গোলমাল থামাতে শূন্যে ১০ রাউন্ড গুলি চালায় পুলিশ। —নিজস্ব চিত্র।
রাস্তায় রাস্তায় পড়ে রয়েছে না ফাটা বোমা। চার দিকে কাঁদানে গ্যাস আর বারুদের দমবন্ধ করা ধোঁয়া! আশপাশে মুড়ি মুড়কির মতো ফাটছে গুলি-বোমা। রাস্তার ধারে মিলছে বেওয়ারিশ গুলি ভরা পিস্তল। বৃহস্পতিবার কার্যত যুদ্ধক্ষেত্রের চেহারা নিল ভাটপাড়া। সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে অন্তত দু’জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। জখম আরও অনেকে। তাঁদের বেশিরভাগের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
পরিস্থিতি এতটা জটিল হয়ে ওঠায়, ভাটপাড়ার নতুন থানার উদ্বোধন করতে রওনা হয়েও, মাঝরাস্তা থেকে নবান্নে ফেরত যান ডিজি বীরেন্দ্র। পরিস্থিতি নিয়ে নবান্নে জরুরি বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখ্য়সচিব মলয় দে , স্বরাষ্ট্র সচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ডিজি সহ শীর্ষ পুলিশ কর্তারা।বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘‘ভাটপাড়ায় বহিরাগত কিছু দুষ্কৃতী স্থানীয়দের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে জগদ্দল এবং ভাটপাড়া থানা এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করার হয়েছে।” তিনি বলেন, অতিরিক্ত ডিরেক্টর জেনারেল (দক্ষিণবঙ্গ) সঞ্জয় সিংহকে ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাঁকে অবিলম্বে ঘটনাস্থলে পৌঁছনোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।বিকেল পাঁচটা নাগাদ ভাটপাড়া থানায় পৌঁছন ডিজি বীরেন্দ্র। তিনি সেখানে শীর্ষ পুলিশ কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
অশান্তি পিছু ছাড়ছে না ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে। এলাকার ‘বাহুবলী’ নেতা অর্জুন সিংহ তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর থেকে যে অশান্তির শুরু দিন দিন তা বাড়ছে শিল্পাঞ্চলে। এলাকার মানুষের দাবি, শাসক দল এবং অর্জুন সিংহ— দু’পক্ষই মরিয়া এলাকা নিজের দখলে আনতে। লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনে জিতে এলাকায় দখল অর্জুন এবং তাঁর দলবলের। কিন্তু জমি ফিরে পেতে মরিয়া কামড় দিচ্ছে শাসকদলও।
আইনশৃঙ্খলা যাতে আরও কঠোর ভাবে বলবৎ করে শান্তি ফেরানো যায়, সে জন্য জগদ্দল থানা ভেঙে নতুন ভাটপাড়া থানা তৈরির নির্দেশ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। বৃহস্পতিবার সেই থানা উদ্বোধনের কথা। তার আগেই থানা এবং থানায় থাকা পুলিশ কর্মীদের লক্ষ্য করেও এলোপাথাড়ি বোমাবাজি করল দুষ্কৃতীরা। কয়েকশো পুলিশের সামনে গুলি চালাতেও পিছপা হল না তারা। পুলিশের সামনেই দু’পক্ষের মধ্যে গুলি-বোমা চলতে থাকে। আহত হয়েছেন ১০ জনের বেশি পুলিশ কর্মী। ভাঙচুর করা হয় পুলিশের গাড়িও। পুলিশ সূত্রে খবর, পরিস্থিতি সামলাতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস এবং শূন্যে ১০ রাউন্ড গুলিও চালায়। পুলিশের একটা সূত্র জানাচ্ছে, দুষ্কৃতীদের এই বোমা-গুলির লড়াইয়ে মৃত্যু হয়েছে কমপক্ষে দু’জনের। মৃত একজনের নাম রামবাবু সাউ (২৬)। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে মৃত অন্যজনের নাম ধরমবীর সাউ (৩০)। স্থানীয়দের দাবি, রামবাবু কৈলাশ জুটমিলের কর্মী । গুরুতর জখম হয়েছেন ৫ জন। তবে, এখনও সরকারি ভাবে পুলিশ কর্তারা কিছু জানাননি। এডিজি (আইন-শৃঙ্খলা) জ্ঞানবন্ত সিংহকে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
সূত্রের খবর, এ দিন যে ভাবে রণক্ষেত্রের চেহারা নিয়েছে গোটা এলাকা, তাতে থানা উদ্ধোধনও পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ দিন ওই থানা উদ্বোধন করতে যাওয়ার কথা ছিল রাজ্য পুলিশের ডিজি বীরেন্দ্রের। তিনি এ দিন সকালে ভাটপাড়ার উদ্দেশে রওনা হয়েও মাঝপথ থেকে নবান্নে ফিরে যান। নবান্ন সূত্রে খবর, আপাতত থানা উদ্বোধন স্থগিত। তবে এ দিন থেকেই নতুন থানা কাজ শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র সচিব। থানার আইসি-র দায়িত্ব পেয়েছেন রাজর্ষি দত্ত।
আরও পড়ুন: উন্নয়নমূলক কাজকর্মে সন্তুষ্ট হয়েই মানুষের এই রায়, সংসদে বললেন রাষ্ট্রপতি
এর আগে চলতি মাসের ১১ তারিখ ভাটপাড়া এলাকায় ব্যাপক সংঘর্ষ হয় দু’দল দুষ্কৃতীর মধ্যে। সেই সংঘর্ষে বোমার আঘাতে মৃত্যু হয়েছিল মহম্মদ হালিম এবং মহম্মদ মুস্তাকের। ওই ঘটনার তদন্তভার নেয় রাজ্য সিআইডি। ঘটনার পর দিন গ্রেফতার করা হয়েছিল ইন্দ্রজিৎ দাস, লালবাবু দাস এবং প্রদীপ সাউ নামে তিন অভিযুক্তকে। বুধবার রাতে দিঘা থেকে ওই খুনের ঘটনায় গ্রেফতার করা হয় ভাটপাড়া পুরসভার ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর লালন চৌধুরী এবং তাঁর সঙ্গী বিজেপি কর্মী শিউজি রায়কে। দু’জনেই তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন অর্জুন সিংহ বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর।
ভাটপাড়ার বিজেপি-কর্মী সমর্থকদের অভিযোগ, বুধবার রাত থেকেই দুষ্কৃতীরা তাঁদের কর্মী সমর্থকদের বাড়ি লক্ষ্য করে এলোপাথাড়ি গুলি-বোমা ছোড়া হচ্ছে। পুলিশের সামনেই সমস্তটা হচ্ছে, অথচ তাদের ভূমিকা দর্শকের মতো বলেই অভিযোগ বিজেপির। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, বুধবার রাত থেকেই ফের উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এলাকা। শুরু হয় সংঘর্ষ যা এ দিন সকালে মারাত্মক আকার নেয়। গুলি-বোমার লড়াইয়ে মুহূর্তে শুনশান হয়ে যায় গোটা এলাকায় আতঙ্কিত সাধারন মানুষ। দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। এ দিন পুলিশ তল্লাশি করতে গিয়ে রাস্তার উপর একটি বন্ধ দোকানের সামনে থেকে উদ্ধার করে একটি গুলি ভরা পিস্তল।
বন্ধ দোকানের সামনে থেকে উদ্ধার গুলি ভরা পিস্তল, যত্রতত্র পড়ে রয়েছে এ রকম না ফাটা বোমা। —নিজস্ব চিত্র।
এ দিন সকালে কাঁকিনাড়ার চার এবং পাঁচ নম্বর রেলওয়ে সাইডিং থেকে শুরু হয় সংঘর্ষ এবং তার পর সংলগ্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। প্রকাশ্য রাস্তায় শুরু হয়ে যায় গুলি-বোমার লড়াই। প্রথমে সেই লড়াই থামাতে ব্যর্থ হয় পুলিশ। এর পর ব্যারাকপুর থেকে অতিরিক্ত পুলিশ বাহিনী আসে। তাঁরা কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ে এবং শূন্যে গুলি চালিয়ে সাময়িক ভাবে দুষ্কৃতীদের বড় রাস্তা থেকে পিছু হটতে বাধ্য করে। কিন্তু এলাকার ঘিঞ্জি গলিগুলি এখনও সশস্ত্র দুস্কৃতীদের দখলে।
আরও পড়ুন: ভারতে হামলা চালাতে পারে আইএস, নজরে কাশ্মীর এবং দক্ষিণের রাজ্যগুলি
এই ঘটনার পর এলাকার সাংসদ তথা বিজেপি নেতা অর্জুন সিংহের দাবি, পুলিশের গুলিতেই মৃত্যু হয়েছে রামবাবু সাউয়ের। যদিও তৃণমূল নেতা তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী মদন মিত্রের পাল্টা প্রশ্ন, তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই সাংসদ কী ভাবে জানলেন পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয়েছে? তাঁর কথায়, ‘‘পুলিশের দাবি তারা শূন্যে গুলি চালিয়েছে। যে কোনও মৃত্যুই দুঃখের। কিন্তু সাংসদ কী ভাবে জানলেন পুলিশের গুলিতেই মৃত্যু হয়েছে ওই ব্যক্তির?’’
নবান্নে বৈঠকের পরই বিশেষ বাহিনী পাঠানো হয় ভাটপাড়ায়। র্যাফ এবং কমব্যাট ফোর্স রুটমার্চ শুরু করেছে এলাকায়। সংঘর্ষ আপাত ভাবে থামলেও, আতঙ্ক চারদিকে। বিভিন্ন এলাকার ভিতরে পুলিশি তল্লাশি চলছে। স্থানীয়দের আশঙ্কা ফের যে কোনও মুহূর্তে সংঘর্ষ শুরু হয়ে যেতে পারে।
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের YouTube Channel - এ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy