Advertisement
২৭ জানুয়ারি ২০২৫
Chhou Dance

ভাষার পরে নাচ, বাংলার ছৌ নাচের জন্য ‘ধ্রুপদী’ তকমা চায় বিজেপি, সংসদে উত্থাপনের তোড়জোড় শুরু

ছৌ নৃত্যের জন্য ‘ধ্রুপদী’ মর্যাদা চেয়ে কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের দ্বারস্থ হচ্ছে বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গের এক সাংসদ আসন্ন বাজেট অধিবেশনেই বিষয়টি সংসদে তুলবেন বলে বিজেপি সূত্রের খবর।

BJP wants Classical status for Chhou Dance form, preparations on to raise it in parliament

—প্রতীকী ছবি।

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫ ১৩:১৫
Share: Save:

ভাষার জন্য মর্যাদা ছিনিয়ে আনার কৃতিত্ব কার, তা নিয়ে টানাপড়েন রয়েছে। কেন্দ্র এবং রাজ্য উভয়েই বলছে, বাংলা ভাষার ‘ধ্রুপদী’ খেতাবপ্রাপ্তি তাদের কৃতিত্ব। তবে সে মীমাংসার পরোয়া না করে কেন্দ্রের শাসকদল এ বার বাংলার জন্য আরও এক ‘ধ্রুপদী’ মর্যাদা আদায়ের চেষ্টায়। ছৌ নৃত্যের জন্য ‘ধ্রুপদী’ মর্যাদা চেয়ে কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের দ্বারস্থ হচ্ছে বিজেপি। বাংলার এক সাংসদ আসন্ন বাজেট অধিবেশনেই বিষয়টি সংসদে তুলবেন বলে বিজেপি সূত্রের খবর।

ছৌ নাচকে ধ্রুপদী মর্যাদা দেওয়া হবে কি না, সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী সঙ্গীত-নাটক অ্যাকাডেমি। সংস্কৃতি মন্ত্রকের তরফ থেকে এ বিষয়ে ছাড়পত্র আগেই দেওয়া হয়েছে বলে শিল্পীমহলের একাংশের দাবি। কিন্তু সঙ্গীত-নাটক অ্যাকাডেমি এখনও ছৌকে ‘ধ্রুপদী’ তালিকার অন্তর্ভুক্ত করেনি। সে সব মাথায় রেখেই সংসদে প্রশ্ন তুলতে চান পশ্চিমবঙ্গের এক বিজেপি সাংসদ। বাংলার এই ‘পরম্পরাগত’ নৃত্যরীতিকে এখনও যে ‘ধ্রুপদী’ মর্যাদা দেওয়া হয়নি, সে কথা কি দেশের সরকার জানে? কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রক কি মনে করে যে ‘ধ্রপদী’ মর্যাদা পাওয়ার সমস্ত বৈশিষ্ট্য বাংলার এই নাচের মধ্যে রয়েছে? এমন একগুচ্ছ প্রশ্ন সংসদে তোলার প্রস্তুতি চলছে বিজেপি শিবিরে।

ছৌ নাচের ‘ধ্রুপদী’ মর্যাদা পাওয়া উচিত কি না, তা নিয়ে নৃত্যশিল্পী তথা বিশেষজ্ঞরা নানা মত। তবে ছৌ-কে কেউই লোকনৃত্য (ফোক) বলছেন না। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক বিভাগের প্রাক্তন প্রধান সোমনাথ সিংহ বলছেন, ‘‘পৃথিবীর যে কোনও লোকশিল্প বা লোকসংস্কৃতি চেনা যায় তার গায়ে লেগে থাকা মাটির গন্ধে। মাটির সঙ্গে তার সরাসরি যোগ থাকবে। ফসল কাটার উৎসব বা কোনও ধর্মীয় উৎসবের মতো বিষয়কে কেন্দ্র করে যে সব শিল্পরীতি আবর্তিত হয়, সেগুলো লোকশিল্প। ছৌ শুধুমাত্র কোনও সামাজিক বা ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে বেঁচে নেই। তাই তাকে লোকনৃত্য বলা যাবে না।’’

যে জেলা ছৌয়ের পীঠস্থান, সেই পুরুলিয়ার সাংসদ জ্যোতির্ময় মাহাতোও বলছেন, ‘‘কোনও নির্দিষ্ট উৎসবের সঙ্গে ছৌয়ের সম্পর্ক নেই।’’ বিজেপির সাংসদের কথায়, ‘‘ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি, চাষবাসের সঙ্গে যুক্ত মানুষজনই ছৌয়ের সঙ্গে বেশি জড়িত। কিন্তু নাচটা কোনও নির্দিষ্ট উৎসবকেন্দ্রিক নয়। মাঠে চাষের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে ছৌ নাচের আসর শুরু হত। আশ্বিন মাস থেকে শুরু হয়ে চৈত্র-বৈশাখ পর্যন্ত চলতে থাকত। তার পর আবার মাঠে মাঠে চাষের ব্যস্ততা শুরু হয়ে যেত।’’

অসমের বিহু বা গুজরাতের গঢ়বা অথবা পঞ্জাবের ভাংড়া লোকনৃত্যের পর্যায়ে। কারণ, এই সব নাচ এখনও নির্দিষ্ট সামাজিক বা ধর্মীয় উৎসবকেন্দ্রিক। কিন্তু ছৌ সেই সীমা পার করে ‘পরম্পরাগত’ নাচের মর্যাদা পেয়ে গিয়েছে আগেই। এ বার কি ‘পরম্পরাগত’ থেকে ‘ধ্রুপদী’তে উত্তরণ?

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রাক্তন ডিন (এবং কত্থক শিল্পী) অমিতা দত্ত বলছেন, ‘‘ছৌ নাচ এখনও পর্যন্ত যে অবস্থায় রয়েছে, তাতে ধ্রুপদী তকমা দেওয়া যায় না।’’ তাঁর কথায়, ‘‘ছৌয়ের মধ্যে কিছু সুন্দর ভঙ্গি রয়েছে, যা ধ্রুপদীর (ক্লাসিক্যাল) সঙ্গে মেলে। কিন্তু শুধু সেটুকুতেই একটা শিল্পরীতিকে ধ্রুপদী বলে দেওয়া যায় না। ধ্রুপদী তকমা পেতে হলে ছৌ-কে আরও বেশ কিছুটা পথ অতিক্রম করতে হবে।’’ অমিতার বক্তব্য, ‘‘কত্থক, ভরতনাট্যম, মণিপুরি, কথাকলি, ওড়িশি-সহ আমাদের যে সব ধ্রপদী নৃত্যরীতি রয়েছে, তাদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব কিছু মিউজিক সিস্টেম রয়েছে। অর্থাৎ, নির্দিষ্ট কিছু বাদ্যযন্ত্র, সুরের একটা ধাঁচ, সে সব বাজানোর রীতি ইত্যাদি। আর রয়েছে নিজস্ব কিছু সাহিত্য (বডি অফ লিটারেচার)। যার উপর নির্ভর করে ওই নাচের জন্য একটা নৃত্যনাট্য লেখা হবে।’’ ছৌয়ের এখনও তেমন কোনও ‘মিউজ়িক সিস্টেম’ বা ‘বডি অফ লিটারেচার’ নেই বলেই জানাচ্ছেন তিনি।

সোমনাথের মতেও ছৌ-কে ধ্রুপদী শিল্পের অন্তর্ভুক্ত করা ‘অকারণ’। তাঁর কথায়, ‘‘ছৌ যেখানে আছে, যেমন আছে, ভালই আছে। ছৌ তার নিজের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আছে। তাকে জোর করে ধ্রুপদী করার চেষ্টা না হওয়াই উচিত।’’ কিন্তু অমিতা আবার এর সঙ্গে একমত নন। তিনি বলছেন, ‘‘ছৌয়ের নৃত্যরীতিকে যদি আরও সুসংহত করে নেওয়া যায়, তা হলে ধ্রুপদী তকমা একদিন আসতেই পারে। তবে তার জন্য সময় লাগবে। ওড়িশিও এক সময়ে ধ্রুপদী ছিল না। পরে কেলুচরণ মহাপাত্রের মতো বড় বড় গুরুরা হাল ধরলেন। কোন অভিব্যক্তির প্রকাশ কোন মুদ্রায় হবে, ওড়িশির নিজস্ব মিউজিক কেমন হবে, ওড়িশি নাচের জন্য নৃত্যনাট্যগুলো কিসের উপর ভিত্তি করে হবে, এগুলো ধীরে ধীরে তাঁরা তৈরি করলেন। তার পরে ওড়িশি ধ্রুপদী তকমা পেল।’’ তাঁর বক্তব্য, ছৌ যাঁরা নাচেন, তাঁদের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কিছুটা কম। নাচের বিভিন্ন ভঙ্গি বা মুদ্রার যে সব নামকরণ, সে সবও ধ্রুপদী ঘরানার সঙ্গে মেলে না। মুদ্রাগুলো অনেক ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্টও নয়। শিল্পীরা স্বাধীন ভাবে যে যাঁর মতো করেন। যদি সবাই এক জায়গায় এসে কোনও সংস্থা তৈরি করতে পারেন, যদি বড় গুরুরা সেখানে এসে নৃত্যরীতিটাকে একটা সুনির্দিষ্ট আকার দেন, তা হলে ধ্রুপদী তকমা পাওয়া সম্ভব।

অন্য বিষয়গুলি:

Chhou Dance Traditional Dance Form Classical Dance Form purulia BJP
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy