হাতেও তুলে দেওয়া হয়েছে।
৯ জুন বালির তৃণমূল নেতা তপন দত্ত খুনের ঘটনায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয় কলকাতা হাই কোর্ট। বিচারপতি রাজাশেখর মান্থার বেঞ্চ জানায়, ২০১১ সালের ওই খুনের ঘটনার তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সব দায়িত্বই সিবিআই পালন করবে। প্রসঙ্গত, আগে এই মামলার তদন্ত করে সিআইডি। তৃণমূলের স্থানীয় নেতা কর্মী-সহ ১৩ জনের নাম জড়ায়। এই মামলা নিম্ন আদালত, কলকাতা হাই কোর্ট এমনকি, সুপ্রিম কোর্টেও উঠেছে। কিন্তু এখনও সুবিচার পাননি বলে অভিযোগ করেন নিহত জলাজমি ভরাট বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত তপন দত্তের স্ত্রী প্রতিমা দত্ত।
সব শেষে সোমবারের নির্দেশ। ২০১৪ সালে প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। সেই মতো টেটের পরীক্ষা হয় ২০১৫ সালের ১১ অক্টোবর। ফলপ্রকাশ হয় ২০১৬-র সেপ্টেম্বরে। ওই বছরই প্রথম মেধাতালিকা প্রকাশ করে প্রাথমিক শিক্ষা সংসদ। পরের বছর অর্থাৎ, ২০১৭ সালের ৪ ডিসেম্বর দ্বিতীয় বা অতিরিক্ত মেধাতালিকা প্রকাশ করা হয়। এই নিয়োগে প্রায় ২৩ লক্ষ চাকরিপ্রার্থী পরীক্ষা দিয়েছিলেন। তার মধ্যে ৪২ হাজার প্রার্থীকে শিক্ষকে হিসাবে নিয়োগপত্র দেওয়া হয়। বেআইনি ভাবে দ্বিতীয় প্যানেল প্রকাশের অভিযোগ তুলে হাই কোর্টে মামলা দায়ের করেন রমেশ আলি নামে এক ব্যক্তি। তারই প্রেক্ষিতে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। যদিও ৮ জুন এই দুর্নীতির অভিযোগে চন্দন মণ্ডল নামে এক ব্যক্তিকে জেরা করার জন্য সিবিআইকেই দায়িত্ব দেয় উচ্চ আদালত।
ছোট আঙারিয়া থেকে নন্দীগ্রাম, রাজ্যে অনেক হত্যাকাণ্ডের তদন্তের দায়িত্ব নিয়েছে সিবিআই। বাম আমলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পদক চুরির তদন্তভারও গিয়েছিল কেন্দ্রীয় ওই তদন্তকারী সংস্থার হাতে। আবার তৃণমূলের শাসনকালেও সারদা থেকে নারদ-কাণ্ডের তদন্তে নেমেছে সিবিআই। কিন্তু সাম্প্রতিককালে খুব কম সময়ের মধ্যে ১২টি তদন্তভার গিয়েছে সিবিআইয়ের হাতে।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy