সত্যদেবকে মিষ্টির প্যাকেট দিচ্ছেন এসডিপিও অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশে আদ্রা থানার ওসি।— নিজস্ব চিত্র
স্কুলের সামনে জলের ট্যাঙ্ক আর রেলস্টেশন। সূত্র ছিল এটুকুই। সহায় হল ইন্টারনেট। সার্চ ইঞ্জিনে লাগাতার খুঁজে সাত বছর আগে হারিয়ে যাওয়া সত্যদেবকে তার পরিবারে ফিরিয়ে দিলেন মহারাষ্ট্রের ঠানে জেলার এক সরকারি হোমের সুপার।
সোমবার ছেলেকে ঠানের ওই হোম থেকে বাড়ি নিয়ে এসেছেন পুরুলিয়ার রেলশহর আদ্রার বাসিন্দা ধনঞ্জয় বাহাদুর। ঠিক এ ভাবেই মধ্যপ্রদেশের ছোট্ট মেয়ে নিকিতার বাড়ির সন্ধান পেয়েছিল বাঁকুড়া চাইল্ড লাইন। ২০১২ সালে হারিয়ে যাওয়া সেই মেয়েটি বলেছিল, গ্রামের নাম মান্ডিদীপ। তার পাশে একটা নদী আছে। সেই সূত্র ধরে দু’বছর আগে নিকিতার পরিবারের হদিস মেলে।
সত্যদেবের ক্ষেত্রে সময়টা বেশি লেগেছে। ২০০৯ সালে বাবার কিছু টাকা বন্ধুদের সঙ্গে দোকানে গিয়ে খরচ করে ফেলেছিল ছ’বছরের সত্যদেব। তখন সে আদ্রার মিক্সড প্রাইমারি স্কুলের প্রথম শ্রেণির ছাত্র। বাবা বকাবকি করবে, এই ভয়ে পালিয়েছিল ছাইগাদার বস্তির বাড়ি থেকে। স্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে পৌঁছে গিয়েছিল ঠানে জেলার উল্লাসনগর স্টেশনে। তার পর থেকেই ঠিকানা সরকারি হোম। বাড়ির ঠিকানা হিসেবে আদ্রার নাম বললেও সেই হোমের কর্মকর্তারা অন্ধ্র শুনেছিলেন। ফলে সত্যদেবের ঠিকানা হোমের নথিতে অন্ধ্রপ্রদেশ লেখা হয়েছিল। আসল বাড়ি খুঁজে তাকে ফেরানোর উদ্যোগটা হয়নি।
অন্য রকম ভেবেছিলেন উল্লাসনগরেরই গভর্নমেন্ট চিলড্রেন হোম ফর বয়েজের (সিনিয়র) সুপার সন্তোষ ডি খোপড়ে। আদ্রা যে মহকুমার অধীন, সেই রঘুনাথপুরের এসডিপিও অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় সোমবার বলছিলেন, ‘‘ইন্টারনেট, হোয়াটস অ্যাপের দৌলতে ছেলেটির খোঁজ মিলেছে ঠিকই। কিন্তু, সন্তোষ খোপরে যে ভাবে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে সত্যদেবের ঠিকানা খুঁজে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, সেই উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে।’’
কী করেছেন খোপড়ে? এ দিন ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, প্রথমে যে হোমটিতে সত্যদেব ছিল, সেখানে ৬-১২ বছরের নিখোঁজ ছেলেমেয়েদের রাখা হয়। বারো বছর পেরিয়ে যাওয়ায় এক-দেড় বছর আগে সত্যদেব এসেছিল তাঁর হোমে। খোপড়ের কথায়, ‘‘সাত বছর ধরে ছেলেটা বাড়ি ছাড়া। এত দিন পরে বাড়ির ঠিকানা, বাবার পুরো নাম কিছুই বলতে পারছিল না। কেস হিস্ট্রিতে লেখা ঠিকানা ঠিক নয় সেটাও বুঝেছিলাম।’’ তবে হাল ছাড়েননি। বারবার সত্যদেবের সঙ্গে কথা বলার পরে সে জানিয়েছিল, ও যে স্কুলে পড়ত, তার সামনে জলের বড় ট্যাঙ্ক ও স্টেশন আছে। এই দুই তথ্যকে সম্বল করেই সার্চ ইঞ্জিনে বাড়ির সন্ধান শুরু করেন সন্তোষবাবু। ‘‘ভাষাগত সমস্যা থাকলেও এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম, ওর বাড়ির এলাকার নামের শুরু ‘এ’ দিয়ে। ইন্টারনেটে সার্চ করতে করতে দেখি, পশ্চিমবঙ্গের আদ্রায় রেলের প্রাথমিক স্কুলের পাশে জলের ট্যাঙ্ক রয়েছে।”—বলে চলেন খোপড়ে।
সত্যদেবকে আদ্রা বলতেই সে চিনতে পারে। খোপড়ে এসডিপিও (রঘুনাথপুর)-র ফোন নম্বর জোগাড় করে যোগাযোগ করেন। তাতেই কেল্লা ফতে! খোপড়েকে সত্যদেবের সাত বছর আগের ও বর্তমানের ছবি হোয়াটস অ্যাপে পাঠাতে বলেছিলেন এসডিপিও। পুলিশ আদ্রার স্কুলে যেতেই ভর্তির নথি থেকে সত্যদেবের বাবার নাম ও ঠিকানা মেলে। ধনঞ্জয়বাবুকে ছবি দেখাতেই তিনি শনাক্ত করেন। এ বার তাঁর ছবি পাঠানো হয় সত্যদেবের কাছে। ছেলেও চিনতে ভুল করেনি বাবাকে। দেরি না করে ধনঞ্জয়বাবুর হাতে টাকা ও ট্রেনের টিকিট দিয়ে গত ৭ জুলাই তাঁকে ঠানে পাঠান এসডিপিও।
বাস চালক ধনঞ্জয় বাহাদুর আদ্রা থানায় বসে বলছিলেন, ‘‘বনিবনা না হওয়ায় স্ত্রী ছেড়ে চলে গেছে। একমাত্র ছেলে সত্যদেবকে নিয়ে থাকতাম। ও নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে পাগলের মতো খুঁজেছি। শেষে ছেলেকে ফিরে পাওয়ার আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম।’’ আর সত্যদেবের কথায়, ‘‘হোমে তেমন কষ্ট না হলেও বাড়ির কথা সব সময় মনে পড়ত। অনেকবার বলেছি আদ্রায় আমার বাড়ি। ওরা বুঝতে পারত না।’’
তেরো বছরের সত্যদেবকে আদ্রারই স্কুলে ভর্তি করাবেন জানিয়ে এসডিপিও অভিজিৎবাবুর মন্তব্য, “তবে দেখতে হবে, ওই স্কুলের পাশে যেন জলের ট্যাঙ্ক থাকে!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy