—প্রতীকী ছবি।
কৃষ্ণনগর পোস্ট অফিস মোড়ে পুরসভার ঠিক উল্টো দিকে সারি সারি চশমার দোকান। সকাল থেকে প্রায় সব ক’টি দোকান ঘুরেও খালি হাতে ফিরতে হয়েছে বিষ্ণু মণ্ডলকে। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও মিলল না ‘কালো চশমা’। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, গত দু’দিন ধরে কালো চশমার এমন আকাল ওই বাজারে। শুধু কৃষ্ণনগর নয়, রানাঘাট, কল্যাণী ও করিমপুর— প্রায় সর্বত্রই একই ছবি। ‘কনজাঙ্কটিভাইটিস’-এর দাপটে বাজার থেকে কার্যত ‘উধাও’ কালো রোদচশমা!
ভরা বর্ষা মানেই জল-কাদার বিড়ম্বনার সঙ্গে কিছু অসুখ-বিসুখের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়া। তার মধ্যে অন্যতম কনজাঙ্কটিভাইটিস। চোখের এই সংক্রমণ এ বার নদিয়ায় কার্যত মহামারির চেহারা নিয়েছে। ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, এই রোগের জেরেই গত কয়েক দিন ধরে দেদার বিকোচ্ছে কালো রোদচশমা। কৃষ্ণনগরের চশমা বাজারের ব্যবসায়ী উজ্জ্বল সাহা বলেন, ‘‘এই ক’দিনে প্রচুর চশমা বিক্রি হয়েছে। সকলের বাড়িতে কারও না কারও জয় বাংলা হয়েছে। জয় বাংলার সময় কালো চশমা বেশি বিক্রি হয় ঠিকই, কিন্তু এ রকম আগে কখনও দেখিনি!’’ কৃষ্ণনগর সদর হাসপাতাল মোড়ের দোকানগুলিতে খোঁজ করে কালো চশমা পাননি ছোট ব্যবসায়ী সুবীর ঘোষও। এ দিক-সে দিক ঘোরাঘুরির পর দুপুরে কৃষ্ণনগর স্টেশনের এক নম্বর প্লাটফর্মে এক হকারের কাছ থেকে সেই রোদচশমা মেলে। সুবীরের কথায়, ‘‘আমার ছেলের কনজাঙ্কটিভাইটিস হয়েছে। এই চশমা কিনতে গিয়ে কালঘাম ছুটে গেল! ছেলের হয়েছে, আমার আর ওঁর মায়েরও হতে পারে। তাই এক সঙ্গে তিনটেই কিনে নিলাম।’’
চলতি বছরে কনজাঙ্কটিভাইটিসের সংক্রমণ একটু বেশিই ছড়িয়েছে। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, এই রোগ সংক্রামক। চোখের কনজাঙ্কটিভা আক্রান্ত হলেই এই অসুখ হয়। সাধারণত, ভাইরাস, ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাকের আক্রমণে এই সংক্রমণ হয় চোখে। যে হেতু গত তিন বছরে করোনা পরিস্থিতির জেরে দূরত্ববিধি ছিল, সেই কারণে এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল কম। সেই দূরত্ববিধি কমে যাওয়ায় এই রোগ এ বছরে বেশি ছড়িয়েছে। আর খুদে পড়ুয়াদের মধ্যে চোখে-মুখে হাত দেওয়ার প্রবণতা বেশি। ফলে কারও এক জনের হলেই, সেটা দ্রুত অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। নদিয়া জেলার স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে প্রতি দিন গড়ে ১৫-২০ জন করে রোগী এই সংক্রমণ নিয়ে আসছেন। ব্লক হাসপাতালে সংখ্যাটা পঞ্চাশের বেশি। মহকুমা এবং জেলা হাসপাতালের ‘আউটডোর’ ক্লিনিকেও শ’য়ে শ’য়ে মানুষ আসছেন লাল চোখ নিয়ে। এই সময়ে চোখে ড্রপ দেওয়ার পাশাপাশি কালো চশমা পরার পরামর্শও দেওয়া হয়ে থাকে। কারণ, তাতে বাইরের আলো আর বীজাণু দুই-ই আটকাবে। বার বার চোখে হাত দেওয়ার প্রবণতাও কমে।
চিকিৎসকদের পরামর্শ যা-ই হোক না কেন, কনজাঙ্কটিভাইটিস আতঙ্কে যেন গোটা জেলাই চোখ ঢেকেছে। চশমা ব্যবসায়ীদের একাংশের বক্তব্য, প্রয়োজন না থাকলেও অনেকেই আগেভাগে কালো চশমা কিনে বাড়িতে রেখে দিচ্ছেন। যদি পরে দরকার হয়! করিমপুরের চশমা ব্যবসায়ী প্রদীপ্ত মজুমদারই যেমন বলছেন, ‘‘পাড়ায় কারও কনজাঙ্কটিভাইটিস হয়েছে শুনেই লোকজন চলে আসছে। আগেভাগে চশমা কিনে রাখছে। এই জন্য কালো চশমার আরও আকাল তৈরি হচ্ছে।’’ বাড়তি চাহিদা দেখে ইচ্ছে মতো দাম হাঁকতেও ছাড়ছেন না দোকানদারেরা। রানাঘাটে যে চশমা এত দিন ৭০-৮০ টাকায় পাওয়া যেত, তা এখন ১৫০-২০০ টাকায় বিকোচ্ছে। একটু ভাল মানের ২০০ টাকার চশমা বিক্রি হচ্ছে প্রায় দ্বিগুণ দামে। বিক্রেতাদের অবশ্য যুক্তি, চাহিদা বেশি থাকায় পাইকারি বাজার থেকেই বাড়তি দামে চশমা কিনতে হচ্ছে। সেই কারণেই দাম বাড়াতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। কৃষ্ণনগরের এক চশমা দোকানের মালিক রমেশ সাহা বলেন, ‘‘এমনিতেই গরম কালে প্রতি দিন গড়ে ১০-১২টা করে রোদচশমা বিক্রি হয়। তাতে মুনাফা সামান্যই হয়। এখন দিনে ৫০-৬০টা করে বিক্রি হচ্ছে। তাতে লাভ বেশি হচ্ছে বটে, কিন্তু কালো চশমা জোগাড় করতে পাইকারি বাজারেরও ঝক্কি পোহাতে হচ্ছে!’’
এই পরিস্থিতিতে ক্রেতাদের একাংশ চশমা নিয়ে ‘কালোবাজারি’র অভিযোগ তুলছেন। করিমপুর আনন্দপল্লির সুভাষ বিশ্বাসের গোটা পরিবারই কনজাঙ্কটিভাইটিসে আক্রান্ত। বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন একটি দোকান থেকে চারটি কালো রোদচশমা কিনে ফেরার পথে সুভাষ বলেন, ‘‘করোনাভাইরাসের সময়েও মাস্ক আর স্যানিটাইজার নিয়ে ঠিক এ রকম হয়েছিল। যে ভাবে ঘরে ঘরে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে, তাতে সরকারি পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy