স্কুল সার্ভিসে ব্যাপক দুর্নীতি, বলছে ক্যাগের রিপোর্ট।
রাজ্য স্কুল সার্ভিস কমিশনের সহকারী শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক এবং অশিক্ষক কর্মচারী নিয়োগে চরম অস্বচ্ছতা হয়েছে বলে রিপোর্ট দাখিল করেছে কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল অব ইন্ডিয়া (সিএজি)। তাদের রিপোর্টে বলা হয়েছে, স্কুল সার্ভিস কমিশনের অনলাইন সিস্টেম নিরীক্ষা করে পরীক্ষার্থীদের নম্বর বাড়ানো-কমানো, যোগ্য প্রার্থীদের নাম তালিকা থেকে বাদ দিয়ে অযোগ্যদের নাম ঢোকানো, পরীক্ষা না-দিলেও নিয়োগপত্র দেওয়ার ভূরি ভূরি প্রমাণ মিলেছে।
এই দুর্নীতি নজরে আসার পরেই ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে রাজ্য সরকারকে তদন্ত করতে বলেছিল সিএজি। কিন্তু তা হয়নি। এমনকি ২০১৮ সালের গোড়ায় সিএজি তার রিপোর্ট নবান্নে পাঠিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও বিধানসভার সদ্যসমাপ্ত অধিবেশনের শেষ দিনে তা পেশ করা হয়েছে। সেই রিপোর্টে কমিশনের অজস্র অনিয়মের উল্লেখ করে সিএজি লিখেছে, সরকার এসএসসির বেআইনি কাজে নজর না দেওয়ায় হাজার হাজার পরীক্ষার্থী স্বচ্ছ ভাবে চাকরি পেতে ব্যর্থ হয়েছেন।
২০০৯ থেকে ইন্টিগ্রেটেড অনলাইন এগজামিনেশন সিস্টেমের মাধ্যমে পরীক্ষা নেওয়া শুরু করে এসএসসি। ২০১৭-এর জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত এই সিস্টেমের উপর নিরীক্ষা চালিয়েছে সিএজি। তখন পর্যন্ত এসএসসি ১২টি পরীক্ষা নিয়েছিল। ১০টির ফল প্রকাশ করে নিয়োগও হয়ে গিয়েছিল। এর মধ্যে একটি পরীক্ষার সব নথি কমিশন দিতে না-পারায় সেটিকে নিরীক্ষার আওতায় আনেনি সিএজি। কিন্তু বাকি ১১টি পরীক্ষার নথি খতিয়ে দেখেই অনিয়ম ধরা পড়েছে।
সিএজি তার রিপোর্টে লিখেছে, দ্বাদশতম পরীক্ষার পরে এসএসসি সমস্ত নথি ফলপ্রকাশের ছ’মাসের মধ্যে নষ্ট করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগে যা তিন বছর ছিল। এমন সিদ্ধান্ত কোনও ভাবেই স্বচ্ছতার স্বার্থে নয়। তা ছাড়া, পরীক্ষার বিভিন্ন স্তরে এসএসসির পাঁচটি আঞ্চলিক অফিস থেকে ওএমআর শিট-সহ সমস্ত নথি কেন্দ্রীয় অফিসে বার বার ব্যক্তি বিশেষকে দিয়ে পাঠানো হয়েছে। সিএজি লিখেছে, অনলাইন সিস্টেমস তৈরি হয়ে যাওয়ার পর ‘ম্যানুয়াল ইনটারভেনশন’ অনিয়ম। মাঝপথে নথি বা ওএমআর শিটে যে বদল করা হয়নি, এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই।
সিএজির দাবি, প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার যে নম্বর চূড়ান্ত তালিকায় প্রকাশিত হয়েছে, তার সঙ্গে সিস্টেমে লিখে রাখা নম্বর মেলেনি। ৭২৪৭ জন পরীক্ষার্থীর প্যানেলের নমুনা অডিটে ৫ জন এমন প্রার্থীর হদিশ মিলেছে, যাঁরা লিখিত পরীক্ষায় ০.৫ থেকে ৫.৫ নম্বর পেয়েও চূড়ান্ত প্যানেলে ঠাঁই পেয়েছেন। এঁদের এক জন শেষ পর্যন্ত চাকরিও পেয়েছেন। মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা যেখানে ১৮-২০ লক্ষ, সেখানে সব মিলিয়ে কত পরীক্ষার্থীর ক্ষেত্রে এমন নম্বর অদলবদল হয়েছে, তা সহজেই অনুমেয়। সিএজি লিখেছে, সিস্টেম, চূড়ান্ত প্যানেল এবং অডিটের নম্বর আলাদা আলাদা থাকাতেই প্রমাণিত হয়েছে, বার বার অনলাইন সিস্টেমে ঢুকে তা বদল করা হয়েছে।
সিএজি রিপোর্টে বলা হয়েছে, এসএসসির অনলাইন সিস্টেমে দশম সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় শিক্ষাগত যোগ্যতার জন্য প্রাপ্ত নম্বর অনেক ক্ষেত্রেই কমিয়ে-বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। উত্তরবঙ্গের ১০২০৫৯ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১১০২১ জনকে এ বাবদ দেওয়া নম্বরের ক্ষেত্রে গরমিল ধরা পড়েছে সিএজির অডিটে। ৬৫৬১ জনের নম্বর বাড়ানো ছিল, ৪৪৬০ জনের নম্বর কমানো ছিল। আবার একাদশতম সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় এমন ২২৬৪ প্রার্থীর খোঁজ মিলেছে, যাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতার নম্বর ১ থেকে ২৪ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। শুধু তাই নয়, একাদশতম পরীক্ষায় ৭ জন সহকারী শিক্ষকের ‘কাস্ট’ পর্যন্ত চূড়ান্ত প্যানেলে পরিবর্তন করা হয়েছে বলে নমুনা পরীক্ষায় জেনেছে সিএজি।
রিপোর্ট প্রকাশের আগে সিএজি সাধারণত কোনও সুপারিশ করে না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রথা ভেঙে রাজ্যকে সতর্ক করা হয়েছিল। সংস্থার এক কর্তার কথায়, ‘‘এসএসসি’র সঙ্গে লাখ লাখ পরীক্ষার্থীর ভাগ্য জড়িয়ে। তাই সরকারকে সতর্ক করা হয়েছিল। কিন্তু সরকার কিছুই করেনি।’’
শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ প্রসঙ্গে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘স্কুল সার্ভিস কমিশন একটি স্বশাসিত সংস্থা। তাদের বিষয়ে আমি সরাসরি কোনও মন্তব্য করতে পারি না। তা ছাড়া, সিএজি কী রিপোর্ট দিয়েছে, সে ব্যাপারেও আমি অবহিত নই। ফলে কিছু বলব না। আর স্কুল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান সৌমিত্র সরকারের বক্তব্য, ‘‘আমি গত ১ জানুয়ারি দায়িত্ব নিয়েছি। আমার আমলে এ সব কিছু হয়নি। আগে কে কী করেছে, কী হয়েছে সে ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করব না।’’
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy