শেষ পর্যন্ত জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত সব চেয়ে কঠোর আইন ইউএপিএ-তেই বর্ধমানের খাগড়াগড় বিস্ফোরণ কাণ্ডে ধৃতদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করল সিআইডি। এমনকী রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগও আনা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। তবে সাংবিধানিক ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও আগ বাড়িয়ে তদন্তভার কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির হাতে তুলে নিতে চাইছে না কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। মন্ত্রকের কর্তারা মনে করছেন, এর ফলে রাজ্য এক দিকে যেমন হাত ঝেড়ে ফেলার সুযোগ পাবে, তেমনই চক্রান্তের অভিযোগ তুলে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করতে পারে রাজ্যের শাসক দল। এ জন্য বিস্ফোরণ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। সেই রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পরই সিদ্ধান্ত নিতে চায় কেন্দ্র। রাজ্য তদন্তে সহযোগিতা করছে না বলে ইতিমধ্যেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে নালিশ করেছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা।
বুধবার খাগড়াগড় কাণ্ডে ধৃত চার জনের বিরুদ্ধে ইউএপিএ (আনলফুল অ্যাক্টিভিটিজ প্রিভেনশন অ্যাক্ট)-তে মামলা রুজু করল সিআইডি। এ দিন বিকেলে এ কথা জানিয়েছেন সিআইডি-র ডিআইজি (অপারেশন) দিলীপ আদক। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত নিতে কেন এত দেরি হল? সিআইডি কর্তা বলেন, “দেশ-বিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার পর্যাপ্ত প্রমাণ এবং তথ্য মেলার পরেই ওই চার জনের বিরুদ্ধে ইউএপি আইনে মামলা করা হয়েছে।” তবে এই সিদ্ধান্তের পেছনে রাজনৈতিক চাপ রয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। বর্ধমান থানার পুলিশ প্রথমে বিষয়টি মামুলি বিস্ফোরণের ঘটনা বলে চালাতে চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের জঙ্গিদের সংস্রবের বিষয়টিও প্রকাশ্যে চলে এসেছে। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দাবি, যে কোনও কারণেই হোক কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির তদন্ত এড়িয়ে চলতে চায় রাজ্য। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি রাজ্য পুলিশের যোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে। এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ এড়াতে তদন্ত যে ঠিক পথে চলছে, তা দেখানোর দায় বর্তায় সিআইডি-র উপরে। সেই জন্য দেরিতে হলেও শেষ পর্যন্ত তারা ইউএপিএ-র পথে হাঁটল বলে মনে করা হচ্ছে। সিআইডি সূত্রের খবর, ইউএপিএ আইনের ১৬ (জঙ্গি কার্যকলাপে যুক্ত), ১৮ (ষড়যন্ত্র), ১৮এ (জঙ্গি প্রশিক্ষণ শিবির সংগঠিত করা), ১৯ (জঙ্গি পরিচয় জানা সত্ত্বেও তাকে আশ্রয় দেওয়া) এবং ২০ (কোনও জঙ্গি সংগঠনের সদস্য) ধারায় ধৃত চার জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে সিআইডি। একই সঙ্গে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২১এ, ১২২ এবং ১২৩ (দেশ-বিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকা) ধারায় মামলা করা হয়েছে ওই চার জনের বিরুদ্ধে।
এ দিকে খাগড়াগড় বিস্ফোরণ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে বিশদে জানতে চেয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব অনিল গোস্বামী। এই ঘটনা নিয়ে ইতিমধ্যেই জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের সঙ্গে বৈঠক করেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব ও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা প্রধান। রাজ্যকে সীমানায় নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। মন্ত্রকের এক কর্তা বলেন, “বিস্ফোরণের পর জঙ্গিরা গা-ঢাকা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের পরিবর্তে ওড়িশা, বিহার বা ঝাড়খণ্ডকে বেছে নিতে চাইবে। তাই এই পরামর্শ।” যদিও গোয়েন্দা সূত্রের খবর, ঘটনার পর বেশ কিছু সন্দেহভাজন ইতিমধ্যেই পলাতক। রাজ্য পুলিশ তাদের খোঁজ পেতে ব্যর্থ। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারাও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে নালিশ করেছে, রাজ্য পুলিশ তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করছে না। এমনকী তদন্তের প্রশ্নে রাজ্য পুলিশের ভূমিকাও সন্তোষজনক নয়। কারণ জঙ্গি ডেরার তদন্তের অভিজ্ঞতা বা পরিকাঠামো তাদের নেই।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ওই কর্তা জানান, রাজ্য সরকার না-চাইলেও বর্ধমানের ঘটনা নিয়ে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)-র সরাসরি তদন্তে নামতে সাংবিধানিক ভাবে কোনও বাধা নেই। সিবিআই তদন্তের ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের সুপারিশ, হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অথবা বিধানসভার সর্বদলীয় প্রস্তাব প্রয়োজন হলেও এ ক্ষেত্রে সে সব বিধি নিষেধ নেই। তাঁর ব্যাখ্যা, আইন-শৃঙ্খলা রাজ্যের এক্তিয়ারে পড়লেও সন্ত্রাস একটি গুরুতর জাতীয় সমস্যা। তাই এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় তদন্তে কেউই বাধা দিতে পারে না। তবে ওই কর্তা জানিয়েছেন, এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। গত কালই রাজ্য পুলিশের ডিজি জিএমপি রেড্ডি জানিয়েছেন, “কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট পাঠাচ্ছে রাজ্য।” মন্ত্রক সূত্রে জানানো হয়েছে, ওই রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে কেন্দ্র।
নাশকতামূলক কাজকর্মে মমতা সরকারের ভূমিকা নিয়েও কিছু গুরুতর প্রশ্ন তুলছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। এক গত তিন বছরে বর্ধমানে এতগুলি জঙ্গি ডেরা তৈরি হওয়া সত্ত্বেও রাজ্য কেন কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। দুই জামাতের মতো মৌলবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে তৃণমূল কেন ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলবে? শুধুই ভোটেরস্বার্থে, না-কি আর কোনও বৃহত্তর স্বার্থ রয়েছে এর পিছনে? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তারা জানিয়েছেন, এই বিষয়গুলি নিয়েও আলাদা তদন্ত শুরু করেছে কেন্দ্র।
যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা বিঘ্নিত হবে, এই যুক্তিতে তদন্তের দায়িত্ব কেন্দ্রের হাতে তুলে দিতে চাইছেন না মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু কেন্দ্রের বক্তব্য, বিষয়টির সঙ্গে যেহেতু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরের জঙ্গি কার্যকলাপের যোগ রয়েছে। তাই রাজ্যেরই উচিত তদন্তভার কেন্দ্রের হাতে তুলে দেওয়া। আপাতত আগ বাড়িয়ে তদন্তে নামতে চাইছে না স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। কিন্তু রাজ্য প্রাণপণে কেন্দ্রীয় তদন্তে বাধা দেওয়ায় তারা কিছুটা বিস্মিত। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বলছে, কী লুকোনোর চেষ্টা করছে মমতা সরকার, তার খোঁজখবর ইতিমধ্যেই শুরু করেছে কেন্দ্র।
সহ প্রতিবেদন: অত্রি মিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy