Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
State News

রত্নার উত্থানে আগুনে ঘি! শোভন শিবিরে তৎপরতা, আসরে বিজেপি-ও

শোভন চট্টোপাধ্যায় এ বার নিষ্ক্রিয়তার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারেন, তা-ও রবিবার কিছুটা স্পষ্ট হয়েছে।

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২০ ২১:৫৪
Share: Save:

দীর্ঘ নিষ্ক্রিয়তা কাটিয়ে তৎপরতা শুরু হল শোভন চট্টোপাধ্যায়ের শিবিরে। বিজেপির তরফ থেকে কলকাতার প্রাক্তন মেয়রের কাছে বার বারই বার্তা পৌঁছচ্ছিল। সাড়া দিচ্ছিলেন না শোভন। কিন্তু শোভনের খাসতালুকের দায়িত্ব তৃণমূল হাঁকডাক করে রত্না চট্টোপাধ্যায়ের হাতে তুলে দিতেই পরিস্থিতি বদলানোর ইঙ্গিত মিলতে শুরু করল। বিজেপির কেন্দ্রীয় ও রাজ্য নেতৃত্বের সঙ্গে গত দু’দিনে বেশ কয়েক বার শোভনদের যোগাযোগ হয়েছে বলে খবর। বিজেপির হয়ে শোভনের মাঠে নামা যে আর অসম্ভব নয়, সে ইঙ্গিত মিলতে শুরু করেছে প্রাক্তন মেয়রের বিভিন্ন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের শরিক বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্যেও।

দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) বি এল সন্তোষের উপস্থিতিতে রবিবার কলকাতায় খুব বড় সাংগঠনিক বৈঠক সেরেছে রাজ্য বিজেপি। সেই বৈঠকে এ দিন শোভন চট্টোপাধ্যায়কেও ডাকা হয়েছিল বলে জানা গিয়েছে। কিন্তু ২০১৯-এর ২০ অগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত বিজেপির কোনও মঞ্চেই যেমন শোভনকে দেখা যায়নি, তেমন এ দিনের বৈঠকেও তিনি গরহাজিরই ছিলেন। ২০১৯-এর অক্টোবরে এবং ২০২০-র মার্চে কলকাতায় অমিত শাহের কর্মসূচিতে ডাক পেয়েও শোভন যখন হাজির হননি, তখন এ দিনের সাংগঠনিক বৈঠকে যোগ দেবেন, এমন আশা বিজেপি নেতৃত্বেরও খুব একটা ছিল না। কিন্তু তার পরেও শোভনকে যে ডাকা হল এ দিনের বৈঠকে, গত দু’দিনে যে বিজেপি নেতৃত্বের তরফ থেকে বার বার যোগাযোগ করা হল শোভন-বৈশাখীর সঙ্গে, তা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এখনও যে শোভন চট্টোপাধ্যায়ের বিষয়ে বিজেপি হাল ছেড়ে দেয়নি, সেটাই স্পষ্ট হচ্ছে বলে বিশ্লেষকদের মত।

শোভন চট্টোপাধ্যায় এ বার নিষ্ক্রিয়তার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারেন, তা-ও কিন্তু রবিবার কিছুটা স্পষ্ট হয়েছে। বিজেপি সূত্রের খবর, দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এবং রাজ্য নেতৃত্বের তরফ থেকে একাধিক নেতা গত দু’দিনে শোভন-বৈশাখীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। শুধু শোভন নন, বৈশাখীকেও সক্রিয় হতে হবে— এমন অনুরোধ রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় স্তরে সামনের সারিতে থাকা নেতাদের কাছ থেকেই গিয়েছে বলেও জানা যাচ্ছে। তাতে শোভনদের সাড়া আগের চেয়ে ইতিবাচক বলেই বিজেপি সূত্রের খবর।

আরও পড়ুন: রাজ্যসভার জন্য ৪ প্রার্থী ঘোষণা মমতার, বিদায়ীদের কেউই টিকিট পেলেন না

স্ত্রী রত্না চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দীর্ঘ দিন ধরে বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা চলছে শোভনের। বহু দিন ধরেই শোভন আলাদা থাকেন। রত্নার সঙ্গে থাকবেন না বলে নিজের পর্ণশ্রীর বাড়ি ছেড়ে গোলপার্কের এক বহুতলে এসে উঠেছেন অনেক দিন আগেই। গত পাঁচ-ছয় মাসে পুরনো ফেরার ডাক পেয়েছেন যত বার, তত বারই তৃণমূলে রত্নার উজ্জ্বল উপস্থিতি এবং ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব সম্পর্কে নিজের বিরাগ স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তিনি তৃণমূল ছাড়ার পর থেকে তাঁর ওয়ার্ডে (১৩১) রত্নার গুরুত্ব যে ভাবে বাড়ানো হচ্ছিল, তাতে তাঁর পক্ষে তৃণমূলে ফেরা যে আর সম্ভব নয়, সে ইঙ্গিত কলকাতার প্রাক্তন মেয়র নানা ভাবে দিচ্ছিলেন। কিন্তু তৃণমূল নেতৃত্ব সে সব কথায় যে কান দেননি, তা পুরভোটের মুখে এসে আরও স্পষ্ট হয়ে গেল। শুধু ১৩১ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্ব নয়, শোভন যে আসনের বিধায়ক, সেই বেহালা পূর্ব বিধানসভা আসনের পর্যবেক্ষক নিযুক্ত করে রত্নাকে এ বার আরও বড় দায়িত্ব তৃণমূল দিয়ে দিল। পুরভোটে যে রত্না প্রার্থী হচ্ছেন, তা-ও প্রায় নিশ্চিত।

শোভন ঘনিষ্ঠরা বলছেন— এর চেয়ে স্পষ্ট কোনও বার্তা আর হয় না। যাঁকে নিয়ে শোভনের মূল আপত্তি, তাঁর গুরুত্ব ক্রমশ বাড়িয়ে তোলা এবং শোভনের ওয়ার্ড বা শোভনের বিধানসভা আসনের দায়িত্বই সে হাতে তুলে দেওয়া আসলে বলে বলে শোভনকে চ্যালেঞ্জ ছোড়ার শামিল— মনে করছে শোভনের ঘনিষ্ঠ বৃত্ত।

আরও পড়ুন: বিদেশে পালানোর ছক! মুম্বই বিমানবন্দরে আটক ইয়েস ব্যাঙ্ক কর্তার মেয়ে

পরিস্থিতি আরও তপ্ত হয়েছে রত্না চট্টোপাধ্যায়কে পাশে নিয়ে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সাংবাদিক সম্মেলনকে কেন্দ্র করে। তৃণমূলের সঙ্গে শোভনের দূরত্ব যতই বাড়ুক, মাঝখানে সেতু হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়। বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পরেও ভাইফোঁটা নিতে মমতার বাড়িতে শোভন ছুটে গিয়েছিলেন, সে কথা ঠিক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে শোভনের যোগাযোগের একটা সূত্র ক্ষীণ ভাবে হলেও যে টিকে ছিল, তা-ও তৃণমূল সূত্রেই জানা যাচ্ছিল। কিন্তু শোভনের সঙ্গে মূল যোগাযোগটা তৃণমূলের তরফে রাখছিলেন দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ই। প্রাক্তন মেয়রের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের শরিক তথা বান্ধবী বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তৃণমূল মহাসচিবের ব্যক্তিগত সম্পর্ক বেশ ভাল ছিল। তা ছাড়া তিনি যে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষা, সেই কলেজের পরিচালন সংক্রান্ত জটিলতা নিয়েও শিক্ষামন্ত্রী পার্থর সঙ্গে নিরন্তর যোগাযোগ রেখে চলতেন বৈশাখী। শনিবার সেই পার্থ চট্টোপাধ্যায় বেহালা পূর্বে রত্নাকে পাশে নিয়ে দলীয় কর্মসূচি পালন করেছেন। রত্নাকে পাশে নিয়ে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়েছেন। ‘এলাকার বিধায়ক’কে (শোভনকে) ‘নিষ্ক্রিয়’ আখ্যা দিয়েছেন। সেই কারণেই রত্না চট্টোপাধ্যায়কে দায়িত্ব দিতে হল বলে জানিয়েছেন। ওই সাংবাদিক সম্মেলন তথা কর্মসূচির পরে পার্থর সঙ্গে বৈশাখীর সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছেছে বলে শোভনের ঘনিষ্ঠ বৃত্ত সূত্রেই জানা যাচ্ছে। ফলে বিজেপির জন্য শোভনের সক্রিয়তাকে পার্থ এত দিন নানা ভাবে ঠেকিয়ে রাখছিলেন বলে যে খবর আসছিল, এখন তা আর কতটা পারবেন, সে নিয়ে সংশয় বিস্তর।

সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছনোর কারণ আরও রয়েছে। প্রাক্তন মেয়রের ‘কাছের লোক’ হিসেবে পরিচিত কয়েক জন জানাচ্ছেন, বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক বহাল রেখে চললেও তাঁর সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য পার্থ কিছুই করেননি। পার্থ সব কিছুই ‘ঝুলিয়ে’ রাখছিলেন বলে তাঁদের দাবি। মিল্লি আল-আমিন কলেজে যে সমস্যা চলছে, বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়কে সেখানে যে ভাবে ‘কাজে বাধা’ দেওয়ার অভিযোগ উঠছে, তা মেটানোর কোনও চেষ্টা পার্থ করেননি বলে শোভন শিবিরের দাবি। বৈশাখী একাধিক বার ইস্তফা দেওয়া সত্ত্বেও পার্থ তা গ্রহণ করেননি, সে কথা ঠিক। কিন্তু পার্থ যদি সত্যিই সমস্যাগুলোর সমাধান করতে চাইতেন, তা হলে এত দিন সেগুলো কিছুতেই জিইয়ে থাকতে পারত না বলে শোভন ও বৈশাখী মনে করছেন। শোভনের ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে তেমনই জানা যাচ্ছে। শোভন এবং বৈশাখীকে বার বার তৃণমূলে ফিরতে বললেও বৈশাখীর জন্য তৃণমূলের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সংগঠন ‘ওয়েবকুপা’র দরজা পার্থ আর কিছুতেই খোলেননি। তৃণমূল ছাড়ার আগে বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় ওই সংগঠনের অন্যতম শীর্ষ পদাধিকারী ছিলেন।

রত্না চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে তৃণমূল নেতৃত্বের এবং পার্থর আচরণ ঠিক উল্টো বলে শোভন শিবিরের অভিযোগ। শোভনের আপত্তি রয়েছে জেনেও রত্নার জন্য দলের অন্দরে জায়গা যে ক্রমশ বাড়ানো হয়েছে, তা দৃশ্যমান। দলে রত্নার গুরুত্ব ক্রমশ বাড়িয়ে তুলে শোভনকে ‘অবজ্ঞা’র বার্তা দেওয়া হয়েছে বলেও বেহালা পূর্বের বিধায়কের ঘনিষ্ঠরা মনে করছেন।

বিজেপি-ও কিন্তু পরিস্থিতি বুঝে তৎপরতা বাড়িয়েছে বলে খবর। টানাপড়েন যতই চলুক, শোভন বা বৈশাখীর সঙ্গে যোগাযোগটা সম্পূর্ণ বন্ধ বিজেপি কখনওই করেনি। পুরভোটের কাছাকাছি এসে যোগাযোগ বাড়ানো হচ্ছিল। শোভনের নির্বাচনী ক্ষেত্রের দায়িত্ব রত্নার হাতে তৃণমূল তুলে দেওয়ার পরে প্রাক্তন মেয়রের শিবিরে উষ্মা কতটা বাড়বে, তা আঁচ করে নিতেও বিজেপি নেতাদের ভুল হয়নি। তাই শনিবার থেকে বিজেপির কেন্দ্রীয় ও রাজ্য নেতারা দফায় দফায় শোভন-বৈশাখীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করেন বলে খবর। ‘ভুল বোঝাবুঝি’ কিছু থাকলে মিটিয়ে নেওয়া যেতেই পারে, এমন বার্তাও শোভন শিবিরে পৌঁছয় বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বের শীর্ষ স্তর থেকে। ফলে শোভন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিজেপি নেতৃত্বের কথাবার্তা আবার এগোতে শুরু করেছে বলে জানা যাচ্ছে। রবিবার শোভন শিবিরের লোকজন তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বলতে শুরু করেছেন, ‘‘এক দল বলছে শোভন চট্টোপাধ্যায় ‘নিষ্ক্রিয়’ বিধায়ক। আর একটা দল তখন সক্রিয় হওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে, সম্মানের চোখে কারা দেখছে।’’

বিজেপি নেতাদের কেউই এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য এখনও করেননি। মন্তব্য করেননি শোভনও। তবে বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন আর নস্যাৎ করতে চাননি শোভনের সক্রিয় হয়ে ওঠার সম্ভাবনা। একাধিক বিজেপি নেতা যে সোমবার তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, তা বৈশাখী মেনে নিয়েছেন। তবে কী কথা হল, সে প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব কৌশলে এড়িয়েছেন। সহাস্য উত্তরে বলেছেন, ‘‘অনেক দলের অনেক নেতার সঙ্গেই তো আলাপ-পরিচয় রয়েছে। আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে তাঁদের অনেকে তো শুভেচ্ছা জানানোর জন্যও ফোন করে থাকতে পারেন।’’

কিন্তু বেহালায় রত্না চট্টোপাধ্যায়ের গুরুত্ব তৃণমূল যে ভাবে বাড়াল, তাতে শোভন চট্টোপাধ্যায়ের দিকেই কি একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া হল না? বৈশাখীর পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘বেহালা তো একটা ছোট জায়গা। শোভন চট্টোপাধ্যায় রাজ্য স্তরের নেতা। বেহালায় কাউকে কোনও দায়িত্ব দিয়ে কি আর শোভন চট্টোপাধ্যায়কে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলা যায়?’’

বেহালার তৃণমূলে রত্নার উত্থানের পরে কলকাতার পুরভোটে শোভন বিজেপির হয়ে সক্রিয় হওয়ার পথে পা বাড়াচ্ছেন, এ কথা কি ঠিক? বৈশাখী কিন্তু নস্যাৎ করেননি সে কথা। রবিবার তিনি বলেছেন, ‘‘সব দেখতে পাবেন। সময়ই বলে দেবে।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Baisakhi Banerjee Sovan Chatterjee BJP TMC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy