মনোনয়ন পর্বে মঙ্গলকোট ব্লক অফিসের সামনে। —ফাইল চিত্র।
ব্লক অফিসের কিছুটা আগে রাস্তার ধারে পরপর অ্যাসবেস্টসের অস্থায়ী ছাউনি। আশপাশে রাখা বেশ কয়েকটি মোটরবাইক। ছাউনির তলায়, গাছের ছায়ায়, বাইকের আসনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে জনা কুড়ি-পঁচিশ যুবক। নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব, মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রাখার ফাঁকে তাঁদের নজর ঘুরছে সামনের রাস্তায়। জরিপ করে নিচ্ছে, ব্লক অফিসে কারা ঢুকল।
এলাকার বাসিন্দারা এঁদের তৃণমূল কর্মী বলেই চেনেন। তখনও নেতৃত্ব প্রার্থিতালিকা না দেওয়ায় তৃণমূলের মনোনয়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। তা হলে এখন ওঁরা কার উপরে নজর রাখছেন? মনোনয়নের ফর্ম তুলে বেরোনোর মুখে এক সিপিএম কর্মী বলে গেলেন ‘‘ওদের কাজ কোন দলের কে মনোনয়নের ফর্ম তুলতে এলেন, শুধু সেটুকু দেখা। এখানে ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট করছে না। যে গ্রাম থেকে বিরোধী দলের কেউ ব্লক অফিসে আসছেন, সে এলাকার দলীয় কর্মীদের শুধু খবরটা জানিয়ে দিচ্ছে।’’ তার পরে? ওই বাম কর্মীর কথায়, ‘‘গ্রামে ফিরেই বিরোধী দলের সেই কর্মী বার্তা পেয়ে যাচ্ছেন, প্রার্থী হলে তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে কী মূল্য দিতে হতে পারে!’’
পূর্ব বর্ধমানের মঙ্গলকোটে মনোনয়ন জমার শেষ দিনটি ছাড়া গোটা পর্বে ব্লক অফিস চত্বর ছিল এমনই ‘শান্তিপূর্ণ’। তা সত্ত্বেও ব্লকের ১৫টি পঞ্চায়েতের মোট ২৪৪টি আসনের মধ্যে ১৪৮টি এবং পঞ্চায়েত সমিতির ৪৫টি আসনের মধ্যে ২৫টিতে তৃণমূল ছাড়া কারও মনোনয়ন জমা পড়েনি। গত প্রায় দেড় দশক এই অঞ্চলে তৃণমূলের সংগঠন যিনি সামলেছেন, সেই অনুব্রত মণ্ডল এখন তিহাড় জেলে। কিন্তু তাঁর দাঁড় করিয়ে যাওয়া ‘উন্নয়ন’ যে এখনও রাস্তায় অপেক্ষা করছে, তা এই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের বহর দেখেই মালুম হচ্ছে, দাবি বিরোধীদের।
বাম আমলে রাজ্যের সন্ত্রস্ত্র এলাকার তালিকায় উপরের দিকে নাম ছিল মঙ্গলকোটের। বিরোধী নেতা-কর্মীদের বাড়িতে হামলা, বোমাবাজি, গুলি ছিল নিত্য ঘটনা। তৃণমূল কর্মীদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নৃশংস ভাবে খুনের অভিযোগ উঠেছে একের পর এক। আক্রান্ত কর্মীদের সঙ্গে দেখা করতে এসে রাজ্যের নেতারাও হামলার মুখে পড়েছেন। এমন হাড় হিম করা সন্ত্রাসের চেহারা মঙ্গলকোটে এখন আর নেই। তৃণমূলের আমলে বিরোধী নেতা-কর্মীদের খুন-জখম হওয়ার অভিযোগ তেমন ওঠেনি। বরং, গত কয়েক বছরে পরপর খুন হয়েছেন তৃণমূলেরই কয়েক জন নেতা। সেগুলির বেশির ভাগে আবার অভিযোগের আঙুল উঠেছে দলেরই একাংশের বিরুদ্ধে।
তবে কি মঙ্গলকোট এখন সন্ত্রাস-মুক্ত? বাসিন্দাদের বড় অংশ এবং বিরোধীরা শোনাচ্ছেন অন্য কথা। তাঁদের দাবি, অনুব্রতের পর্যবেক্ষণে থাকা মঙ্গলকোটে প্রায় এক দশক ধরে চলছে ‘নীরব সন্ত্রাস’। শুধু ভোটের সময়েই নয়, এই সন্ত্রাস চলে সারা বছর। চাপ, হুমকি দিয়ে কোনও বিরোধীকেই মাথা তুলতে না দেওয়ার সেই ‘পন্থা’ ভোট-বাক্সেও ফল দিচ্ছে। হুমকিতে পিছু না হটলে নানা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া, গ্রামে কাজকর্ম করতে না দেওয়া, সরকারি প্রকল্পের সুবিধা পেতে হয়রান করার মতো পথও নেওয়া হয় বলে দাবি বিরোধীদের।
গত পঞ্চায়েত ভোটে মঙ্গলকোটে সব আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছিল তৃণমূল। এ বারও অধিকাংশ আসনে বিরোধী প্রার্থী নেই। এমন একচ্ছত্র আধিপত্যের ‘কৃতিত্ব’ অনুব্রত ওরফে কেষ্টকে দিচ্ছেন তৃণমূল কর্মীরা। লাখুরিয়ার তৃণমূল কর্মী মিঠুন শেখ, গোতিষ্ঠার সুব্রত ঘটকদের কথায়, ‘‘ভোটে কী ভাবে লড়তে হয়, কেষ্টদা আমাদের শিখিয়েছেন। সে ‘ফর্মুলাই’ কাজে লাগানো হচ্ছে। কোনও অশান্তি ছাড়াই তাই ভোট-পর্ব মিটবে।’’
মঙ্গলকোটের প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক শাজাহান চৌধুরী, কংগ্রেস নেতা জগদীশ দত্তদের অভিযোগ, ‘‘বিরোধীদের আটকাতে আগে থেকেই গ্রামে গ্রামে নীরব সন্ত্রাস চলেছে। যাঁদের আটকানো যায়নি, মনোনয়নের শেষ দিনে তাঁদের উপরে সরাসরি হামলা হয়েছে।’’ বিজেপির জেলা (কাটোয়া) সভাপতি গোপাল চট্টোপাধ্যায়েরও দাবি, ‘‘অনুব্রতের দেখানো পথেই চোরা সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছেন তৃণমূল কর্মীরা। তাই অনেক আসনে প্রার্থী দেওয়া যায়নি।’’
মঙ্গলকোটের তৃণমূল বিধায়ক অপূর্ব চৌধুরীর অবশ্য পাল্টা দাবি, ‘‘মঙ্গলকোট এখন শান্ত। বাম আমলের সন্ত্রাসের ছবি আর দেখতে চান না বলেই মানুষ তৃণমূলের পাশে রয়েছেন। বিরোধীরা প্রার্থী খুঁজে না পেয়ে অবান্তর কথা বলছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy