গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় ৩৫ আসন জিততে হবে। লক্ষ্যমাত্রা দেওয়ার পাশাপাশি চাপও দিয়ে চলেছেন অমিত শাহ। তার জন্য বুথ শক্তিশালী করতে হবে। একের পর এক কর্মসূচি ঘোষণা করে চলেছেন সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নড্ডা। সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন কর্মসূচি তো রয়েছেই। সে সবই ‘সফল’ করতে রাজ্য নেতারাও দল এবং সাত মোর্চা নেতৃত্বকে চাপে রাখছেন। মোর্চার নেতারাও একের পর এক কর্মসূচি ঘোষণা করে চলেছেন। সে সব পালন করতে গিয়ে নাজেহাল কর্মীরা। একটার ঘাড়ে উঠে যাচ্ছে অন্য একটা কর্মসূচি। কিন্তু এতে লাভের লাভ হচ্ছে কি? রাজ্য নেতারা মানতে না চাইলেও কর্মসূচির ‘চাপ ও সাফল্যের’ সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে দলের অন্দরেই।
তবে এর পাশাপাশি রাজ্য নেতাদের একাংশ এমনও বলছেন যে, রাজ্য বিজেপির একটা কাঠামো তৈরি করা গিয়েছে। যেটা আগে ছিল না। সিপিএম যেমন আগে ব্রিগেড সমাবেশ করে সংগঠনকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করত, তেমনই রামমন্দিরের উদ্বোধনকে ‘ব্যবহার’ করে বিজেপি ভোটের আগে দলকে চাঙ্গা করতে চাইছে। বিবিধ কর্মসূচির মাধ্যমে কোথাও একটা ‘দলগত সংহতি’ তৈরি করা হচ্ছে। যেটা আগে বঙ্গ বিজেপিতে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত ছিল।
সম্প্রতি শাহ এবং নড্ডা কলকাতা সফরে এসে রাজ্য নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে দলকে বলা হয়, সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে ‘বুথ সশক্তিকরণ’ কর্মসূচিতে। এর পরেই বসে রাজ্যের বর্ধিত কার্যকারিণী বৈঠক। সেখানে নির্দেশের পর নির্দেশ দেন রাজ্য নেতৃত্ব। ছ’টি গুরুত্বপূর্ণ তারিখ ঠিক করেন রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব। বলা হয়, রাজ্য স্তরের নির্বাচন পরিচালন কমিটির পরে প্রতিটি লোকসভা স্তরেও হবে একই রকম কমিটি। সেগুলি শেষ করতে হবে ১৬ জানুয়ারির (মঙ্গলবার) মধ্যে। এর পরে বিধানসভা ধরে ধরে এলাকাভিত্তিক কমিটি গঠন করতে হবে ২০ জানুয়ারির মধ্যে। ১২ জানুয়ারি স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিন পালন করতে বলা হয়েছিল প্রতিটি মণ্ডলে। বলা হয়েছিল, ১৪ জানুয়ারি মকরসংক্রান্তির দিন সেবামূলক কর্মসূচি নিতে হবে।
স্বামীজির জন্মদিন পালন হয়েছে। তবে নেহাতই গুটিকয়েক এলাকায়। শীর্ষ স্তরের নেতারা সেবামূলক কাজে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু কর্মীরা? তাঁদের তো বড় কর্মসূচি রয়েছে! বাড়ি বাড়ি গিয়ে রামমন্দির উদ্বোধনের আমন্ত্রণ জানাতে হবে। ২২ জানুয়ারি, রামমন্দির উদ্বোধনের দিন স্থানীয় মন্দিরে পুজো করতে হবে, বাড়িতেও প্রদীপ জ্বালাতে হবে। এর পরে পরেই রয়েছে ২৮ জানুয়ারি রবিবার প্রধানমন্ত্রীর ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠান বুথ স্তরে শোনার কর্মসূচি।
এহ বাহ্য!
প্রতিটি ব্লক স্তর থেকে মানুষকে অযোধ্যায় নিয়ে যেতে হবে সারা ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে। এ সবের মধ্যেই নতুন ভোটারদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার নির্দেশ রয়েছে। তার মধ্যেই রাজ্যে এসেছে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘বিকশিত ভারত সঙ্কল্প যাত্রা’। তাতেও যোগ দিতে হচ্ছে কর্মীদের। দল আসন্ন লোকসভা ভোটে যুব নেতৃত্বের উপরে বেশি চাপ দিতে চাইছে। কারণ, প্রধানমন্ত্রীর লক্ষ্য নতুন ভোটারদের দিকে। সে জন্য কলেজ থেকে ক্লাব— সর্বত্র দলের যুব শাখাকে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।
২২ জানুয়ারি অযোধ্যায় রামমন্দির উদ্বোধন হয়ে গেলেই ২৫ জানুয়ারি ‘নব মতদাতা সম্মেলন’ নামে কর্মসূচি মোদীর। সে দিন দেশের মোট পাঁচ হাজার জায়গায় নতুন ভোটারদের জমায়েত চায় দল। রাজ্যকে বলা হয়েছে, কমপক্ষে পাঁচটি জায়গায় পাঁচ হাজার মানুষের সমাবেশ করতে হবে মোদীর ভার্চুয়াল বক্তৃতা শোনার জন্য। সেই ভিড়ের মধ্যে আবার কমপক্ষে এক হাজার নতুন ভোটার আনতে হবে।
এই কর্মসূচি সফল করতে রাজ্য বিজেপির যুব মোর্চা তিনটি কর্মসূচি নিয়েও ফেলেছিল। তারা ঠিক করেছিল ১৩ থেকে ১৬ জানুয়ারি চলবে খেলার মাঠ, স্টেডিয়াম, ক্লাব এবং জিমে গিয়ে নতুন ভোটার ধরা। সেটা শেষ হতে না হতেই ১৭ থেকে ১৯ জানুয়ারি শহরে-গ্রামে সমস্ত কোচিং সেন্টারে গিয়ে কথা বলা হবে পড়ুয়া ভোটারদের সঙ্গে। পরের দু’দিন নতুন ভোটারের খোঁজে বাড়ি বাড়ি যাওয়া। এর পরে আবার ‘গ্রামে চলো’ কর্মসূচিও রয়েছে যুব মোর্চার। বিজেপির মহিলা-সহ বাকি মোর্চার উপরেই এমন ‘চাপ’। দিল্লির নেতারা জানিয়ে দিয়েছেন, ‘যুবতী সম্মেলন’ও করতে হবে।
এত এত কর্মসূচি এক সঙ্গে করতে গিয়ে কি সেগুলি আদৌ পুরোপুরি করে ওঠা যাচ্ছে? লাভ হচ্ছে বিজেপির? ঘোষণা হলেও সব কর্মসূচি ঠিকঠাক পালিত হচ্ছে কি? একটার ঘাড়ে আর একটা তুলে গুলিয়ে ফেলছেন না তো নিচুতলার কর্মীরা?
এমন নানা প্রশ্ন এখন ঘুরছে বিজেপির অন্দরে। তবে প্রকাশ্যে সকলের মুখেই এক রা— ‘‘দলের কর্মসূচি তো মানতেই হবে। সব ঠিক ভাবেই হচ্ছে।’’
একান্ত আলোচনায় কী বলছেন অনেকে? হুগলি জেলার এক যুবনেতা যেমন বলছেন, ‘‘দলের কাজ তো করতেই হবে! কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই সব কর্মসূচি সফল করতে গিয়ে নিজের এলাকার বুথের দিকেই নজর দিতে পারছি না। এত বৈঠকে বসতে হচ্ছে যে, কাজের সময়টাই কমে যাচ্ছে। তবে এই ধরনের কর্মসূচির একটা সুবিধা হল, সবগুলোর মধ্য দিয়েই সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগটা হয়ে যাচ্ছে।’’ যা একেবারেই মানতে নারাজ বীরভূমের এক জেলা স্তরের নেতা। তিনি বলছেন, ‘‘নতুন মানুষের সঙ্গে আদৌ যোগাযোগ হচ্ছে না! সব কর্মসূচিতে ভিড় জমাতে একই কর্মীকে বার বার ডাকা হচ্ছে। আসলে তাঁদেরই ডাকা হচ্ছে, যাঁরা আসবেন নিশ্চিত।’’ তাঁর আরও দাবি, ‘‘যাঁরা মোদীজির ‘মন কি বাত’ শুনছেন, তাঁরাই আবার নতুন ভোটার হয়ে অন্য কর্মসূচিতে যাচ্ছেন। এ সবের মধ্যে ‘নমো’ অ্যাপের প্রচার এবং নিয়মিত ‘টাস্ক’ও করতে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে সব কথা মানতে গিয়ে তাঁরা চাপে পড়ছেন। কেউ নিজের মুখে না বললেও জানতে পারছি, বুঝতে পারছি।’’
এত বেশি কর্মসূচি যে ঠিক নয়, সেটা মানছেন রাজ্য স্তরের নেতারাও। তাঁদের এক জনের বক্তব্য, ‘‘আসলে কোনও কর্মসূচিই পুরোপুরি সফল হচ্ছে না। খামচে খামচে চলছে। নভেম্বরে অমিত শাহের সভার পরেই ডিসেম্বরে গীতাপাঠ! এর পরে রোজই কিছু না কিছু বলে দেওয়া হচ্ছে। খাতায়কলমে সেই সব কর্মসূচি সফল দেখানোও হচ্ছে। কিন্তু লাভ হচ্ছে কি? সেটাও ভাবা দরকার।’’ ওই নেতার দাবি, ‘‘দলেও এটা নিয়ে কথা হচ্ছে। কী ভাবে গোটাটা একসঙ্গে, এক ছাতার তলায় আনা যায়, সেটা ভাবতে হবে। তবে এটাও ঠিক যে, কর্মীদের লাগাতার কর্মসূচিতে থাকতে হবে। এটাও বুঝতে হবে যে, অনেক কর্মসূচি থেকে তিলতিল করেই তিলোত্তমা হবে। লোকসভা নির্বাচনের লক্ষ্যপূরণ হওয়ার আগে কারও ছুটি নেওয়া চলবে না। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মতো আমরাও সেটাই চাই।’’ যা মেনে নিয়েও কলকাতার এক যুব নেতা বলছেন, ‘‘কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবাস্তব কর্মসূচিও দেওয়া হচ্ছে! এটা ভাবা হচ্ছে না যে, গুজরাত বা উত্তরপ্রদেশে যেটা সম্ভব, সেটা বাংলায় সম্ভব নয়। ফলে অনেক কিছুই নাম-কা-ওয়াস্তে হচ্ছে।’’
তবে কর্মীরা যে কর্মসূচির চাপে নাজেহাল, তা মানতে নারাজ বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। তাঁর কথায়, ‘‘আমি, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী-সহ সাংসদ, বিধায়কেরা প্রতি দিন কোনও না কোনও কর্মসূচিতে যাচ্ছেন। কেউ বসে নেই। দলের কোনও নেতা-কর্মীও নয়। আর তাঁরা কেউ তো আমায় বলেননি যে, তাঁরা নাজেহাল। বরং যেখানেই যাচ্ছি, সেখানেই বিপুল উৎসাহ দেখতে পাচ্ছি।’’
তবে কর্মসূচির ‘চাপ’ রয়েছে। সেটা মেনে নিয়েছেন সুকান্ত। তার পর বলেছেন, ‘‘আসল চাপে তো এখানকার শাসক দল। আমাদের তো আসন বাড়ানোর চাপ। আর ওদের লড়াই সরকার ধরে রাখার। লোকসভায় খারাপ ফল হলে নিজেদের মধ্যে মারামারি করে ওরা রাজ্যে সরকার রাখতে পারবে না। বিজেপি কর্মীরা কিন্তু সব চাপ সহ্য করেই মোদীজিকে তৃতীয় বার ক্ষমতায় আনার জন্য তৈরি হচ্ছেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy